চাঁপাইনবাবগঞ্জ- অভিভাবকহীন আওয়ামী লীগ বিএনপিতে দ্বন্দ্ব by মো. তারেক রহমান

চাঁপাই নবাবগঞ্জে অভিভাবকহীন অবস্থায় আছে আওয়ামী লীগ। প্রকাশ্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব না থাকলেও সংসদ সদস্যদের দাপটে কোণঠাসা দলীয় নেতাকর্মীরা। অপরদিকে একক অধিপাত্য বিস্তার করে রাখায় বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি জেলা বিএনপিতে। আর তাই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। জাতীয় পার্টির অবস্থা আরও শোচনীয়। জাসদের কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অপরদিকে কোণঠাসা হয়ে থাকার পরও বর্তমানে মাঠে রয়েছে জামায়াত। ২০ দলীয় জোটের অংশ হিসেবে জেলায় শক্তিশালী দল হিসেবে চিহ্নিত বিএনপি-জামায়াত। তবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর ফাটল দেখা দেয় বিএনপি-জামায়াত শিবিরে। জেলার ৩টি আসন দীর্ঘদিন থেকে দখলে ছিল বিএনপি-জামায়াতের। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই আসনগুলো তাদের হাতছাড়া হয়ে আওয়ামী লীগের ঘরে চলে যায়। তবে উপজেলা নির্বাচনে ৫টি উপজেলার ৪টিই এখন বিএনপি-জামায়াতের হাতে। আওয়ামী লীগ: আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখানে শুরু হয় পরিবারতন্ত্র। শুধু তাই নয়, বিগত সংসদ সদস্যদের মতো মন্ত্রীর সুবিধাভোগী সহচররা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনাসমজিদ বন্দরকে কুক্ষিগত করে নেয়। ফলে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকে আতঙ্কের জনপদ হয়ে উঠে শিবগঞ্জ। আওয়ামী লীগের ১০ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান এখানে সন্ত্রাসীদের গুপ্ত হামলায়। হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া হয় প্রায় ২ শতাধিক নেতাকর্মীর। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করে শতাধিক মানুষ। এমনকি সে সময় খোদ মন্ত্রী নিজেও নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রবেশ করতে পারেননি নিরাপত্তার আশংকায়। পরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিশাল বহর নিয়ে আসেন তার নির্বাচনী এলাকায়। আতংকিত নেতাকর্মীরা বাধ্য হয়ে শিবগঞ্জ ছেড়ে আস্তানা গাড়েন বিভিন্ন জায়াগায়। একপর্যায়ে আস্থা হারিয়ে ফেলে দলীয় নেতাকর্মীরা। প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক পরিস্থিতি প্রতিকূল বিবেচনা করে বিগত দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা না নিয়ে গুটিয়ে নেন নিজেকে। সেই থেকে তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকায় এসেছেন হাতেগোনা মাত্র কয়েকবার। জেলা সভাপতি হয়ে বর্তমানে তিনি সপরিবারে ঢাকায় অবস্থান করায় অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। অস্তিত্ব বাঁচাতে আওয়ামী লীগ নামে নতুন মুখের সন্ধানে। অবশেষে লুফে নেন কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানীকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চাঁপাই নবাবগঞ্জ-১ আসনের মানুষের মাথার ওপর থেকে কালো মেঘ সরে যায়নি। অভিযোগ আছে অস্তিত্ব বাঁচাতে তিনিও আঁতাত করেছেন স্থানীয় গুটি কয়েক নেতার সঙ্গে। নেতাকর্মী সূত্রে জানা গেছে, সোনামসজিদ স্থলবন্দরের অর্থ ভাগবাটোয়ারাকেই কেন্দ্র করে দুই এমপি’র মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরমে। এ কারণে দুই মন্ত্রীসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার অংশগ্রহণে জেলায় অনুষ্ঠিত কোন জনসভা বা ঘরোয়া আলোচনায় একসঙ্গে বসতে পারেনি তারা। এছাড়া আওয়ামী লীগের একাংশের নেতৃত্বে রয়েছেন চাঁপাই নবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল ওদুদ। আর অপর অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মঈনুদ্দীন মণ্ডল এবং সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দলের কোন্দলের বিষয়টি স্বীকারও করছেন সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওদুদ নিজেই। ফলে এমপি কেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। চাঁপাই নবাবগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস গ্রুপের ভূমিদস্যু কয়েকজন নেতাকর্মী আদিবাসী নেত্রীর ওপর হামলা চালায়। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় তারা ওই ওই নেত্রীর শ্লীলতাহানিও করে। এ ঘটনায় জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকজন এমপি নেত্রীর পাশে এসে দাঁড়ালেও সমবেদনাও জানাতে আসেনি এমপি গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস। বিতর্কিত হন এমপি। বিএনপি: বিএনপিতে আছে পাল্টাপাল্টি কমিটি। অন্যদিকে রয়েছে প্রকাশ্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। একক অধিপত্য বিস্তার করে রাখায় বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি জেলা বিএনপিতে। আর তাই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশিদ আর তার স্ত্রী জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আশিফা আশরাফি পাপিয়ার কারণে অনেক ত্যাগী নেতা নীরবে-নিভৃতে সরে গেছেন দল থেকে। নবম সংসদে সংরক্ষিত মহিলা এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে কোন্দল আরও বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে জেলায় রয়েছে হারুন-পাপিয়া গ্রুপ ও কেন্দ্রীয় যুবদলের কোষাধ্যক্ষ আলহাজ আমিনুল ইসলামের আমিনুল গ্রুপ। সদরে জেলা যুবদলের আমিনুল গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে পাঠান-তারিফ, অপর অংশে রয়েছে হারুন-পাপিয়া সমর্থিত সাদিউল ইসলাম রঞ্জু গ্রুপের কমিটি। এছাড়া কয়েকটি উপজেলায় রয়েছে হারুন-পাপিয়া আর আমিনুল হাজীর পাল্টাপাল্টি কমিটি। বিগত ৩ বার সদর আসনে বিএনপি’র সংসদ সদস্য ছিলেন হারুনুর রশিদ। তাই বিএনপি’র এমপি হিসেবে তার আসন নির্ধারিত। এ অবস্থায় নবম সংসদ নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হওয়ার জন্য দলীয় টিকিট দাবি করেন আশিফা আশরাফি পাপিয়া। একই আসনে প্রার্থিতা দাবি করেন কেন্দ্রীয় যুবদলের কোষাধ্যক্ষ আলহাজ আমিনুল ইসলাম নিজে। সেই থেকে হারুন-পাপিয়া আর আমিনুল হাজীর দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। এছাড়া সম্প্রতি পাপিয়া জামায়াতকে ‘ইসলামের অপব্যবহারকারী’ উল্লেখ করায় বিএনপি-জামায়াত জোটে দেখা দেয়া নতুন সংঘাত। পাপিয়া নিজেও দীর্ঘদিন ধরে দলের কাছে চাঁপাই নবাবগঞ্জ-২ আসনে প্রার্থিতা চেয়ে হতাশ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নাটোরে এক জনসভায় আসাদুল হাবিব দুলুর আসনে নিজে প্রার্থী হওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করায় দল থেকে শোকজ করা হয়েছিল তাকে। দীর্ঘদিন দলে কোণঠাসা ছিলেন তিনি। তাছাড়া চাঁপাই নবাবগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল ওদুদ। তিনি পাপিয়ার স্বামী হারুনের চাচাত ভাই। আবদুল ওদুদ একসময় বিএনপি করতেন এবং হারুনকে নির্বাচনে জয়ী করানোর জন্য তার তৎপরতা ছিল উল্লেখ করার মতো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৬ সালেই প্রথম এমপি নমিনেশন পান হারুনুর রশিদ। সেবারেই তিনি জয়ী হন। পরে ২০০১ সালে তৎকালীন ৪ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নমিনেশন পান তিনি। তখন জামায়াত তাকে মেনে না নিয়ে দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিএনপি এবং জামায়াতের আলাদা প্রার্থী এবং আলাদাভাবে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের দাবি করে। তবে জেলা জামায়াত তাদের প্রভাব ধরে রাখতে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ধরে রাখতে না পারলেও হারুনকে ছাড় দেয়নি। ফলে দেয়াল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লতিফুর রহমানকে প্রার্থী দাঁড় করায়। ২০০৮-এর নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটে চাঁপাই নবাবগঞ্জ-৩ এবং ১ আসনে। সঙ্গত কারণেই জামায়াতই প্রধান শত্রু হিসেবে দাঁড়ায় পাপিয়ারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঈনুদ্দীন মণ্ডল জানান, সভাপতি নেই তো কি হয়েছে। আরও ১০ জন সহ-সভাপতি আছেন। সুতরাং সভাপতি না থাকলেও আমাদের কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমাদের জেলা কাউন্সিল হবে। তখন বিষয়টির সুরাহা হয়ে যাবে। আর সদর আসনের এমপির সঙ্গে বিরোধের বিষয়ে তিনি জানান, আমার সঙ্গে কারও কোন বিরোধ নেই। চাঁপাই নবাবগঞ্জ বিএনপি সভাপতি অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়া জানান, চাঁপাই নবাবগঞ্জ বিএনপিতে কোন দ্বন্দ্ব নেই। বিএনপি গত ২২ তারিখের হরতালে মাঠে ছিল। জেলা শহরে তো মাঠে থাকার কথা। আর আমি তো শিবগঞ্জে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রতিদিন গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। জেলা জামায়াতের আমির নজরুল ইসলাম জানান, আমরা আমাদের মতো যুগপৎ আন্দোলন করছি। 

No comments

Powered by Blogger.