মর্মান্তিক- নাটোরে বাস দুর্ঘটনায় নিহত ৩৪ by ইসাহাক আলী

মর্মান্তিক আর মর্মন্তুদ। মুহূর্তেই সব শেষ। নাটোরের বড়াইগ্রাম। দু’টি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ। সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারালেন কমপক্ষে ৩৪ জন। আহত হয়েছেন অর্ধশত। দুর্ঘটনায় এ প্রাণহানিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সর্বত্র। শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি  চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহন ও নাটোর থেকে ছেড়ে যাওয়া গুরুদাসপুরগামী যাত্রীবাহী লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। আহতদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নাটোর ফায়ার সার্ভিস, হাইওয়ে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের বড়াইগ্রাম মোড়ের আগে রেজুর মোড়ে কেয়া পরিবহন একই দিক থেকে আসা অপর একটি ট্রাককে ওভারটেক করার সময় লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। কেয়া পরিবহন বাসের পিছনে প্রাইভেটকারে থাকা বড়াইগ্রামের ব্যবসায়ী মাজেদুল ইসলাম নয়ন বলেন, বাস দু’টি মুখোমুখি সংঘর্ষের পর মহাসড়কের দুই পাশের দুটি গর্তে ছিটকে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ঘটনার সময় রাস্তা ও আশপাশে আহত এবং নিহতরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। এ সময় আহতদের আর্তচিৎকার ও দুর্ঘটনার শব্দে শ’ শ’ এলাকাবাসী উদ্ধার করতে ছুটে আসে। খবর পেয়ে নাটোর, লালপুর ও দয়ারামপুর ফায়ার সার্ভিস ও থানা এবং হাইওয়ে পুলিশ এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই গাড়ির চালকসহ ২৮টি লাশ উদ্ধার করে ট্রাকে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহতদের মধ্যে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি অজ্ঞাত আরও পাঁচজন বিকালে মারা যায়। আহতদের নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতাল, বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বনপাড়ার বেসরকারি আমিনা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মো. আবুল কালাম আজাদের ওপর একই দিন সকালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার প্রতিবাদে কর্মবিরতিতে থাকা এসব হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রশাসনের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে আহতদের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসেন। ঘটনার পরপরই নাটোর জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান, পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহতদের মধ্যে তাৎক্ষণিক কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক, আওয়ামী লীগ নেতা জামাল হোসেন (৪০), তার মেয়ে জান্নাতি (৫), একই উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের আলাল উদ্দিন, সংগ্রামপুরের আব্দুর রহমানের স্ত্রী আতিকা বেগম, খোকসা গ্রামের কৃষ্ণপদ সরকার (৫৫), ইন্দ্রপাড়া গ্রামের জান মোহাম্মদ (৪৮), গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলী গ্রামের এবাদ আলী (৪৫), শরীফ উদ্দিন (৩০), লাবু, (৩৫), আলাল (৫৫), সোহরাব হোসেন, আয়নাল হক (৩৫), সতের আলী প্রামাণিকের দুই ছেলে রব্বেল আলী (৪৫) ও  আতাহার আলী (৫০), বৃচাপিলা গ্রামের বাবুল (৪০), আবদুল আওয়াল (৩০), তেলটুপি গ্রামের মোহনা খাতুন (৫) এবং অথৈ পরিবহনের চালক আলম হোসেন (৪০)। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজশাহী মেডিকেলে মারা যান আহত আরেকজন। তার পরিচয় মিলেনি। দুর্ঘটনায় অথৈ পরিবহনের বেশির ভাগ যাত্রীই মারা গেছে। নাটোর জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান সন্ধ্যায় বলেছেন, ঘটনাস্থল থেকে ২২টি লাশ উদ্ধার করে বনপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। একই সময়ে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি ২০ জনের মধ্যে পাঁচজন এবং গুরুদাসপুর হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যুর খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সংঘর্ষে প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাটোরের অতিরিক্ত  জেলা ম্যাজিস্ট্রেট  মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটিতে রয়েছেন- নাটোরের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) এবং বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
হাসপাতালের চিত্র: এদিকে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. আবুল কালাম আজাদের ওপর একই দিন সকালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার প্রতিবাদে জেলার সকল হাসপাতালে চলছিল কর্মবিরতি। আহতদের আর্তচিৎকার আর স্বজনদের ভিড়ে হাসপাতাল গুলোতে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পরে প্রশাসনের অনুরোধে তাৎক্ষনিক আহতদের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসেন চিকিৎসকরা। নাটোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অন্তত ২০ জনকে। এদের মধ্যে মারা যান ৫ জন। আহতদের আর্তচিৎকার ও নিহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে এলাকা। এ সময় আহত অথৈ পরিবহনের বাস যাত্রী গুরুদাসপুরের সিধুলী গ্রামের সুরুজের ছেলে আব্দুস সাত্তার বলেন, আকস্মিক একটা ধাক্কা লেগে বাসটি কেঁপে উঠলো তারপর কি হয়েছে বলতে পারবো না। বড়াইগ্রামের জালশুকার সোবাহানের  মেয়ে সাবিনা একটি বিকট শব্দ ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারছেন না। আর আহত দেরাজ, ইসরাইলকে অচেতন অবস্থায় দেখা যায় সদর হাসপাতালের মেঝেতে। এদিকে এখানে চিকিৎসারত ৫ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বনপাড়া আমেনা হাসপাতাল,পাটোয়ারী ক্লিনিক, জাহেদা হাসপাতাল ও বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিল আহতদের ভিড়। বনপাড়া হাইওয়ে থানার সামনে ছিল নিহত যাত্রীদের স্বজনদের ভিড়।

No comments

Powered by Blogger.