বিএনপির শক্তি তৃণমূল by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

দৃশ্যত ৫ জানুয়ারি দেশে যে নির্বাচন হয়েছে এটা আসলে কোনো নির্বাচন না। এ নির্বাচনে একটি মাত্র ভোট পড়ার আগেই নির্বাচিত হয়েছে পরবর্তী সরকার। এই নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ হয়নি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। এই নির্বাচনে ভোট দেননি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি ও বিরোধীদলীয় নেতা। কারণ তাদের এলাকায় ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই নির্বাচনে ভোট দেননি দেশের অনেক খ্যাতিমান মানুষ। কারণ তারা বিবেকের কাছে বন্দী। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই নির্বাচনী তামাশা নীরবে সহ্য করতে হয়েছে জাতিকে। তবে ১৯৯০-এর পরের প্রজন্ম, অর্থাৎ আজকে যাদের বয়স ২০-২৫, স্বৈরাচারী শাসন কি তারা তা দেখেনি; কিন্তু বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে সেটি তারা প্রত্য করছে, অর্থাৎ আজকের প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগ সরকার একটি স্বৈরাচারী সরকার হিসেবে পরিচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ আওয়ামী রাজনীতির জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। কাজেই এখনো সময় আছে সংশোধন হওয়ার এবং পরিস্থিতি অনুধাবন করার, সময় আছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়ার এবং একটি পপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার। মনে রাখা ভালো, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব শক্তিশালী মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি হয়ে যেতে পারেন দুর্বলতম মানুষ। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও সম্ভবত শক্তিশালী মানুষ মনে হয়। তিনি রাজনীতি নিয়ে একতরফা খেলে যাচ্ছেন অবলীলায়। তার রাজনৈতিক দাপটের কাছে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকাও অসহায়, অসহায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অসহায় প্রতিপ রাজনৈতিক দলও। বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের পাইকারি হারে জেলে নিয়ে তিনি তার মতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন দেশবাসীকে। দেশে সর্বগ্রাসী সঙ্কট, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, রেল মন্ত্রণালয়ের কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারিসহ আরো অসংখ্য কেলেঙ্কারি ও নজিরবিহীন দুর্নীতি এবং সীমাহীন ব্যর্থতার পরও প্রধানমন্ত্রী অনায়াসে সরকার চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে এটি একটি নজির বলা যায়; কিন্তু জনগণের খেলার কাছে কোনো খেলাই দাঁড়াতে পারে না। জনগণের খেলা যখন শুরু হবে, তখন দেখা যাবে কত ধানে কত চাল।
বাংলাদেশের সরকারপ্রধান অসীম মতাধর। তাদের ধারে কাছের মানুষও মতার স্পর্শ পেয়ে বদলে যান। তারা হয়ে ওঠেন দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বেচ্ছাচারী। তাদের গাম্ভীর্য বাড়ে, চেহারায় পরিবর্তন আসে; হয়ে ওঠেন অঢেল অর্থসম্পদের মালিক; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, মতা ছাড়ার আগেই তাদের দেশ ছাড়তে হয়। বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ধারে কাছের বহু লোক এখনো দেশ ছাড়া। দেশে এখনো দুর্নীতির জয়জয়কার চলছে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতিবাজদের অবাধে দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে ফ্রি স্টাইলে দুর্নীতি হচ্ছে না। নজিরবিহীন ও সীমাহীন দুর্নীতিতে অর্জিত টাকা বিদেশে নির্দ্বিধায় পাচার হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বের হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ার থেকে প্রায় ৩৩ লাখ ুদ্র বিনিয়োগকারীর প্রায় এক লাখ কোটি টাকা শেয়ারমার্কেট থেকে লুট করে নিয়ে গেছে লুটেরা ব্যবসায়ীরা। কুইক রেন্টাল নির্ভর জ্বালানিনীতি সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে নিচ্ছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ। ঘরে ঘরে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল আসছে। কয়েক মাস আগেও যে পরিমাণ বিল হতো এখন তা দ্বিগুণ, তিন গুণ হয়েছে। কোনো কোনো গ্রাহকের বিল দাঁড়িয়েছে চার-পাঁচ গুণ। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক ও নানা প্রশ্ন। এ ব্যাপারে বিএনপিকে সোচ্চার হতে হবে এবং রাখতে হবে কার্যকর ভূমিকা।
সরকারের গণবিরোধী কাজে গণমাধ্যম সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা পালন করায় শাসকগোষ্ঠী ভীষণ ুব্ধ। নতুন নীতিমালার নামে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার প্রক্রিয়া চলছে। সরকারকে বলি, গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হয়ে লাভ নেই। কারণ গণমাধ্যম সরকারকে পরোভাবে সাহায্যই করছে। সমাজে যা কিছু ঘটে, তা গণমাধ্যমকে অনিবার্যভাবেই প্রভাবিত করে। ইদানীং সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তব যা কিছু ঘটছে, তার সত্য ও সহজ-সরল প্রতিচ্ছবিই গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে আরো সক্রিয় হতে হবে। রাজপথে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিদিন কোনো-না-কোনো কর্মসূচি তালিকায় থাকতে হবে। নির্দলীয়-নিরপে সরকারের অধীনে একটি পপাতহীন, অবাধ, সুষ্ঠু মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করা এখন বিএনপির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই জন্য বিএনপিকে মাঠের রাজনীতিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এ েেত্র নির্লিপ্ততা বিএনপির রাজনীতির জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। লণ দেখে মনে হচ্ছে সরকার আরো বেপরোয়া হবে, অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন চালাবে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অকারণে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার করে চরম হেনস্তা করবে। তাতে ভয় পেলে চলবে না। মানুষের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে যেকোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হবে কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ। তখন পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা ভাবাই শাসকদলের জন্য সমীচীন। কাজেই শাসকদলকে জনগণের চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ লোক দেখানো ও আঙুল হেলানো গণতন্ত্র পছন্দ করে না। তারা গণমাধ্যমের ওপর কোনো খরবদারি মেনে নেবে না, মেনে নেবে না আইনের শাসনের ওপর কোনো অযাচিত হস্তপে; মেনে নেবে না প্রতিবাদের ভাষা স্তব্ধ করে দেয়ার মতো কোনো আইন।
বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে এক যুগ সন্ধিণে দাঁড়িয়ে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও অস্থিরতা বিরাজমান। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেকোনো দিকে ঘুরে যেতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে দেশে এক বেদনাবহ পরিস্থিতির, যা মোকাবেলা করার মতা বর্তমান সরকার রাখে না; কেননা বর্তমান সরকার প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং জনসমর্থন অতিসামান্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সরকারের অবস্থান দুর্বল। সুতরাং বাংলাদেশের বর্তমান প্রোপটে দরকার একটি জনবান্ধব শক্তিশালী সরকারের, যা সম্ভব হতে পারে সব দলের অংশগ্রহণে একটি পপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে। এ বাস্তবতা শাসকদল যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবে, ততই দেশের মঙ্গল হবে; মঙ্গল হবে মতাসীন দলেরও।
belayete_1@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.