স্বামীকে বাসায় ডেকে খুন

রাজধানীর মিরপুরে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করে নিজ বাসায় হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার আগে বাসার বাইরে থাকা ওই ব্যক্তিকে বাসায় ডেকে নিয়েছিলেন স্ত্রী। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, স্ত্রীর পরকীয়ার কারণেই তিনি খুন হয়েছেন। তাকে পরিকল্পিতভাবে স্ত্রীর প্রেমিকসহ কয়েকজন হত্যা করেছে। নিহত ব্যক্তির নাম গিয়াস উদ্দিন (৩৬)। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী লাভলি ইয়াসমিন লিনা (২৮)-কে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের লাশ দাফন করা হয়েছে। রোববার রাত সাড়ে ১১টার পর মিরপুর-১০ নম্বরের সি ব্লকের ১৫ নম্বর লেনের নিজের ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলার বাসা থেকে গিয়াস উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সূত্র জানায়, রাত ১১টার দিকে গিয়াস উদ্দিনের ৯ বছর বয়সী কন্যা ইশিকা আক্তার সুমি প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে জানায়, তাদের ঘরে ডাকাত এসেছে। ডাকাতরা তার বাবাকে মেরেছে। তাৎক্ষণিকভাবে ওই বাসার গৃহকর্ত্রী গিয়াসের বাসায় গিয়ে দেখতে পান রক্তাক্ত গিয়াস বাসার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছেন। পাশে তার স্ত্রী বসে আছেন। ঘরের মেঝে রক্তে ভিজে গেছে। তিনি চিৎকার করলে নিচতলা থেকে গিয়াসের স্বজনরা ছুটে যান। এ সময় গিয়াসের স্ত্রী লিনা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। প্রথমে মিরপুর ৬-এর আজমত হাসপাতাল পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক গিয়াসকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের শরীরে বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। এর মধ্যে মাথায় একটি আঘাত ছিল। যা প্রায় এক ইঞ্চি গভীর। এছাড়া তার বাম হাতে কামড়ের চিহ্ন রয়েছে। লাশ উদ্ধারের সময় নিহতের গলায় ওড়না ও বুকে কাপড় বাঁধা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, গিয়াসকে হত্যার আগে তার হাত পেছন থেকে বেঁধে রাখা হয়। এছাড়া গলায় ওড়না  পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। এছাড়া তার হাতের কামড়টি তার স্ত্রী লিনার না অন্য কারও তা নির্ণয়ের জন্য ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনার সময় বাসায় ছিলেন গিয়াস উদ্দিনের স্ত্রী লিনা ও তার দুই শিশু সন্তান। এর মধ্যে গিয়াস উদ্দিনের বড় সন্তান ইশিকা জানায়, তিন-চার যুবক তাদের দুই ভাই-বোনকে বাসার একটি কক্ষে আটকে রেখেছিল। তাদের মা লিনা কোথায় ছিলেন তা তারা স্পষ্ট করে জানাতে পারেনি। লিনা দাবি করেছেন, কিলাররা তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছিল। তিনি এই খুনের সঙ্গে জড়িত নন। 
মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমানুর হোসেন বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে তিন থেকে চার যুবক ঘরে ঢুকে গিয়াসকে হত্যা করেছে। তবে তার শরীরের খামচি ও কামড়ের আঘাতও রয়েছে। কামড় ও খামচি তার স্ত্রী লিনার কিনা এজন্য ডিএনএ টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করার জন্য স্ত্রীর পরকীয়া ছাড়া পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আজ লিনাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হবে বলে জানান তিনি।
হত্যাকাণ্ডের আগে রাত সাড়ে ১০টার দিকে গিয়াস উদ্দিন তার বাসার নিচে আল-আমিন সমিতির অফিসে বসা ছিলেন। এসময় তার স্ত্রী লিনা মোবাইল ফোনে জানান, বাসায় মেহমান এসেছে। পোলাও’র চাল ও পানীয় নিয়ে যেতে বলেন গিয়াসকে। নিচতলার মুদির ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন জানান, তার দোকান থেকে পোলাও’র চাল নিয়ে বাসায় যান গিয়াস। এর পরেই এই ঘটনা ঘটে। আনুমানিক ১১টার দিকে ওই বাড়ি থেকে বোরকা পরা একজনকে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন আশপাশের লোকজন। প্রতিবেশীদের বরাত দিয়ে নিহতের মেজো ভাই মাসুদুর রহমান জানান, ওই বোরকা পরা লোকের পায়ে লাল রঙের কেডস ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর তা লক্ষ্য করেন আশপাশের লোকজন। ধারণা করা হচ্ছে বোরকা পরা লোকটি কিলারদের একজন। মাসুদুর রহমান আরও জানান, ঘটনার দিন রাত ৮টায় গিয়াস বাসায় এসেছে কিনা দেখতে ওই বাসায় যান তার মা। এসময় বাসার ভেতরে দরজার পাশে এক জোড়া জুতা দেখে তিনি জানতে চান, এটি কার জুতা? তখন লিনা জানান, এটি গিয়াস উদ্দিনের পুরনো জুতা। ওই সময়ে বাসার দু’টি ঘুমানোর কক্ষের দরজা বন্ধ দেখে তিনি জানতে চান, কক্ষ দুটি বন্ধ কেন? লিনা জানান, এসি ছাড়া হয়েছে এজন্য তা বন্ধ রাখা হয়েছে। এসময় গিয়াস-লিনা দম্পতির পাঁচ বছর বয়সী পুত্র নেহাল তার দাদুকে এসি কক্ষে নিয়ে যেতে বললে তাকে ধমক দেন লিনা। দীর্ঘ প্রায় দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত ওই বাসায় ছিলেন গিয়াস উদ্দিনের মা। ওই সময়ের মধ্যে একবারও লিনা তার শ্বাশুড়ির সামনে থেকে অন্যত্র যাননি। গিয়াস উদ্দিন নিয়মিত তার মায়ের ওষুধ কিনে আনতেন এবং নিজে খাওয়াতেন। ওষুধ সংক্রান্ত কাজেই গিয়াসের মা তার  খোঁজে ওই বাসায় যান। সূত্র জানায়, উজ্জ্বল নামে মিরপুর ১১-এর বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে লিনার। একাধিকবার লিনাকে বিভিন্ন স্থানে উজ্জ্বলের মোটরসাইকেলে আরোহী হিসেবে দেখা গেছে। এমনকি প্রায় পাঁচ বছর আগে নির্জন বাসায় লিনার কক্ষে উজ্জ্বলকে দেখতে পান গিয়াস উদ্দিনের বোন শাহিদা। এ নিয়ে তখন লিনা ও গিয়াসের পরিবারের লোকদের মধ্যে সালিশ-বৈঠক হয়। লিনা তখন প্রতিশ্রুতি দেন যে ভবিষ্যতে তিনি আর এমন কিছু করবেন না। প্রায় ১১ বছর আগে মিরপুর ১১-এর বাসিন্দা লিয়াকত মোল্লার কন্যা লাভলি ইয়াসমিনের সঙ্গে বিয়ে হয় গিয়াস উদ্দিনের। বিয়ের কয়েক বছর পরেই গিয়াস ও তার পরিবারের লোকজন জানতে পারেন বিয়ের আগে উজ্জ্বল নামে এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল লিনার। তার অমতেই গিয়াসের সঙ্গে তাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। গিয়াস-লিনা দম্পতির সংসারে ইশিকা ও  নেহাল নামে দুই শিশু সন্তান রয়েছে। মিরপুর-১০ বি-ব্লকের নেহাল গার্ডেনে গিয়াস সুতার ব্যবসা করতেন। নিহত গিয়াস উদ্দিনের পিতা ওই এলাকার বাসিন্দা সিরাজ মাতব্বর। গিয়াসসহ তারা চার ভাই ও চার বোন। গতকাল সন্ধ্যায় সেনপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে নিহতের লাশ দাফন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.