২০ কোটি টাকা হাতবদল- রাজউকে স্বাক্ষর জালিয়াতি

স্বাক্ষর জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের অথরাইজড অফিসার-২/১ মো. মিজানুর রহমান। বিভিন্ন ভবনের নকশা অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা এ কর্মকর্তা রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) ও বিসি কমিটির সভাপতি শেখ আবদুল মান্নানসহ ওই কমিটির কয়েক সদস্যের সই জাল করেছেন। এরপর পাস দেখিয়ে সংশোধিত নকশা অনুমোদনের কপি মালিকপক্ষকে সরবরাহ করেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে অভিযুক্ত অথরাইজড অফিসার বলেছেন, নকশাটি অনুমোদন করতে ২০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। সব কিছু ঠিকভাবেই করা হয়েছে। এ নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি, এতেই রক্ষা। এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) ও বিসি কমিটির সভাপতি শেখ আবদুল মান্নান কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সবকিছু অফিসিয়ালি হ্যান্ডেল করা হচ্ছে। এটা সাংবাদিকদের কাছে বলার মতো কোন বিষয় নয়। নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত অথরাইজড অফিসার-২/১ মো. মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এটা একেবারেই বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য। কেউ কিছু লিখে দিলেই অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। আর ২০ কোটি টাকা অনেক বড় বিষয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ-এর ৩৫ ও ৩৭ নং প্লটটি অথরাইজড অফিসার-৪/১-এর আওতাধীন এলাকায়। যার অবস্থান মহাখালী জোনাল অফিসে। ওই অফিসেই অতি দ্রুততার সঙ্গে সংশোধিত নকশা অনুমোদনের ফাইলে সই জালিয়াতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে। গত ১৩ই অক্টোবর অথরাইজড অফিসার-৪/১ সুকোমল চাকমা সদস্য (পরিকল্পনা) ও বিসি কমিটির সভাপতির কাছে চিঠি আকারে একটি অভিযোগ জমা দিয়েছেন (স্মারক নং-রাজউক/নঅঅ-৪/১/আর৩সি-১৭৩/১৪/৯৭ স্থাঃ তারিখঃ ১৩/১০/১৪)। এ জালিয়াতির কাহিনী ৪/১-এর অথরাইজড অফিসার ওই চিঠিতে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।  চিঠিটি মানবজমিনের কাছে রয়েছে। চিঠি’র বিষয়বস্তুতে সুকোমল চাকমা বলেছেন, প্লট নং-৩৫, ৩৭ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বনানী, ঢাকা প্লটে ডা. আবু সালেহ, মো. আমিনুল মাওলা গং-এর নিযুক্ত আম-মোক্তার ক্যাপ্টেন শামীম আহমেদ (অব.)-এর নামে এ দপ্তরে গত ১৭ই সেপ্টেম্বর চারটি বেজমেন্টসহ ১৯ তলা বাণিজ্যিক ইমারতের সংশোধিত একটি নকশা জমা দেন। নথি নং-৩সি-১৭৩/১৪। নথিটি অথরাইজড অফিসার-৪/১ এর কার্যালয়ে জমা দেয়ার জন্য ২/১-এর অথরাইজড অফিসার মো. মিজানুর রহমান নকশা গ্রহণকারী কর্মচারী মো. রফিকুল ইসলামের কাছে আসেন। ওই নথিটি জমা দেয়ার সময় পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার আটটি ছাড়পত্রই ঠিক ছিল না। এরপরও নথি গ্রহণকারী কর্মচারী মো. রফিকুল ইসলামকে নকশার ফাইলটি নেয়ার জন্য চাপ দেন। প্রস্তাবিত নকশার সঙ্গে এর আগে অনুমোদিত নথিটি উপস্থাপনের জন্য রেকর্ডে পাঠানো হয়। সেখানে এমআইএসে এন্ট্রি হয়ে সরজমিন পরিদর্শনের জন্য ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেনের কাছে নিয়ে যান অথরাইজড অফিসার মিজানুর রহমান। ইমারত পরিদর্শক নথিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, প্রস্তাবিত নকশাটি চারটি বেজমেন্টসহ ১৯ তলা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সেবা সংস্থার ছাড়পত্র ১৫ তলার। তাই রিপোর্ট দিতে পারবো না। তখন মিজানুর রহমান যা আছে সেভাবেই লিখে নথি উপরের দিকে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেন। ২২শে সেপ্টেম্বর আওলাদ হোসেন রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। এরপর হাতে হাতে মিজান ফাইলটি আমার কাছে নিয়ে আসেন। নথিটি দেখার পর আমি তাকে জানাই, আমার দায়িত্ব নেয়ার পর কোন ১৯ তলা নকশার অনুমোদন দেয়া হয়নি। তাই মূলনথিসহ নকশাগুলো নিয়ে সদস্য (পরিকল্পনা) ও বিসি কমিটির সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করার কথা জানাই। এছাড়া, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন ছাড়পত্রের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করলে আমাকে আটটি ছাড়পত্র দেখান। এক পর্যায়ে আমি তাকে ছাড়পত্র যাচাই করার কথা জানালে মিজানুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, আমি একজন আর্কিটেক্ট, অথরাইজড অফিসার ও রাজউকের দায়িত্বশীল স্থায়ী কর্মকর্তা। আমার আর্কিটেকচারাল ফার্ম থেকে নকশাগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। আমি নকশাসহ যাবতীয় সবকিছু নিজে যাচাই বাছাই করেছি। সব কিছু ঠিক আছে, আপনি নথিটি কমিটিতে উপস্থাপন করে স্বাক্ষর করে দিন। বিসি কমিটির সভাপতিসহ অন্য সদস্যদের স্বাক্ষরের বিষয়গুলো আমি নিজে দেখবো। তার এ সব কথা শুনে সরল বিশ্বাসে ২৫শে সেপ্টেম্বর নথিটি বিসি কমিটিতে উপস্থাপন করে স্বাক্ষর করি। পরে তিনি বিসি কমিটির চেয়ারম্যানসহ অন্য সদস্যদের স্বাক্ষর নেয়ার জন্য হাতে হাতে মূল নথিটি নিয়ে যান। এরপর বিষয়টি সম্পর্কে বিসি কমিটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল মান্নান এবং উপ-নগর স্থপতি ও বিসি কমিটির সদস্য মোস্তাক আহমেদকে বলি, মিজানুর রহমানের কাছে থাকা নথিটি স্বাক্ষরের আগে বিভিন্ন ছাড়পত্রসহ কাগজপত্র দেখে সই করার অনুরোধ করি। ৩০শে সেপ্টেম্বর রাত আটটায় নথি’র নির্মাণ অনুমোদনপত্র তৈরি করে। এরপর ১লা অক্টোবর আমার কাছে নিয়ে আসার পর কমিটির সবার সই দেখে সরল বিশ্বাসে স্বাক্ষর করি। এরপর মো. সাইফুল ইসলাম নামের এক কিডনি রোগী কর্মচারীকে ডেকে এনে নকশা ইস্যু করান মিজানুর রহমান। এরপর বিষয়টি কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের জানালে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসে। কমিটির সদস্য পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) গোলাম মোস্তফা জানান- তার কাছ থেকে সই নেয়া হয়নি। এছাড়া কমিটির অন্যান্য সদস্যও একই কথা জানান। এরপর মিজানুর রহমানকে নকশাগুলো ফেরত দেয়ার জন্য ফোনে বারবার জানালেও তিনি তা ফেরত দেননি। এরই মধ্যে নথিতে রাখা সেবা সংস্থার ছাড়পত্রগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয়, স্বাক্ষর জাল করে প্রতারণার মাধ্যমে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে সংশোধিত নকশাটি ইস্যু করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ নথি জমা দেয়া থেকে শুরু করে ইস্যু পর্যন্ত সব বিষয় অথরাইজড অফিসার-২/১ মো. মিজানুর রহমান নিজে উপস্থিত থেকে তদারক করেন। অথরাইজড অফিসারের চিঠি পেয়ে ১৪ই অক্টোবর রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছেন সদস্য (পরিকল্পনা) ও বিসি কমিটির সভাপতি শেখ আবদুল মান্নান। এতে তিনি দায়ী অথরাইজড অফিসারকে অর্পিত দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। এরপর থেকে ফাইলটি যেন চুপসে গেছে। মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.