সংসদ থেকেও লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কার সম্ভব by মিজানুর রহমান খান

মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ চলে যাবে কি যাবে না, সে মর্মে দুটি বিপরীতমুখী মত এসেছে ক্ষমতাসীন দল থেকে। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি মনে করেন, সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করলেও সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে না। কিন্তু এই সুযোগে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সিদ্দিকীকে সংসদ থেকে বহিষ্কারের একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। জাতীয় সংসদ কখনো তার সদস্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়নি। সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সংসদের জন্য অবমাননাকর। বাংলাদেশের সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে আছে, সংসদ চলাকালে স্পিকার কোনো সাংসদকে কোনো নির্দিষ্ট দিনের বৈঠকের বাদবাকি সময়ের জন্য বহিষ্কার করতে পারেন। কিন্তু সংসদ থেকে বহিষ্কার করে তাঁর আসন শূন্য ঘোষণার নির্দিষ্ট বিধান নেই। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, যে বিধান নেই তা কী করে সুপারিশ করেন এবং সংসদ বাস্তবায়ন করবে। এর উত্তরে বলব, আমাদের সংবিধানের ৬৬ (২) অনুচ্ছেদের ‘ছ’ উপ-দফার অধীনে সাংসদ থাকার নতুন অযোগ্যতা নির্দেশ করা সম্ভব। ভারতের সংবিধানে অযোগ্যতা নির্ধারণী ১০২ অনুচ্ছেদটির সঙ্গে আমাদের ৬৬ অনুচ্ছেদের অবিকল মিল আছে। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, নতুন আইন না করে সিদ্দিকীকে সংসদ থেকে কী করে বহিষ্কার সম্ভব? ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ভাষায় বলি, ‘সংবিধানে না লেখা থাকলেও সার্বভৌম সংসদ হিসেবে তার সহজাত অধিকার আছে নিজের সমস্যা নিজেকে সমাধান করা। এ বিষয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।’ ১৯৫১ সালে লোকসভা সদস্য এইচ জি মুডগালকে বহিষ্কারের ঘটনায় নেহরু ওই মন্তব্য করেছিলেন।

মুডগালের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতিসহ অন্যান্য অভিযোগ লোকসভা একটি কমিটি করে তদন্ত করে এবং তারা রিপোর্ট দেয় যে ওই সাংসদের আচরণ লোকসভার আচরণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মুডগাল এরপর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেও তা গ্রহণ না করে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী লোকসভা তাঁকে বহিষ্কার করে। তাঁর আসন শূন্য হয়। ভারতে সেটাই প্রথম দৃষ্টান্ত। ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘ঘুষের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপনের’ দায়ে লোকসভা তার ১০ সদস্যকে বহিষ্কার করেছিল। বহিষ্কারের এই রীতিরও জনক হাউস অব কমন্স। ১৬৬৭ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যবর্তী ২৮৭ বছরে কমন্স তার ৬০ সদস্যকে বহিষ্কার করেছে। আমরা সম্প্রতি জাতীয় সংসদকে বিচারকদের বিচারের ক্ষমতা নিতে দেখলাম। তাহলে আমরা কেন লতিফ সিদ্দিকীর মতো একজন অভিযুক্ত সদস্যের বিরুদ্ধে সংসদকে সার্বভৌম হতে দেখব না? একটাই বাধা, সংসদ নেতা প্যান্ডোরার বাক্স খোলার ঝুঁকি নেবেন কি না। লতিফ সিদ্দিকীকে হয়তো দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এরপর ১৯৯৬–২০০১ সালের মেয়াদে বিএনপির সাংসদ আলাউদ্দিন ও হাসিবুর রহমানের মতো একটি বৈধতার প্রশ্ন তোলা হবে স্পিকারের কাছে। আর আমরা সেদিনের বিএনপির ভূমিকায় দেখব ক্ষমতাসীন দলকে। এবারে স্পিকার হয়তো সেটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছেও পাঠাবেন। ১৯৮১ সালের আইনমতে ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন রায় দেবেন। এভাবে সংসদ অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করতে উৎসুক থাকবে। সিদ্দিকী-কীর্তি একটা বিরল সুযোগ, যার বিরুদ্ধে মোটামুটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁকে বহিষ্কার করলে প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ কিছুটা হলেও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। উপরন্তু এ দেশ প্রমাণ করেছে যে রাষ্ট্রের অন্যান্য স্তম্ভ দিয়ে সাংসদ বা রাজনীতিকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অত্যন্ত দুরূহ। তার চেয়ে বরং কিছু ব্যাধি নিরাময়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকেই কাজে লাগানো উচিত।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে লোকসভা যে কাণ্ড করেছে, সেটা আদালতকে দিয়ে করাতে গেলে আদালতকে অহেতুক জখম হতে হতো। ১৯৭৭ সালে লোকসভা কমিটি ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু সে জন্য শাস্তি কী হবে, তা নির্ধারণের ভার সংসদের কাছে ন্যস্ত করে। লোকসভা তার অবমাননার জন্য ইন্দিরাকে লোকসভা অধিবেশনের সমাপ্তি পর্যন্ত মেয়াদে কারাবাসের শাস্তি ও লোকসভা থেকে বহিষ্কার করে। এরপর কংগ্রেস এর বৈধতার প্রশ্ন নির্বাচন কমিশনে নিয়ে যায়। আর নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দেয় যে বহিষ্কৃত হওয়ার পরই লোকসভায় ইন্দিরার আসন শূন্য হয়ে গেছে। মাত্র তিন বছর পর একটি নতুন লোকসভা তার আগের সিদ্ধান্তকে ত্রুটিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে ইন্দিরাকে নির্দোষ ঘোষণা করে। সংসদীয় গণতন্ত্র সত্যি চাইলে বাংলাদেশকে এ ধরনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা মনে রাখব সিদ্দিকীর প্রধান পরিচয় তিনি সাংসদ। তিনি যদি মন্ত্রী না থাকতেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে সংসদ কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে? আমরা এই বিষয়টিকে বৃহত্তর পরিসরে বোঝার চেষ্টা করি। ব্যক্তি সিদ্দিকী বলে নয়, দেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত প্রদানের ঘটনা, সেটা ধর্মীয় অনুভূতি ব্যতিরেকে কোনো বড় ধরনের দুর্নীতি বা কেলেঙ্কারি বাধালেও ঘটতে পারে। আর তখন সংসদ নেতা তাঁকে বহিষ্কারের উদ্যোগ না নিলে সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদে যেখানে বলা আছে, জনগণ ক্ষমতার মালিক, সেই মালিকপক্ষের নিতান্ত অসহায় দর্শক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সে কারণে বিশ্বে একটি নতুন প্রবণতা লক্ষ করছি। চার বা পাঁচ বছরের একটি টানা মেয়াদে কেউ একজন যত অপকর্মই করুন, জনগণ একবার তাঁকে নির্বাচিত করেছেন বলে তিনি যাতে তাঁদের মাথায় চড়ে বসতে না পারেন, সে জন্য রিকল-ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। নতুন করে যারাই সংবিধান লিখছে, তারাই রিকল-ব্যবস্থা চালু করছে। এই বিধান আমাদেরও থাকা দরকার। এটা থাকলে পদত্যাগ বা বহিষ্কারের তর্কে সময় নষ্ট হতো না। টাঙ্গাইলের মানুষ অনেক আগেই উপনির্বাচনের মাধ্যমে তাঁদের নেতা পাল্টানোর উদ্যোগ নিতে পারতেন। সৈয়দ আশরাফ অবিলম্বে উপনির্বাচন চেয়েছেন। কিন্তু তা কীভাবে হতে পারে? পুরো জাতি এবং সংশ্লিষ্ট দলও যখন চাইছে, তখন আমরা এমন সংবিধান করেছি, যা দ্রুত একটি উপনির্বাচন হতে দিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটা আইনের মীমাংসিত নীতি যে সংবিধান ব্যাখ্যায় সংবিধানপ্রণেতাদের ‘অভিপ্রায়’ কী ছিল, সেটা মানা আবশ্যক। সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের ভাষায়, ‘বহিষ্কার করা হলে সংসদের আসন শূন্য হওয়ার বিধানকে বাক্স্বাধীনতার জন্য “বেশি রূঢ়” বিবেচনা করা হয়েছিল। তাই সুচিন্তিতভাবে বহিষ্কারের শর্ত পরিহার করে ৭০ অনুচ্ছেদে মাত্র দুটি শর্ত (পদত্যাগ ও দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া) যুক্ত করা হয়েছিল।’ এটাই কি বেদবাক্য? পেছনের দরজা দিয়ে মন্ত্রী হওয়া ঠেকাতে বঙ্গবন্ধু ৭০ অনুচ্ছেদ এনেছিলেন। প্রশ্নের জবাবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আমাকে বলেন, শেখ মুজিব তাঁকে বলেছিলেন ৭০ অনুচ্ছেদ একটা স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা। ১৯৯৮ সালে বিএনপির মো. আলাউদ্দিন ও হাসিবুর রহমানকে শেখ হাসিনা যথাক্রমে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী করেছিলেন। সেদিক থেকে এরশাদকে নিয়ে এবার যা ঘটল, সেটা দ্বিতীয় উপাখ্যান। বিএনপি তাদের ওই দুই ছদ্মবেশী দলত্যাগীর আসন শূন্য করাতে চাইলে স্পিকার (হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী) রুলিং দিলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটেনি।’ অথচ আইন বলেছে, কারও সদস্যপদ নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে স্পিকার তা ৩০ দিনের মধ্যে ইসির কাছে পাঠাবেন, এবং তাদের মতই চূড়ান্ত। স্পিকার সেই প্রশ্ন তৎকালীন সিইসি আবু হেনার কাছে পাঠিয়েছিলেন বটে কিন্তু তা হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের দ্বারা তাঁর রুলিং নাকচ হওয়ার আগে নয়। ইসির রায় ছিল, ওই দুজন তাঁদের ‘আচরণের মাধ্যমে বিএনপি থেকে পদত্যাগ’ করেছেন। ১৯৯৯ সালের ১১ অক্টোবর তাঁদের মন্ত্রিত্ব গেল। সংসদের আসনও শূন্য হলো।
এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে আমরা তাই সুপারিশ রাখব, জনগণ যাতে প্রত্যক্ষভাবে তাঁদের ক্ষমতার অনুশীলন করতে পারেন, সে জন্য রিকল-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে। তাহলে ‘২০১৯ সালের এক ঘণ্টা আগেও’ সাধারণ নির্বাচন নাই-বা হলো, জনগণ অন্তত কোথাও কোথাও ‘রিকল’ করে সংসদ গঠন-প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে। আমাদের সংবিধানমতে যুদ্ধ হলে গোটা সংসদকে রিকল করা যায়। কিন্তু আমাদের জরুরি দরকার জনগণের কাছে ব্যক্তি সাংসদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। বর্তমান ব্যবস্থায় সিদ্দিকীর মতো সাংসদেরা ব্যক্তিগত অপকীর্তি দলের কাঁধে চাপিয়ে দিন পার করতে পারেন। রিকল-ব্যবস্থা দলের শাপমোচন ও জনগণের অংশগ্রহণ উভয় দিক নিশ্চিত করতে পারে। বর্তমানে ৫০টির বেশি দেশে (অধিকাংশ নতুন গণতন্ত্র) কোনো না কোনো মাত্রায় রিকল-প্রথার ব্যবহার আছে। প্রতিবেশী মিয়ানমার তার ২০০৮ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে উন্নত গণতন্ত্রের আদলে লিখেছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটাররা তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে রিকল করতে পারবেন। এর মানে হলো, সংসদ না ভেঙে আসনভিত্তিক মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচন করা যাবে। মিয়ানমার পারলে আমরা পারব না কেন? তবে আপাতত যেটা চাইছি সেটা হলো, সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কার করে ইসিকে দিয়ে আসন শূন্য করানোর পথে না যাওয়া। সংবিধানের আদি চেতনা টিকে থাক। এখন তাই উপযুক্ত উপায় হলো তাঁকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা। ৭০ অনুচ্ছেদের মতো বিধান আছে আয়ারল্যান্ডে। সংসদ অবমাননার জন্য তারাও সাংসদ বহিষ্কার করে থাকে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.