রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সংশয়

বাংলাদেশের আগামী দিনের অর্থনীতিতে ৩টি সমস্যা ও ৪টি প্রধান ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও তা টিকে থাকবে কতদিন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৬.২ শতাংশে আর মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির আপডেট-২০১৪’ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইউহানেস জাট, প্রধান অর্থনীতিবিদ সালমান জাইদি, রিসার্স এনালিস্ট নাদিম রিজওয়ান ও যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহরীন এ মাহবুব। প্রতিবেদনে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রধান ৪টি ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলো-রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশিপাশি ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে ধ্বস ও উচ্চমূল্যস্ফীতি, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া রপ্তানি খাতের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প ও মধ্যপ্রাচ্য শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। আর ৩টি সমস্যা -ব্যাংকের উচ্চ সুদ হার, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ধীর গতি ও বার্ষিক উন্নয়ন প্রোগ্রাম (এডিপি) মানসম্পন্ন না হওয়া। জাহিদ হোসেন বলেন, এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে অনিশ্চয়তা কাটেনি।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির এই অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে প্রভাব ফেললে অর্থনীতি ফের নেতিবাচক ধারায় যাবে বলে আশঙ্কা সংস্থাটির। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে, চাপে পড়তে পারে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। তৈরি পোশাক কারখানার সমস্যা ইউরোপের বাজারে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে এই শিল্পের পরিবেশ উন্নত করতে নেয়া পদক্ষপগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোর দুরবস্থাও আর্থিক খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সরকার ধরেছে ৭.৩ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এবার তা ৬.২ শতাংশে উন্নীত হবে বলে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস। এটা হলেও সন্তোষজনক। কৃষি খাতে ৩.৩ শতাংশ, শিল্প খাতে ৯.৫ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আভাস দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়বে ৬.৭ শতাংশ। সংস্থাটি মনে করে, এসবের কারণে এবার ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে ‘সস্তোষজনক’ উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ বলেন, বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির জন্য বর্তমানের ২৮ শতাংশ বিনিয়োগ (জিডিপির) ৩৪ থেকে ৩৫ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। অর্থবছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ৭.৪ শতাংশ হবে বলে আভাস দিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি কমতে পারে। জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমানে ২২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এটি খুবই সন্তোষজনক। এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে মুল্যস্ফীতি হবে ৭ শতাংশ, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি সঠিক পথেই আছে। বলা হয়েছে, প্রথম তিন মাসে রেমিটেন্স খাতে ২১.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা ভাল। রোজা ও কোরবানীর ঈদের কারণে অভ্যন্তরীণ খুচরা ব্যয় বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার দুই ঈদে মানুষ ব্যয় করেছে। বন্যা হওয়ার পরও শস্য উৎপাদন ভাল হয়েছে। জুলাই-আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় ভাল লক্ষণ। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১১.৪ শতাংশ হওয়াটা দুর্বলতার লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতির কথা তুলে ধরে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি ২০১৪ সালে দারিদ্র্যের হার ২৪.৪৭ শতাংশে নেমে আসবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। ২০১০ সালে ছিল ৩১ শতাংশ। দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নেও বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে। ২০১৩ সাল শেষে কর্মসংস্থান বেড়ে ৫ কোটি ৬৫ লাখে দাঁড়িয়েছে বলে সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ৬৬০ কোটি ডলারের ৩৬টি প্রকল্পের কাজ চলছে। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইউহানেস জাট তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্বব্যাংক বর্তমানে ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলোকে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে। তাছাড়া আগামীতে বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থায়ন ঘাটতি কিভাবে কমানো যায়, জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান কিভাবে করা যায় সে জন্য ক্লাইমেট চেঞ্জ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.