শোকের মাতম সিধুলীতে- ফিটনেস ছিল না দুই বাসেরই by ইসাহাক আলী

নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনায় কাঁদছে সিধুলী গ্রাম। স্মরণকালের ভয়াবহ এই সংঘর্ষে নিহত ৩৪ জনের মধ্যে ১৪ জনের বাড়ি গুরুদাসপুর উপজেলার এই সিধুলী গ্রামে। এর মধ্যে রয়েছে একই পরিবারের ৬ ভাই। এই পরিবারসহ পুরো গ্রামে চলছে শোকের মাতম। গোটা গ্রামে এখন কান্নার রোল। এর আগে এত লাশ দেখেনি গ্রামবাসী। কবরের সারি দেখে আঁতকে উঠছে গ্রামের মানুষ। পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায় গ্রাম্য দলাদলি নিয়ে আমির শাহ এবং পল্লী চিকিৎসক ইয়াদুল নামে দুই ব্যক্তি নিহত হন। এই মামলায় আসামি করা হয় রব্বেল (৬০), আয়নাল (৪০) আলাল (৫০), লাভু (৩৫) শরীফ (৩০), রায়হান (৬০), আলম (৫০), জাকির (৩৩) পিনু (৪৫), এবাদ (৭০), সোহরাব (৪৫), কোহির (৪২) ও জহিরকে (৫০)। সোমবার এ মামলায় হাজিরা দিতে তারা নাটোরের আদালতে যান। হাজিরা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন গুরুদাসপুরগামী অথৈ পরিবহনে করে। কিন্তু বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের রেজুর মোড়ে দু’টি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তাদের সবার মৃত্যু হয়। ধারাবারিষা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মতিন জানান, তারা হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। বাড়িতে নানা অশান্তি হতো ওই মামলা নিয়ে। তবু তারা বেঁচে ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনায় এক সঙ্গে ৬ ভাইয়ের মৃত্যু এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মামলার প্রতিপক্ষরাও এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। এ ছাড়া এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ওই গ্রামের প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান (৫৫) ও একই অফিসের সিও রেজাউল করিম (৪৮)। এর আগে ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর সিধুলী গ্রামে পৌঁছলে সেখানে কান্নার রোল পড়ে যায়। গোটা গ্রাম যেন শোকে পাথর।
এদের ১২ জনের জানাজা মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় এবং অপর দু’জনের জানাজা জোহরের নামাজের পর সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে হয়। স্থানীয় গোরস্থানে একই সঙ্গে ১২টি এবং অন্যপাশে দুটি কবরে পরে তাদের দাফন করা হয়েছে। নিহতদের জানাজার জন্য বাড়ি থেকে লাশগুলো স্কুল মাঠে নেয়ার সময় পুরো সিধুলী গ্রামে কান্নার রোল পড়ে যায়। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে জানাজায় আগত দুই উপজেলার হাজারো মানুষ তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। জানাজা পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় এমপি অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ, গুরুদাসপুর পৌরসভার মেয়র শাহনেওয়াজ মোল্লা। জানাজায় এলাকার সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ অংশ নেন। এখনও আরও দু’জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছে গ্রামবাসী।

নববধূর কাছে যাওয়া হলো না মাজদারের
বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে। স্ত্রীকে নিজের বাড়িতে উঠিয়ে আনা হয়নি, হয়নি বউ-ভাতের অনুষ্ঠান। বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন মাজদার। আগামী মাসের শেষদিকে বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। এরই মাঝে খবর আসে স্ত্রী নাজনীন অসুস্থ। তড়িঘড়ি করে ঢাকা থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জগামী কেয়া পরিবহনে চেপে স্ত্রীকে দেখতে রওনা হয়েছিলেন তিনি। বড়াইগ্রামের দুর্ঘটনায় নিহত হন মাজদার। তার সঙ্গে থাকা ঘনিষ্ঠ বন্ধু গুরুতর আহত আশফাকুর রহমান জানান, নতুন শ্বশুরবাড়ি একা একা যেতে ভাল লাগছিল না বলে ঢাকা থেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন মাজদার। পথে মোবাইলে স্ত্রী নাজনীনের সঙ্গে কয়েকবার কথাও বলেছেন তিনি। স্ত্রীর জন্য ঢাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র কিনেছিলেন। আশফাক জানান, আমি বেঁচে আছি, তা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। যার জন্য এলাম, সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এখন নেই এ কথা বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। মাজদারের শ্বশুরবাড়ির ঘনিষ্ঠ স্বজন চাঁপাই নবাবগঞ্জের আলতাব মাজহার জানান, জামাই আসবে বলে তাদের বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছিলেন। বিয়ের পর প্রথমবারের মতো জামাই আসবে বলে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা ছাড়াও বিশেষ আয়োজন ছিল, কিন্তু বিকাল ৪টার দিকে যখন দুর্ঘটনার খবর পৌঁছে তখন থেকে আনন্দ উবে গিয়ে নেমে আসে সুনসান নীরবতা। অসুস্থ নাজনীন এখন নির্বাক। সে নিথর তার নতুন জীবনের সাথিকে হারিয়ে। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে স্বজনরা।
দু’টি গাড়িই ছিল ফিটনেসবিহীন
নাটোরে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত গাড়ি দু’টি ছিল ফিটনেসবিহীন। ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে এই তথ্য পাওয়া গেছে। অথৈ পরিবহনের ফিটনেস ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৬ বছর আগে, আর কেয়া পরিবহনের মেয়াদ শেষ হয়েছে এক বছর আগে। এদিকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে এক লাখ টাকা ও আহতদের চিকিৎসার খরচ বহন করার ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে এ ঘোষণা দেন তিনি। পরে মন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আহতদের দেখতে বনপাড়ার আমেনা হাসপাতালে যান। সেখান থেকে তিনি একই পরিবারের ৬ জনসহ সিধুলী গ্রামে নিহত ১৪ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান। নাটোরের জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। সোমবারে ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহন রাজশাহীর দিকে যাচ্ছিল। বাসটির সামনে একই দিকে যাওয়া অপর একটি ট্রাককে ওভারটেক করে সামনে যাওয়ার সময় হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা অথৈ পরিবহনকে দেখতে পায়। পরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কেয়া পরিবহন সজোরে অথৈ পরিবহনকে আঘাত করে। এ সময় বিকট শব্দে বাস দু’টি মুখোমুখি সংঘর্ষের পর মহাসড়কের দুই পাশের দু’টি গর্তে ছিটকে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়।
সেতুমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ
কালিয়াকৈর (গাজীপুর): উপজেলার মৌচাক এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় কালে নাটোরের দুর্ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন সেতুমন্ত্রী। এ সময় তিনি এ দুর্ঘটনার জন্য অদক্ষ চালককে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ওই গাড়িচালক নিজে চালায়নি চালিয়েছিল গাড়ির মালিকের ছেলে। অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানোই ছিল দুর্ঘটনার মূল কারণ। একই পরিবারে ছয় জনের মৃত্যু তাকে প্রচণ্ড ভাবে ব্যথিত করেছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমি দুর্ঘটনা স্থল পরিদর্শন করেছি, সেখানে রাস্তায় কোন সমস্যা নেই, যথেষ্ট পরিমাণ প্রশস্ততাও আছে। বেপরোয়া ভাবে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে ওভারটেক করতে গিয়েই এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। মন্ত্রী নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে তুলে ধরে এ আন্দোলনে যুব ও তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
নাটোরে ব্যাপক প্রাণহানিতে ড. ইউনূসের শোক
নাটোরের বড়াইগ্রামে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, নাটোরে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় আমি গভীরভাবে মর্মাহত। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানাচ্ছি। একইসঙ্গে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত ও মহাসড়কে চলাচল নিরাপদ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.