নারী মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পাবেন জানুয়ারি থেকে by রোজিনা ইসলাম

নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আগামী জানুয়ারি মাস থেকে ভাতা দেওয়া হবে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাও দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির আবেদনের জন্য একাত্তরের ২৬ মার্চ ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল ৩১ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করার আবেদনের সময় শেষ হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত (অক্টোবর) মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ২৫তম সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন সংজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন ওই সংজ্ঞায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এত দিন তাঁদের বীরাঙ্গনা বলা হতো। চলতি বছরের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট বীরাঙ্গনাদের কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না, তা সরকারের কাছে জানতে চান। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত নারীরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হতে পারবেন। নতুন গেজেটভুক্ত হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আগামী জানুয়ারি থেকে ভাতা দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, অন্য মুক্তিযোদ্ধারা যে সুযোগ-সুবিধা পান, নারী মুক্তিযোদ্ধারাও তাই পাবেন। পাঁচ হাজারের বেশি বীরাঙ্গনা রয়েছেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জামুকার ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, একাত্তরে যাঁদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন না। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আপত্তি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য একাত্তরের ২৬ মার্চ ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর রাখার বিধান রেখে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা করা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন বলেছে, একাত্তরে যাঁরা নবম, দশম শ্রেণির ছাত্র বা এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন, তাঁদের প্রকৃত বয়স যথাক্রমে ১৫ থেকে ১৭ হলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামাফিক নিবন্ধনের সময় তাঁদের বয়স প্রকৃত বয়সের দুই-তিন বছর কম দেখানো হয়েছিল। ফলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যেসব ছাত্রের প্রকৃত বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছর ছিল, এসএসসির সনদে দেখানো জন্মতারিখ অনুসারে একাত্তরের ২৬ মার্চে তাঁদের বয়স ১৩ বা ১৪ ছিল। ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী অনেক কিশোর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র দেওয়ার সময় ওই বাহিনীর ১৩ বছর বয়সী অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শহীদুল ইসলাম লালু অস্ত্র জমা দেন। ওই বাহিনীর প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকীর দেহরক্ষী বজলুর রহমানের বয়স ছিল ১৪ বছরের কম।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি নূর ইসলাম মোল্লা বলেন, মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়সসীমা নির্ধারণপূর্বক নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণের বিষয়টি কোনো আইনে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং এ ধরনের আইনকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেওয়ার আইনগত সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যাঁদের বয়স কমপক্ষে ১৩ বছর ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির আবেদন করতে পারবেন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ অত্যন্ত সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণের বিষয়টি নীতিনির্ধারণী বিষয় হওয়ায় জামুকা আইন, ২০০২ অনুযায়ী জামুকার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মতামতের জন্য পাঠানো হচ্ছে। নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাওয়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞার প্রস্তাবের বিষয়ে জামুকা ও মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা অুনমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা: নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী লাল মুক্তিবার্তা, ভারতের তালিকা (বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের), প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত সনদধারী, প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গিয়ে নাম অন্তর্ভুক্তকারীরা, স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করা পেশাজীবীরা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়, স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা গ্রহণকারী সাংবাদিকেরা, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রূষাকারী চিকিৎসক, নার্স ও তাঁদের সহকারীরা, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমএলএ ও এমপি, অস্থায়ী সরকারের অধীনে স্থাপিত অফিসগুলোর দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হতে পারবেন।

No comments

Powered by Blogger.