বিএনপি–জামায়াত সম্পর্ক সংশয়ের দোলাচলে by সেলিম জাহিদ

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যকার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সখ্য ও জোটগত সংহতি সংশয়ের মধ্যে পড়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোক না জানানোয় ও তাঁর জানাজায় না যাওয়ায় এবং বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর বিএনপি বরাবরের মতো চুপ থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সর্বশেষ গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী ফেসবুকে বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে মন্তব্য করায় দল দুটির নেতাদের গণমাধ্যমসহ নানা মহলের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে জোটগত সম্পর্ক নিয়ে। এর আগে জোটের কর্মসূচিতে কিছুটা নিষ্ক্রিয়তা এবং আপিল বিভাগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়সহ কয়েকটি ঘটনায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতের গোপন সমঝোতা হয়েছে বলে সন্দেহ ছিল বিএনপির ভেতরে।
অবশ্য বিএনপি ও জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দাবি করছেন, ছোটখাটো কোনো কোনো বিষয়ে দুই দলের মধ্যে মতের অমিল বা মনঃকষ্ট তৈরি হলেও ২০-দলীয় জোট ভাঙনের পর্যায়ে যায়নি। তাদের মধ্যে ঐক্য অটুট আছে।
আজ শনিবার বিকেলে নাটোরে ২০-দলীয় জোটের জনসভায় জামায়াতের নেতা-কর্মীরা আগের মতোই অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। এর জন্য জনসভা মাঠের একটি অংশ জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে বলে জানান নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার।
জানতে চাইলে নাটোর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাঁরা ২০ দলের সমাবেশে অংশ নেবেন।
১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। শুরু থেকেই জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের একটি অংশের মধ্যে অস্বস্তি আছে। প্রায়ই দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, এমনকি কখনো কখনো জোটে ভাঙনের মতো খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি জামায়াত-বিএনপির জোটগত সম্পর্ক বজায় থাকা না-থাকা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এর মধ্যে গত ২৩ অক্টোবর রাতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযমের মৃত্যুর পর দুই দিন পর্যন্ত বিএনপির কেউ তাঁর মরদেহ দেখতে না যাওয়ায় এবং জানাজায় অংশ না নেওয়ায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বেশ ক্ষুব্ধ ও মনঃক্ষুণ্ন হন। দলটির নেতারা মনে করছেন, হয়তো বিএনপির উচ্চপর্যায়ের কারও নির্দেশনায় দলের নেতা-কর্মীরা একযোগে জানাজায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
এরপর গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর বিএনপির প্রতিক্রিয়াহীন অবস্থানের কারণে এ ক্ষোভ আরও বাড়ে। যদিও এ ধরনের রায়ের ক্ষেত্রে বিএনপি শুরু থেকেই নীরবতা পালন করে আসছে।
সর্বশেষ গোলাম আযমের চতুর্থ ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী ফেসবুকে বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে মন্তব্য করেন। এমনকি তিনি বিএনপির প্রতি এই বলে চ্যালেঞ্জ ছোড়েন যে জামায়াত ছাড়া বিএনপি কখনো ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। এরপর বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক টানাপোড়েনের আলোচনা আরও গতি পায়।
পর পর এই তিনটি ঘটনায় ২০-দলীয় জোটের প্রধান দুই শরিক দল বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে, এমনকি বিএনপি-জামায়াতের ভেতরেও নানামুখী আলোচনা চলছে। বিশেষ করে গোলাম আযমের ছেলে আমান আযমীর বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে বিএনপির ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
জামায়াত ছাড়া বিএনপি কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না—গোলাম আযমপুত্র আমান আযমীর এ উক্তির উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের ওপর নির্ভর করি। বিএনপি একটি বিশাল দল। যে দলের তিনবার ক্ষমতায় যাওয়া এবং দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে, সেই দলকে এত হালকাভাবে দেখা তো অন্যায়।’
যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শুক্রবার সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তাঁরা আবদুল্লাহিল আমান আযমীর বক্তব্যকে আমলে নিচ্ছেন না। কারণ, তিনি জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন না।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য মীর কাসেম আলীর মামলার রায় আগামীকাল রোববার ঘোষণার কথা রয়েছে ট্রাইব্যুনালে। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলা আপিল বিভাগে রায়ের অপেক্ষায় আছে। ট্রাইব্যুনালে রায়ের অপেক্ষায় আছে আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের মামলা। আর দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের মামলা আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার একের পর এক রায় দলটিকে বিপর্যস্ত করার পাশাপাশি শরিক দল বিএনপিকেও রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে বলে মনে করা হচ্ছে। অবস্থা এমন যে তারা জামায়াতের পক্ষও নিতে পারছে না। আবার জোট ভেঙে যাবে—এ শঙ্কায় বিপক্ষেও যেতে পারছে না। এ অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চুপ থাকার কৌশল নিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রগুলো জানায়।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, মুখে প্রকাশ না করলেও জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিএনপি একটি কৌশলগত নীতি বা অবস্থান নিয়েছে। তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা উচ্চ আদালতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের বিষয়ে সরাসরি না জড়ানো। এ জন্য ‘চুপ’ থাকার কৌশল নেওয়া হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনালের বিচার-প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও ত্রুটি নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, সে অবস্থানের পরিবর্তন হবে না। কিন্তু বিএনপির এ অবস্থানে ভেতরে ভেতরে মনঃক্ষুণ্ন²জামায়াত। যদিও দলটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রকাশ্যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়নি।
যশোরে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের সঙ্গে এ বিষয়ে গত রাতে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে বিএনপির কৌশল কী, তা তিনি জানেন না। তবে তিনি বলেন, ‘সরকারের কৌশল হচ্ছে জোটের ইউনিটি ব্রেক (ঐক্য নষ্ট) করা। বিএনপির ভেতর থেকে দল ভাঙার চেষ্টাও হচ্ছে।’
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজন এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের এবং জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আদর্শিক কোনো মিল নেই। দুটি দল নিজস্ব এবং পৃথক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে। তবে জাতির একটি বৃহত্তর স্বার্থে মৌলিক ইস্যুতে তাদের মধ্যে জোট হয়েছিল। সেখান থেকে কেউ সরে যায়নি।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০-দলীয় জোট যে লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে, সে লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছি, তা এখনো লক্ষ্যে পৌঁছেনি। এ অবস্থায় জোটের ভেতরে অনৈক্য কিংবা ভুল-বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ নেই।’

No comments

Powered by Blogger.