নিষিদ্ধ বোমামেশিনের তাণ্ডবে ধ্বংসের পথে জাফলং by এনামুল হক জুবের

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং। পাহাড়, টিলা আর চা বাগানসংলগ্ন সীমান্তঘেঁষা জাফলং প্রকৃতিকন্যা নামেও পরিচিত। সিলেট নগরী থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে জাফলংয়ের অবস্থান। গোয়াইনঘাট উপজেলার অধীন জাফলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই সেখানে আসেন বিভিন্ন বয়সের দেশী-বিদেশী পর্যটক। ঈদ ও অন্যান্য ছুটির সময়ে জাফলংয়ে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়। এখানে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে স্বচ্ছ জলরাশির পিয়াইন নদী। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে এই নদী থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্তে বালু জমে চোরাবালির সৃষ্টি হওয়ায় এবং স্বচ্ছ জলধারায় গভীরতা কম দেখা যাওয়ায় কেউ কেউ পানিতে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যান। পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। জাফলংয়ের নানা স্থানে পিয়াইন নদীতে মাসের পর মাস ধরে চলে আসছে বোমামেশিন দিয়ে (যান্ত্রিক পদ্ধতিতে) পাথর উত্তোলন। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রশাসনের সহায়তায় পর্যটন এলাকা জাফলংকে ধ্বংস করা হচ্ছে এমন অভিযোগ সচেতন মহলের। বোমামেশিনের তাণ্ডবে ভূমিধস ও অকাল বন্যার পাশাপাশি পিয়াইন নদীর গতিপথও পরিবর্তন হচ্ছে। কান্দুপট্টি, নয়াবস্তি, জাফলং বাজার ও সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ভূমিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। তারা জাফলং রক্ষায় ও আইনের বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

>>পর্যটন এলাকা জাফলংয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বোমামেশিন দিয়ে (যান্ত্রিক পদ্ধতিতে) পাথর উত্তোলন চলছে : শিপন আহমদ
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পরিবেশবিধ্বংসী বোমামেশিন দিয়ে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন থেকে কোয়ারি ও তৎসংলগ্ন এলাকার পিয়াইন নদীর ৫০-৬০ ফুট গভীর থেকে দিবারাত্রি পাথর উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। বোমামেশিন সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় জাফলংয়ে দীর্ঘ দিন ধরে এ ধ্বংসলীলা চলে আসছে। বিশেষ করে জাফলং চা বাগানসংলগ্ন কাটারী এলাকা, কান্দুপট্টি গ্রাম ও লন্ডনি বাজার পর্যন্ত অসংখ্য বোমামেশিনে পাথর উত্তোলন হলেও তা বন্ধ করতে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। জাফলংয়ে মাঝে মধ্যে টাক্সফোর্সের অভিযান চালানো হয়। কিন্তু অভিযানের খবর সংশ্লিষ্টদের কাছে পূর্বেই পৌঁছে যায়। ফলে আইনের বাস্তবায়ন হয় না। গত ২৭ জুলাই টাক্সফোর্সের অভিযানে ১৭টি বোমামেশিন জব্দ করা হলেও ওইগুলোসহ অর্ধশতাধিক বোমামেশিন কোয়ারিতে চলছে। ১৩ অক্টোবর টাক্সফোর্সের আরেকটি অভিযান হলেও এক দিন পর থেকে মেশিনগুলো আবার চলতে থাকে।
স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রতিটি বোমামেশিন থেকে হাজার হাজার টাকা চাঁদা তুলে কয়েক লাখ টাকা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। যার ফলে বোমামেশিনের তাণ্ডব থামছে না। স্থানীয় এমপি ইমরান আহমদ ইতঃপূর্বে গোয়াইঘাটের একটি সভায় স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বোমামেশিন বন্ধের নির্দেশ দিলেও প্রশাসন বোমামেশিন বন্ধে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে রহস্যজনকভাবে নীরব রয়েছেন। এর ফলে শুধু লোক দেখানো অভিযানে রক্ষা পাচ্ছে না নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলং। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জাফলং চা-বাগানসহ গ্রাম, হাট বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেন, বোমামেশিনের তাণ্ডব বন্ধ করে পরিবেশ রক্ষায় টাস্কফোর্সের অভিযান কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ, অভিযান তো প্রতিদিন সম্ভব নয়। পুলিশি টহল জোরদার ও নজরদারি থাকলে কেউ বেআইনি কাজ করতে সাহস পাবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাস্কফোর্সের অভিযানকালে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পরিবেশ অধিদফতরকে অনুরোধ করার পরও তারা কোনো মামলা করেনি। জাফলংয়ে পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধে স্থায়ী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে প্রসঙ্গে ইউএনও নয়া দিগন্তকে বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারলে ও পুলিশি টহল জোরদার করা হলে কেউ অপকর্ম করতে সাহস পাবে না। নিজের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি শুধু আইনগত সহযোগিতা করতে পারি। পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দেন ইউএনও।
গোয়াইনঘাট থানার ওসি আব্দুল হাই বলেন, জাফলংয়ে পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। পরিবেশ অধিদফতর এ ব্যবস্থা নেবে। পাঁচ মাস আগে তিনি এ থানায় যোগদানের পর এখন পর্যন্ত পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি বলে উল্লেখ করেন ওসি। তবে, এ সময়ের মধ্যে টাস্কফোসের্র অন্তত ১৫টি অভিযানে অনেক মেশিন ভেঙে ফেলা হয় ও পুড়িয়ে দেয়া হয়। আইনানুগ ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই অভিযানের পরও পবিবেশ বিনষ্টকারী তৎপরতা আবার শুরু হয়।
পরিবেশ অধিদফতর সিলেটের সহকারী পরিচালক মো: মোস্তাফিজুর রহমান জানান, জাফলংয়ে বোমামেশিনের কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে জাফলং চা বাগান। তিনি বলেন, সর্বশেষ টাস্কফোর্সের অভিযানে কয়েকটি বোমামেশিন ভেঙে ফেলা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় জাফলংয়ে পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আপনারা কেন মামলা করছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ তথ্য সঠিক নয়। সাম্প্রতিককালে টাস্কফোর্সের অভিযানে বোমামেশিন পাওয়া গেলেও এগুলো পরিচালনার সাথে জড়িত কাউকে পাওয়া না যাওয়ায় মামলা হয়নি। তবে পরিবেশ অধিদফতর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের মাধ্যমে এ পর্যন্ত পরিবেশবিষয়ক অন্তত ৩০০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু জাফলংয়ের প্রায় ৫০টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে, জেলা প্রশাসক, ইউএনও ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক জাফলংয়ে বোমামেশিন উচ্ছেদসহ পরিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ নেবেন।

No comments

Powered by Blogger.