পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ by নুরুজ্জামান লাবু

একের পর এক ঘটছে খুনের ঘটনা। আপনজনের হাতেই খুন হচ্ছে আপনজন। নিজের পরিবারের সদস্যরাই হয়ে উঠছে ঘাতক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে আসা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে আশঙ্কাজনক হারে একের পর এক ঘটে চলছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে খুন করতে দ্বিধা করছে না কেউ। স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে। ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছে ভাই, সন্তানের হাতে খুন হতে হচ্ছে মা-বাবাকে। আবার নিজ সন্তানকেও হত্যা করতে হাত কাঁপছে না বাবা-মায়ের। এক ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশজুড়ে। ক্রমবর্ধমান পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইনি প্রক্রিয়ায় বিলম্বসহ প্রশাসনকি কাঠামোর নানা দুর্বলতা সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে পারিবারিক অনুশাসন। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। তা না হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
পুলিশের সাবেক আইজিপি এ এস এম শাহজাহান বলেন, পারিবারিক বন্ধন এমন দুর্বল হয়ে গেছে যে পারিবারিক অনুশাসন এখন আর কেউ মানতে চায় না। এ কারণে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে। তিনি বলেন, এই বন্ধন সুদৃঢ় করতে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, পারিবারিক হত্যাকাণ্ড কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মাদকাসক্ত সন্তান বাবা-মা বা ভাইবোনকে হত্যা করছে। এক্ষেত্রে মাদক নির্মূল করতে পারলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। এ ছাড়া পারিবারিক কোন ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে থানা পুলিশ আমলে নিয়ে সমাধান বা আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সমাজে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়ছে পরিবারে। এ কারণে আপনজনেরাই হয়ে উঠছে ঘাতক। সামপ্রতিক নানা ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দাম্পত্য ও পারিবারিক কোন্দল দ্রুতই গড়াচ্ছে সহিংসতার দিকে। হত্যাকাণ্ডের ধরনও পাল্টেছে। পারিবারিক বিরোধের শিকার বেশি হচ্ছে নারী ও শিশু। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের কোন না কোন স্থানে এমন ঘটনা ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক হত্যাকাণ্ড বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ মাদক ও পরকীয়া। এ ছাড়া যৌতুক, সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, সমাজ পরিবর্তনের অসুস্থ ধারা, অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিবর্তনসহ নানা কারণেও অসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এরই প্রকাশ ঘটছে সহিংসরূপে। সর্বোপরি এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতাকেও দায়ী করেছেন অনেকে। 
বিশিষ্ট কলামনিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতার প্রবণতা বেড়ে গেছে। মানুষের মন থেকে স্নেহ-মায়া-মমতা ও সুকুমার বৃত্তি লোপ পাচ্ছে। এ কারণে পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, ঘরের ভেতর প্রিয়জনের হাতেই আরেক প্রিয়জন যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে তার জন্য দায়ী আমাদের সমাজ। আমাদের সমাজই এই হত্যাকারীদের তৈরি করেছে। তাই যতদিন সমাজের চরিত্র পরিবর্তন না ঘটানো যাবে বা মূল্যবোধের পরিবর্তন না ঘটানো যাবে ততদিন এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ সাবেক আরেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, সমাজে বৈষম্য বেড়ে যাওয়া আর মানুষের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে অন্যরা উৎসাহিত হয়। মোট কথা পারিবারিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে সামগ্রিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
এদিকে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। সাধারণত পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের আগাম কোন তথ্য হাতে থাকে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে। এ কারণে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড  রোধে আগাম কোন পদক্ষেপ নিতে পারে না তারা। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে যে সব হত্যাকাণ্ড ঘটছে তার বেশির ভাগই পারিবারিক হত্যাকাণ্ড। পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পারিবারিক হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র বিরোধী অভিযান ও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানারকম কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের পরপরই দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও জোর দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশকে আরও বেশি জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। মানুষ যেন নিজেরা আইন হাতে তুলে না নিয়ে সহজেই আইনি সুবিধা পায় সেই প্রচেষ্টা চলছে। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, পরিবার ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ভেঙ্গে পড়ায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে অপরাধ করে কেউ যেন পার না পায় সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। অপরাধ করে অপরাধী পার পেয়ে গেলে সমাজে খারাপ প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা দূর করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.