জুয়ায় চাতুর্য ও কৌশলের জয়

শরিকদের ছেঁটে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে নেমে জুয়া খেলার ঝুঁকি নিয়েছিল ভারতে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। চাতুর্য ও কৌশলের ওপর ভর করে সেই জুয়ার দান বাগিয়ে নিতে পেরেছে দলটি। জিতেছে উভয় রাজ্যে। বিজেপির এই বিজয় ওই দুই রাজ্যে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। এর ফল শুধু ওই দুই রাজ্যেই নয়, সামনের দিনগুলোতে ভারতের অন্যত্রও প্রভাব ফেলবে। এটা সত্যি যে বিজেপি মহারাষ্ট্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে সেখানে তাদের একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ অন্য দলগুলোর জন্য একটা বড় ধাক্কা। একই সঙ্গে হরিয়ানায় বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে আসাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দুটো রাজ্যেই এককভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত বিজেপির জন্য বড় ধরনের জুয়া খেলার মতো ছিল। হরিয়ানায় নির্বাচনের আগে আঞ্চলিক দল হরিয়ানা জনহিত কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক ভেঙে যায় ওই দলটি বেশি আসন দাবি করায়। আসলে বিহারের বিধানসভার কয়েকটি আসনের উপনির্বাচনে বিজেপি খারাপ ফল করায় পেয়ে বসে দলটি। মহারাষ্ট্রেও বিজেপির মিত্র শিবসেনা নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে অবাস্তব ধারণা করেছিল। যা হোক, দুই রাজ্যে মোদি হাওয়ার ওপর ভর করে জুয়ার দানে বিজেপি জিতে গেছে। বিজেপির এই জুয়া খেলায় চাতুর্য ছিল, সঙ্গে কৌশলও। মহারাষ্ট্রে বিজেপির লক্ষ্য ছিল শিবসেনার চেয়ে বেশি আসন পেয়ে দলটির সঙ্গে সম্পর্কের নতুন দিকের সূচনা করা। আর কৌশলগত দিকটি হলো, যেসব রাজ্যে (যেমন হরিয়ানা) বিজেপির তেমন প্রভাব নেই, সেগুলোতে জিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি ‘বিজয়ীর ভাবমূর্তি’ তৈরি করা। অর্থাৎ তিনি যেখানে যান সেখানেই জয় হয়। বিজেপির এই কৌশলে কাজ হয়েছে।এখন বিজেপির প্রভাব কম আছে এমন রাজ্য যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওডিশা,
তামিলনাড়ু বা কেরালায় একটা পথের সন্ধান পেয়েছে দলটি। প্রকৃত অর্থে একটি ‘জাতীয়’ দল হিসেবে হয়ে ওঠার জন্য এটা অপরিহার্য। মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে মোদি হাওয়া জাতীয়ভাবেই কাজ করেছে। তবে বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে সেই হাওয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে পারেনি বিজেপি। আর সে কারণেই মোদি হাওয়ার প্রভাব কাজে লাগিয়ে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল, ভালো নেতৃত্বহীন হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে বড় জুয়া খেলে দলটি। এই ছকের মূল পরিকল্পনাকারী বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার পরীক্ষায় তাঁর ছক যেভাবে কাজে দিয়েছে, তাতে তিনি পুরস্কার পেতে পারেন। তবে দুটি রাজ্যের ক্ষেত্রেই সতর্কতার সঙ্গে একটি বিষয় খেয়াল রাখার মতো। হরিয়ানায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি এবার ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে, লোকসভার নির্বাচনের চেয়ে তা দেড় শতাংশ কম। আর মহারাষ্ট্রে একক বৃহত্তম দল হলেও বিজেপি মোট ভোটের ২৯ শতাংশ পেয়েছে। অর্থাৎ, ৭১ শতাংশ ভোটার সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতির সঠিক বাস্তবায়ন না হলে এ রাজ্যে ভবিষ্যতে ভালো ফল করা দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। মহারাষ্ট্রের ফলাফল দেখে পাঞ্জাব ও অন্ধ্র প্রদেশের বিজেপির সহযোগী দলগুলো খুশি হতে পারে।
তবে হরিয়ানার ফলাফল আসাম, পশ্চিমবঙ্গ বা ওডিশার ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর জন্য ভীতিই সৃষ্টি করবে। হরিয়ানায় কংগ্রেস ও লোকদলের মতো প্রধান সারির দুই দলকে ধরাশায়ী করার ঘটনা আরও অন্য যেকোনো রাজ্যে ঘটতে পারে। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপির সাম্প্রতিক সাফল্যে অমিত শাহ যে ওই রাজ্য দুটিতে তাঁর আক্রমণ আরও শাণিত করবেন, তা বলা বাহুল্য। তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে ও ডিএমকের মাঝে একটি গ্রহণযোগ্য তৃতীয় শক্তি হওয়ার চেষ্টায়ও থাকবে দলটি। দুই রাজ্যে বিজেপির বিজয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সেখানে নির্বাচনী প্রচারণায় সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার বাদ দিয়ে দলটি ‘উন্নয়নকেই’ মূল ইস্যু করেছিল। সদ্য সমাপ্ত উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা কাজে লাগেনি বলেই কি মোদি ও অমিত শাহ সেই পথ পরিহারের পথে হাঁটছেন? নাকি যোগী আদিত্যনাথের বিভক্তি আর ঘৃণা ছড়ানোর পথে আবার ফিরে আসবেন? আরেকটি বিষয়, দুই রাজ্যে বিজেপির বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘অবিসংবাদিত’ নেতা হিসেবে তুলনা করেছেন অমিত শাহ।

No comments

Powered by Blogger.