রেহাই পাচ্ছে না নারী–শিশুও by আব্দুল কুদ্দুস ও গিয়াস উদ্দিন

পুরুষের পাশাপাশি হাজার হাজার নারী-শিশু ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছে। এদের বেশির ভাগ মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। একশ্রেণির দালাল রোহিঙ্গা মেয়েদের বিয়ের নামে কিংবা বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা ভালো চাকরির প্রলোভনে সমুদ্রে ঠেলে দিচ্ছে। কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর সৈকতসংলগ্ন ঝাউবাগানে মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার বসতি। এই বস্তির পুরুষের পাশাপাশি অসংখ্য মেয়েও সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছে।
সম্প্রতি এই বস্তিতে গেলে বস্তির সরদার (রোহিঙ্গা কমিটির সভাপতি) নুর মোহাম্মদ (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, এই বস্তিতে আট হাজারের বেশি ঝুপড়িঘরে বসত করছেন প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। পুরুষের পাশাপাশি এখন বহু রোহিঙ্গা মেয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছে। অনেকে যাত্রার পর নিখোঁজ রয়েছে।
স্থানীয় রোহিঙ্গারা জানায়, গত ২৪ আগস্ট রাতে এই বস্তির বেশ কয়েকজন মেয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। কিন্তু তারা মালয়েশিয়া পৌঁছেছে কি না, এ পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি। এ রকম এক মেয়ের বাবা খলিলুর রহমান বলেন, ‘খবর পেয়েছি, মেয়েটা থাইল্যান্ড কারাগারে আটক আছে। রোহিঙ্গা মেয়ে বলে বাংলাদেশের কারও সহযোগিতা পাচ্ছি না।’

>>মানব পাচার প্রতিরোধে কক্সবাজারের টেকনাফের খুরেরমুখ এলাকায় অস্থায়ী তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ l ছবি: প্রথম আলো
রোহিঙ্গা কমিটির সভাপতি নুর মোহাম্মদ বলেন, গত এক মাসে এই বস্তি থেকে পাঁচ শতাধিক পুরুষের পাশাপাশি ৬০ জনের বেশি রোহিঙ্গা মেয়ে মালয়েশিয়া গেছে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে সাগর শান্ত হলে ট্রলারে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য শতাধিক মেয়ে প্রস্তুতি নিয়ে আছে। স্থানীয় বাহারছড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল মনজুর বলেন, ‘দালালদের মাধ্যমে জেনেছি, অধিকাংশ মেয়েকে থাইল্যান্ড নিয়ে সেখানকার দালালদের হাতে তুলে (বিক্রি) দেওয়া হচ্ছে। সেখানে তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর শিশুদের তুলে দেওয়া হচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লুণ্ঠনকারী বিভিন্ন চক্রের হাতে। এ চক্রের সদস্যরা শিশুদের চোখের কর্নিয়া ও কিডনি তুলে নেয়।’
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোকতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে ৬০ জনের বেশি মহিলা দালাল রয়েছে। যারা গ্রামের গরিব, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের ফুসলিয়ে পুরুষ দালালের হাতে তুলে দিচ্ছে।
ওসি জানান, ইতিমধ্যে ২০ জন মহিলা দালালকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু টেকনাফের কয়েকটি স্থানেই দেড় লাখের মতো রোহিঙ্গা বসতি রয়েছে। দালালেরা রোহিঙ্গা মেয়েদের বিয়ের নামে মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছে।
মুঠোফোনে বিয়ে, তারপর...: রোহিঙ্গা নেতা নুর মোহাম্মদ বলেন, গত ২৩ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার জনৈক সাইফুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে বিয়ে হয় টেকনাফ ঝাউবনের রোহিঙ্গা নবী হোসেনের মেয়ের। বিয়ের আগ পর্যন্ত সাইফুলকে কেউ দেখেনি। চার মাস পর টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের দালাল ধলু হোসেন স্বামীর কাছে পাঠানোর নামে মেয়েটিকে একটি ট্রলারে তুলে দেন। এখন এলাকায় খবর রটেছে, লায়লা থাইল্যান্ড কারাগারে বন্দী।
এ প্রসঙ্গে ধলু হোসেন বলেন, পুরুষের পাশাপাশি বহু মেয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছে। অনেকে ধরা পড়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড কারাগারে বন্দী রয়েছে। মানব পাচারের অভিযোগে এই ধলু হোসেনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ১২টির বেশি মামলা রয়েছে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর ঝাউবনে এই মেয়েটির দাদির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ঝাউবন বস্তির এই ঝুপড়িতে মেয়েরা মোটেও নিরাপদ নয়। তাই অনেকে মেয়েদের ঝামেলা মনে করে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের অন্য কোনো উপায়ও নেই।
বিপাকে বাংলাদেশিরা: টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা খোরশিদা বেগম বলেন, ট্রলারে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে তিনি দুবার ধরা পড়েন। কিন্তু তাঁকে কখনো কারাগারে যেতে হয়নি। টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর আগে-পরে বহু মেয়ে সমুদ্রে নেমে নিখোঁজ রয়েছেন। অনেকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কারাগারে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন।
কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লে. কাজী হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে কোস্টগার্ড সদস্যরা সেন্ট মার্টিন সাগর থেকে ২১১ যাত্রী বোঝাই দুটি ট্রলার জব্দ করেন। যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে, মিয়ানমারের ২০ জন নারী ও ১৭ শিশু। টেকনাফের ঝাউবন থেকে এই রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে ট্রলারে তোলা হয়।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী আয়াছুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের পাহাড়-জঙ্গলে অবৈধভাবে বসতি করছে মিয়ানমারের চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। অভাবের কারণে রোহিঙ্গারা মেয়েদের স্থানীয় লোকজনের বাসাবাড়িতে অথবা চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় গিয়ে বিপদে পড়ছে। বিপদে পড়লে তারা বলে বাংলাদেশি। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, অরক্ষিত সাগর উপকূল দিয়ে মানব পাচার বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া সাগরে নেমে মানব পাচার প্রতিরোধ করার মতো জলযান আর জনবল কোনোটাই পুলিশের নেই।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কক্সবাজার সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খোন্দকার ফরিদ হাসান বলেন, মানব পাচার বন্ধে বিজিবি উখিয়ার রেজু খালে স্থায়ী একটি ফাঁড়ি বসিয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে এই খাল দিয়ে মানব পাচারের সময় দালালদের দুটি ট্রলার জব্দ করেছে। কিন্তু প্যারাবনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মগোপন করায় দালালসহ যাত্রীদের ধরা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া টেকনাফে বিজিবির স্থায়ী ফাঁড়ি স্থাপনের পাশাপাশি মানব পাচার ঠেকাতে উপকূলজুড়ে বিজিবির টহল বাড়ানো হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.