মিয়ানমারে গুপ্তসম্পদের সন্ধানে -আলজাজিরা by মীম ওয়ালীউল্লাহ

এক মুঠো কাদা নিয়ে জ মিন্ত আগ্রহের সাথে এর গন্ধ শুঁকছেন। কালো স্বর্ণের মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়ার আশায় মিয়ানমারের দারিদ্র্যপীড়িত পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় খুঁড়তে থাকা তেলখনির নিচ থেকে এই কাদামাটি তুলে এনেছেন জ মিন্ত। একটি ছোট্ট খাদের পানিতে তেলের প্রলেপ চকচক করছে। এর পাশে দাঁড়িয়ে মিন্ত জানালেন, এখানে কাজ করে ভালোই টাকা পাই; কিন্তু তার এই সার্থকতা শিগগির পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কেননা বিগ অয়েল কোম্পানি তেল অনুসন্ধানের পেছনে লেগে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সঙ্ঘাতপূর্ণ সীমান্ত বাজার মিয়ানমারে লুকিয়ে থাকা খনিজসম্পদের সন্ধান দ্রুত জোরদার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন কোম্পানি দেশটিতে আসতে চাচ্ছে। অথচ দুই দশক আগেও মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের কারণে মিয়ানমার থেকে ওই সব কোম্পানি মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। দুই দশক ধরে চীনের সাথে মিয়ানমারের সখ্যতা গড়ে ওঠে; কিন্তু এর দ্বারা দেশটি খুব বেশি লাভবান হতে পারেনি। চীনের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে এমন আশঙ্কায় মিয়ানমার ২০১১ সালে উদার অর্থনৈতিকপ্রক্রিয়া শুরু করে। এ সময় বৈদেশিক সম্পর্কে আবার ভারসাম্যের পথ অনুসরণ ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়া শুরু করে দেশটি। মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে সামান্য পা বাড়াতেই পশ্চিমা দেশগুলো এর ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ শিথিল করে। গত বছর হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সাক্ষাৎ করেন। গত ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো মিয়ানমার প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এখন মিয়ানমারের আর একমাত্র বন্ধু শুধু চীন নয়, এর সাথে অন্যান্য দেশও যোগ হয়েছে। ফলে বিষয়টি জটিল হয়ে পড়েছে।

>>রামরি দ্বীপের এক কৃষক তেলের সন্ধানে মাঠি খুঁড়ে গন্ধ শুঁকছে
মিয়ানমার বিশ্বের অন্যতম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী পুরাতন দেশ। সর্বপ্রথম ১৮৫৩ সালে তেল রফতানি করে মিয়ানমার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা মিয়ানমারে তেল আবিষ্কারের পর বার্ম অয়েল কোম্পানি গঠন করে। অনেক আগে তেল উৎপাদন শুরু করলেও ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর পাঁচ দশক ধরে দেশটিতে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা চলে আসছে। ফলে দেশটির তেল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। তবে কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানে বাঁশ দিয়ে গর্ত করে স্থানীয় পদ্ধতিতে তেল উঠানো হয়। আর এই তেল বিক্রি করেই জীবনধারণ করে চলেছেন মিয়ানমারের রামরি দ্বীপের অধিবাসীরা। এই তেল কিয়াউকফিউ শহরে স্থানীয় প্রযুক্তি দিয়ে পরিশোধন করা হয়। কিন্তু পরিশোধন প্রক্রিয়াটি মারাত্মক। তবে এখানকার লোকেরা এ জ্বালানিই মোটরসাইকেল ও মোটরগাড়িতে ব্যবহার করেন। বর্তমানে দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াংগুনে ট্রাকে পেট্রল সরবরাহ হচ্ছে।
তেলসমৃদ্ধ গ্রাম রামশেকলের বাসিন্দা তেলসমৃদ্ধ জমির মালিক ইউ তুন থেন বলেন, ১০ বছর আগে এখানে প্রচুর তেল পেতাম। তার মেয়ের একটি ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় ঠিকাদারদের এই জমি ভাড়া দিয়ে আমার মেয়ের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি সম্পন্ন হয়েছে। তেলসমৃদ্ধ দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী চীনের সাথে সম্পর্কের কেন অবনতি এবং পশ্চিমাদের সাথে কেন সম্পর্ক বৃদ্ধি হচ্ছে তা সহজেই বুঝা যায়। অনেকের মতো ইউ তুনও চীনের জাতীয় পেট্রলিয়াম করপোরেশনের প্রতি ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, চীনারা স্থানীয়দের প্রতি লক্ষ রাখে না, তারা যা ইচ্ছা তা-ই করে। মিয়ানমারের অর্থনৈতিক দীর্ঘসূত্রতা জ মিন্তদের মতো তেলশ্রমিকদের সমস্যায় প্রতিফলিত হচ্ছে। দুই বছর আগে উপকূলবর্তী শহর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত এক হাজার ২৪০ কিলোমিটার তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণের কারণে তিনি উৎখাত হয়েছেন।
গত বছর সমুদ্র তীরবর্তী পাইপের মাধ্যমে ৬৬.৫ বিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস গেছে চীনে। আর আগামী বছর প্রতিদিন ৪৪ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পাইপ লাইনের মাধ্যমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। জ মিন্ত বলেন, আমার পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে এ জমির ওপর। হারানো জমি আমি ফিরে পেতে চাই। স্থানীয়দের অভিযোগ, এত গ্যাস সম্পদের পরও খুব কম রাজস্ব পাওয়া যায়। সুশীলসমাজের এক নেতা সো শু বলেন, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে স্থানীয়রা লাভবান হচ্ছেন না। জ মিন্ত নতুন এক সমস্যায় পড়েছেন। তার জমিতে ১৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে তেলের একটি শিল্প পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। বিশেষ এই অর্থনৈতিক জোনের মধ্যে থাকবে গভীর সমুদ্রবন্দর, তেল ও গ্যাসের জন্য রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং উন্নয়ন ও উৎপাদন সুবিধা। চীনের কোম্পানিগুলো দৃশ্যত এখানে অনুপস্থিত। এ থেকে বুঝা যায় যে, মিয়ানমারে খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নেই চীন। এ মাসের প্রথম দিকে মিয়ানমার ব্যাংকিং সেক্টরের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। এর মধ্যে জাপান তিন ও সিঙ্গাপুর দু’টি ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছে। অন্য দিকে চীন মাত্র একটি ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছে। ইতোমধ্যে চীনের সমরাস্ত্রের প্রতি আগ্রহ না দেখিয়ে রাশিয়ার বিমান ও হেলিকপ্টারের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে মিয়ানমার।
২০১১ সালে চীনের একটি নির্মাণাধীন ড্যামের কাজ স্থগিত করে দিয়েছেন থেইন সেইন। এই ড্যামের মাধ্যমে উৎপাদিত ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ চীনে সরবরাহের কথা ছিল। চার বছর আগে মিয়ানমারে ৮.২৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন। এর পরের বছর দেশটি পশ্চিমাদের জন্য তার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। এ বছর দেশটির পোলট্রি খাতে ৫৬.৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো আয়ান স্টোরি বলেন, মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ বিফলে গেছে। বৈদেশিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে মিয়ানমার। তবে এটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে, চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক একবারে শেষ হয়ে গেছে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পরও দেশটির দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক এখনো ভালো এবং এটি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে। ২০১২ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় অর্ধেক বেড়ে ৬৫০ কোটি ডলারে পৌঁছে। আয়ান বলেন, চীন এখনো সব দিক থেকে মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। দেশটি বেইজিংয়ের সাথে আন্তরিক ও ফলপ্রসূ সম্পর্ক বজায় রাখবে।
এশিয়ার উদীয়মান পরাশক্তি চীন ২০১২ সালে কাচিন বিদ্রোহ দমনে মিয়ানমারকে কূটনৈতিক চাপ দেয়। এ সময় মার্কিন তেল কোম্পানি শেল সীমান্তের ভুল দিকে জাহাজ নোঙর করে।  কিয়ুকফিও অর্থনৈতিক কেন্দ্র থেকে তেল ও গ্যাস লাইনের পাশাপাশি মহাসড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করতে চায় চীন। এর মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক পথ তৈরি হবে। সিডনির ম্যাকুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ সিন টার্নেল বলেন, ২০১১ সাল থেকে চীনের সাথে শিথিল সম্পর্ক যাচ্ছে মিয়ানমারের। তবে দেশটির সাথে চীনের অবস্থান কাছাকাছি থাকবে। পুরাতন ঘনিষ্ঠতা হয়ত আর ফিরে আসবে না; কিন্তু মিয়ানমারের সাথে চীনের সম্পর্ক ভালো থাকবে। সূত্র-আলজাজিরা।
অনুবাদ- মীম ওয়ালীউল্লাহ

No comments

Powered by Blogger.