‘স্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে ফেলায় এসআই’র রোষানলে পড়ি’ by রুদ্র মিজান

গভীর রাতে শান্তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছিল শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন। হঠাৎ দরজায় নক করেন শান্তার স্বামী গাড়িচালক শাহ আলম। এত রাতে বাসায় আনোয়ারকে দেখে ক্ষুব্ধ হন তিনি। আনোয়ারের ওপর চড়াও হন শাহ আলম। পরে স্ত্রী শান্তাকে মারধর করেন তিনি। এ ঘটনার পর থেকেই একের পর এক এসআই আনোয়ার ও শান্তার মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত শাহ আলমের জীবন। পরকীয়া প্রেমে বাধা দেয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর প্রেমিক আনোয়ার তাকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ দুই পা নিয়ে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন শাহ আলম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এমন তথ্য জানিয়েছেন শাহ আলম।

গত ২৭শে অক্টোবর এসআই আনোয়ারের তিন দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আশিকুর রহমান জানান, রিমান্ডে আনোয়ার ডিবির কাছে স্বীকার করেছে, ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে শাহ আলমকে সে গুলি করেছে। কি নিয়ে শাহ আলমের সঙ্গে তার শত্রুতা এ বিষয়ে সে জানিয়েছে, শাহ আলম বদমেজাজি, বেয়াদব। শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশের সিভিল টিমের গাড়ি চালক শাহ আলম তার কথার অবাধ্য হলে দু’জনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। পরে এসআই আনোয়ারকে হুমকি-ধমকি দেয় শাহ আলম। এ ঘটনার জের ধরেই শাহ আলমকে সে গুলি করেছে বলে জানায়। যে অস্ত্র দিয়ে তাকে গুলি করা হয়েছে তা সম্পর্কে এসআই আনোয়ার জানিয়েছে, ওই অবৈধ অস্ত্রটি তার না। এটি শাহ আলমের কাছে ছিল।  জিজ্ঞাসাবাদে শান্তার সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কের বিষয় সে অস্বীকার করেছে। ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, পরকীয়ার বিষয়টি তারাও নিশ্চিত হতে পারেননি। শাহ আলমের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, আনোয়ারকে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আশিকুর রহমান বলেন, আনোয়ার পুলিশের লোক যে কারণে তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করতে বেগ পেতে হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি কিছু না।
শাহ আলম ও শান্তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই পরিবারের অমতে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন শাহ আলম ও শান্তা। ২০০৬ সালের কথা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়িতে ভিডিও গেমস ও ফোন-ফ্যাক্সের ব্যবসা করতেন শাহ আলম। থাকতেন বড় ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে একই এলাকার চান মিয়া হাউজিংয়ের ৪১/২ নম্বর বাসায়। তাদের বাসার পাশেই থাকতেন শান্তার নানার পরিবার। ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন শান্তা। থাকতেন বাবা-মায়ের সঙ্গে একই এলাকায়। আসা-যাওয়ার মধ্যেই দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। একপর্যায়ে মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ সড়কের একটি বাসায় মিলিত হন দু’জন। খবর পেয়ে ওই বাসায় গিয়ে শাহ আলমকে মারধর করেন শান্তার মামা, বাবাসহ স্বজনরা। পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। তখন শান্তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করেন শাহ আলম। কিন্তু শান্তার কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। শান্তা তাকে কিছুতেই হারাতে চান না। অভিভাবকদের অজান্তে পালিয়ে বিয়ে করার জন্য চাপ দেন শাহ আলমকে। একপর্যায়ে রাজি হন শাহ আলম। দুই পরিবারের সদস্যদের অজান্তে ২০০৮ সালে রামপুরার একটি কাজী অফিসে বিয়ে করেন এ প্রেমিক-প্রেমিকা। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানসংলগ্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নেন নবদম্পতি। বিয়ের পর শাহ আলম গাড়ি চালানো শিখেন। এর মধ্যেই শান্তার মা-বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। তাদের সংসারে একটি কন্যাসন্তানও আসে। ভাড়া বাসা নেন তাদের পাশাপাশি বাঁশবাড়ি মসজিদসংলগ্ন এলাকায়। অন্যদিকে, ছাত্র জীবন থেকে ওই এলাকায় ছিল আনোয়ার হোসেন। গত ২০০৭ সালে সে পুলিশে চাকরি নেয়। সিভিল টিমের দায়িত্বে ছিল এসআই আনোয়ার। তার সঙ্গে পূর্ব থেকেই ভালো সম্পর্ক ছিল শান্তা ও তার মা-বাবার। সেই সুযোগে শাহ আলমকে শেরেবাংলা থানা পুলিশের সিভিল টিমের চালক হিসেবে চাকরি নিতে বলেন তারা। চাকরির পর আনোয়ারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে শাহ আলমের। তার বাসা তখন মোহাম্মদপুর টিক্কাপাড়া। পাশেই এসআই আনোয়ারের বাসা। শাহ আলমের বাসাতে  প্রায়ই গোসল, খাওয়া-দাওয়া করতো আনোয়ার। শান্তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী কিনে দিতে। এভাবেই শাহ আলমের অগোচরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে আনোয়ার ও শান্তার। ‘হ্যালো জান, কেমন আছো, কি করছো?’ প্রায়ই এরকম ক্ষুদেবার্তা আসতো শান্তার মোবাইল ফোনে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাধীন শাহ আলম জানান, তিনি অল্প লেখাপড়া করেছেন। মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তা পড়তে জানেন না। কিন্তু ঘনঘন শান্তার মোবাইল ফোনের ইনবক্স ভরে যাওয়া দেখে তার সন্দেহ হয়। একদিন প্রতিবেশী একজনকে ক্ষুদে বার্তা দেখালে ওই ব্যক্তি তাকে পড়ে শোনান। চাকরি করার প্রায় এক বছর পর তিনি এটি জানতে পারেন। তার ধারণা আরও আগ থেকেই শান্তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আনোয়ারের। জানার পর অপেক্ষায় ছিলেন একদিন হাতে নাতেই ধরবেন। শাহ আলম জানান, এক রাতে সিভিল টিমের ডিউটি করতে গিয়ে এসআই আনোয়ার জানায়, তার শরীর খারাপ। কিছু সময় বাসায় বিশ্রাম নেবে। টিমের পুলিশ সদস্যসহ চালক শাহ আলমকে কৃষি মার্কেটের সামনে থাকতে বলে। এভাবে প্রায় রাতেই সিভিল টিমের ডিউটি করতে গিয়ে আনোয়ার শরীর খারাপ লাগছে বলে অন্যান্য ফোর্সদের গাড়িতে রেখে বাসায় চলে যেতো। আনোয়ার যাওয়ার কিছু সময় পরেই বাসায় যান শাহ আলম। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। নক করার কয়েক মিনিট পরে দরজা খুলে দেন শান্তা। বাসায় তখন শান্তা ও আনোয়ার। উত্তেজিত হয়ে যান শাহ আলম। জানতে চান, স্যার আপনি এতো রাতে আমার বাসায় কেন? আপনার তো শরীর খারাপ। বললেন, বাসায় বিশ্রাম নেবেন। কিন্তু আমার বাসায় কেন? এটাতো ভালো না স্যার। এসআই আনোয়ার তখন শাহ আলমকে বলে, তুমি কি বলছো, তোমার মাথা ঠিক আছে তো? একপর্যায়ে আনোয়ার চলে যায়। তখন শান্তার প্রতি চড়াও হন শাহ আলম। কেন সে এতো রাতে পরপুরুষকে দরজা খুলে দিলো তা জানতে চান। একপর্যায়ে শান্তাকে মারধর করেন। পরদিন থেকেই শাহ আলমের বিরুদ্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। তার অজান্তেই এসআই আনোয়ারের পরামর্শে শাহ আলমকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন শান্তা। অভিযোগ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন। অমীমাংসিত চারটি মামলায় তাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে এসআই আনোয়ার। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পরই এসব জানতে পারেন শাহ আলম। দীর্ঘদিন পর গত সেপ্টেম্বরে জেল থেকে জামিনে বের হয়ে জানতে পারেন কেরানীগঞ্জের আরশিনগরে একটি বাড়ির ফ্ল্যাট বাসায় শান্তাকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে থাকেন এসআই আনোয়ার। ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শেখ মোফাজ্জল জানান, ১লা সেপ্টম্বর বাসা ভাড়া নেন শান্তা। স্বামী হিসেবে প্রায়ই ওই বাসায় রাত যাপন করতেন এক যুবক। ওই যুবক যে শাহ আলম ছবি দেখে তা নিশ্চিত করেন তিনি। বাসা ভাড়া নেয়ার প্রায় ২০ দিন পরে এক যুবক এসে তার কাছে জানতে চান, এই বাড়িতে কি শান্তা নামে কেউ থাকেন। মোফাজ্জল জানান, স্বামী ও আড়াই বছরে এক কন্যা সন্তানসহ শান্তা থাকেন। তখন ওই যুবক নিজেকে শান্তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাড়াহুড়া করে চলে যান। কয়েক দিন পর ওই যুবক আবার ওই বাড়িতে যান। মোফাজ্জলকে জানান, তার নাম শাহ আলম। শান্তা তার স্ত্রী। ছোট্ট মেয়েটি তার সন্তান। কিন্তু স্বামী পরিচয়ে যে লোকটি শান্তার সঙ্গে থাকছে সে তার স্বামী না। সে পুলিশের এসআই আনোয়ার। শাহ আলম বলেন, চাচা, আমি খুব অভাগা পিতা। আমার মেয়েটা এখন অন্য একজনকে বাবা ডাকছে। আমার বিয়ে করা বউ অন্যের সঙ্গে থাকছে। বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন শাহ আলম।
গত ১৯শে অক্টোবর বিষয়টি তিনি মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট এলাকার বাসিন্দা সিরাজ নামক ব্যক্তিকে জানান শাহ আলম। সিরাজ তাকে কৃষি মার্কেট এলাকায় যেতে বলে। সেখানে এসআই আনোয়ারের স্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়ে সমাধান করা হবে বলে জানায় সে। সিরাজের কথামতো ওই দিন রাতে সেখানে গেলে গাড়িচালক শাহ আলম (২৬)-কে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা ধরে তালতলায় নিয়ে যায়। সেখানে এসআই আনোয়ার তার দুই পায়ে গুলি করে। এরপর তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা সাজিয়ে থানায় মামলা করে। ওই অভিযোগ ওঠার পর এসআই আনোয়ারকে ২২শে অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়। প্রত্যাহার করা হয় শেরেবাংলা নগর থানার ওসি আবদুল মমিনকে। পরে এ ঘটনায় আনোয়ারের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন শাহ আলমের ভাই গোলাম মোস্তফা। মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি। ওই মামলায় এসআই আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হলেও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পুলিশ সনদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনার পর এসআই আনোয়ারের দায়েরকৃত মামলার এজাহারে লেখা রয়েছে বন্দুকযুদ্ধে শটগানের পাঁচ রাউন্ড গুলি খরচ হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশী পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। এ অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে এসআই আনোয়ারের কাছ থেকে সঠিক তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি ডিবি। এদিকে, ঘটনার পর থেকে আরশিনগরের বাসায় শান্তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার ওই বাসায় গেলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মোফাজ্জল জানান, শান্তার বাবা দু’দিনের সময় নিয়েছেন। এর মধ্যেই তারা বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন। আহত শাহ আলম জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ঘোষারহাট থানার পাঁচাকাটি গ্রামে। একই জেলার বাসিন্দা সিটিসেল টেলিকম কোম্পানির সাবেক গাড়ি চালক আব্দুল জলিল ওরফে দলির কন্যা নুসরাত জাহান শান্তা। বড় হয়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায়। শান্তা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.