রাজনীতি ও বাংলাদেশের অতীত

দু’বার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া বিরল। ২৯শে অক্টোবর বাংলাদেশের নিজস্ব ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থি মিলিশিয়া নেতা হিসেবে ৭১ বছরের নিজামিকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। জানুয়ায়িতে একটি অপরাধ আদালত বড় একটি অস্ত্র চোরাচালান মামলায় পৃথক একটি রায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের ওই চালান ভারতের উত্তরপূর্বে চরমপন্থিদের জন্য ছিল। সে সময় সরকারে ছিলেন নিজামী। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এ বছর জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই প্রথম যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়। আটক অবস্থায় ৯১ বছরের গোলাম আযমের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর এলো এ রায়। ট্রাইবুন্যালে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আরেক হাই-প্রোফাইল অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। নিজামীর আগে জামায়াতের প্রধান নেতা ছিলেন তিনি। দলটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে সৌদি আরবীয় ধারার ইসলাম প্রচার করে। ১৯৭১ সালেও তিনি জামায়াতকে চালিয়েছিলেন। রাজধানী ঢাকায় ২৫শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত গোলাম আযমের জানাজায় তার হাজারো সমর্থক উপস্থিত ছিল। তার শেষ ইচ্ছা ছিল জানাজা পড়াবেন  নিজামী বা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত অপর আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি জনগণের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ চেষ্টা করে চলেছে। স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশী ও অন্যদের ওপর বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নির্মম রক্তক্ষয়ী অভিযান চালানোর পেছনে মূলত দায়ী ছিল পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানি হোতারা বরাবরই আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। কাজেই মি. আযম, মি. নিজামীসহ তাদের বাংলাদেশী সহযোগীদের বিচার হচ্ছে তাদের পরিবর্তে। তারা দুজনই স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। জামায়াতের ছাত্র শাখা সেনাপন্থি  মিলিশিয়া দলে সদস্য সরবরাহ করেছিল যারা নৃশংসতা, অপহরণ ও বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যাজজ্ঞ পরিচালনা করেছে। যুদ্ধাপরাধ আদালত নাৎসি বাহিনীর গুপ্তঘাতকদের মতো হামলা চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে নিজামীকে। তার আইনজীবীরা বলছেন, এ রায় তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ছিল না। তারা আপিলের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যে প্রক্রিয়া দু’বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। এ বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবার আগে তারা নজিরবিহীন নিরাপত্তা উপভোগ করেছে। পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডে নিরাপদে থাকার পর আজমকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করা দুই স্বৈরশাসক নিরাপত্তা দিয়েছে। তারা গোলাম আজমের ধর্মীয় রাজনীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। গণতন্ত্র ফিরে আসার পরও ওই দুই স্বৈরশাসকের একজন জিয়াউর রহমানের বিধবা পত্নী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের উত্তরসূরি খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়েন। বিএনপি সরকারের সময় নিজামি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। খালেদা জিয়ার বৈরী প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা সুবিধাটা উপভোগ করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের ভূমিধস বিজয়ের আগে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ বছরের নির্বাচনের আগ দিয়ে শীর্ষ অনেক যুদ্ধাপরাধী কারান্তরীণ হয়। ট্রাইব্যুনাল পরিচালনা প্রক্রিয়ায় গভীর ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও বিশেষ করে ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ থাকলে অনেকের রায় হয়। এর মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেসব রায়ের অনেকই এখন সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনায় রয়েছে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের কাছে এ বিচারপ্রক্রিয়ার রাজনৈতিক কার্যকারিতা ফুরিয়ে আসছে। এমনকি তারা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ বিচারপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত সংঘাতে এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ মারা গেছে। শেখ হাসিনা হয়তো এখন বিজ্ঞ, বৈধ এবং উদারমনা নেতা হিসেবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। ত্রুটিপূর্ণ একটি ট্রাইব্যুনালকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে দেয়ার মাধ্যমে তিনি এটা করতে পারেন। যেহেতু তিনি চান বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা সমুন্নত করুক। এ মাসে বাংলাদেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি আসন জিতেছে। খালেদা জিয়া যখন সর্বশেষ নির্বাচন বর্জন করেছিলেন তখন মিথ্যা গণতন্ত্রের যে অভিযোগ সরব ছিল এখন তা ফিকে হয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, লম্বা আপিল প্রক্রিয়া বিবেচনায় বয়োবৃদ্ধ বন্দিদের অনেকেই হয়তো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পর্যন্ত বাঁচবেন না। কারান্তরীণ অবস্থায় ইতিমধ্যে তিনজন মারা গেছে। সাঈদী, যার রায় সেপ্টেম্বর মাসে লঘু করা হয়েছে, তিনি হয়তো কোনদিনই কারাগারের বাইরে আসতে পারবেন না। এ ছাড়া রায়ের সময় ও রায় কার্যকর করাটা এখনও রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। শাস্তি লঘু করার বিষয়গুলো হয়তো এখন বিবেচনা করা যেতে পারে। এ সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে ছিলেন শেখ হাসিনা। উপসাগরীয় দেশগুলোতে যুদ্ধাপরাধ বিচার কিভাবে দেখা হচ্ছে সেটাও তার বিবেচনায় রয়েছে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো সৌদি আরব। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিকের সবথেকে বড় গন্তব্য হবার পাশাপাশি ভর্তুকিপ্রাপ্ত তেলে উৎস। সৌদি শাসকরা চাননা নিজামি বা অভিযুক্ত অন্যদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখানো হোক। এ কারণে শেখ হাসিনা যে দৃষ্টিভঙ্গি বারবার তুলে ধরেছেন সেটা তার জন্য মানানসই, তা হলো- আইনি প্রক্রিয়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে। আপাতত হয়তো অপেক্ষাকৃত কম সক্রিয় যুদ্ধাপরাধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করাটা সুবিধাজনক হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.