সঙ্কট মুক্তির অনিঃশেষ অন্বেষা by ড. মীজানূর রহমানশেলী

বহু দিন ধরেই অস্থির সময় যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এ কথা যে ভূখণ্ড আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি বুঝি সারা দুনিয়ার জন্যও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) পৃথিবীতে এনেছিল ব্যাপক ধ্বংসলীলা। তার অবসানের পরও মানবতা শান্তি খুঁজে পায়নি। গত শতাব্দীর ৪০ দশকের শেষ থেকে ৯০-এর দশকের প্রথম পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত বিশ্ব ছিল ঈড়ষফ ডধৎ বা স্নায়ুযুদ্ধের পণবন্দী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নÑ এই দুই পরাশক্তির প্রবল দ্বন্দ্ব দুনিয়াকে অস্থির করে রেখেছিল। তারপর সেই যুদ্ধ শেষে এক দশক যেতে না যেতেই উগ্রবাদী ও চরমপন্থী সন্ত্রাস এনেছে জগতজোড়া নয়া অস্থিরতা। এক দিকে পাশ্চাত্য ও নবসৃষ্ট জঙ্গিবাদের মধ্যে সশস্ত্র সঙ্ঘাত যেমন বিশ্বব্যাপী অশান্তির সৃষ্টি করেছে, অন্য দিকে তেমনি ২০০৮ সাল থেকে সূচিত মারাত্মক বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কট ও অর্থনৈতিক মন্দা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। এ মন্দা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মারাত্মক বিপদে ফেলেছিল। ২০১৩-১৪ সালে এসে তা বেশ কিছুটা হ্রাস পেলেও সেই পরাশক্তি এখনো পুরোপুরি সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে বলে কেউ হলফ করে বলতে পারে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক সঙ্কট বারবার ফিরে আসছে। বিশেষ করে গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিপর্যয় মাঝে মাঝেই বেকারত্বের হার বাড়াচ্ছে। সরকারি কর্মচারী ও মধ্যবিত্তের প্রকৃত আয়ের মূল্যমান ভয়াবহভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ওইসব দেশেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সমাজকে করেছে চঞ্চল ও বিুব্ধ। উগ্র-জাতীয়তাবাদ প্রায় ফ্যাসিবাদী বেশ ধারণ করছে। ােভ ও বিদ্বেষকে ধাবিত করা হচ্ছে পরিশ্রমী ও নিরীহ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশের অবনতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ হুমকির ফলে রচিত হয়েছে সঙ্কটের আর এক মারাত্মক মাত্রা। এসব বিশাল সঙ্কটের সবচেয়ে বড় এবং করুণ শিকার তরুণ প্রজন্ম। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে তরুণ-তরুণীরা আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়, বরং এ দেশে তারুণ্য যে সঙ্কটের বেড়াজালে বন্দী তার প্রকৃতি ও মুখের আদল আরো জটিল, আরো ভীতিকর। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর, শিল্পে অনুন্নত এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুবির্পাকের শিকার এই দেশটির অধিবাসীদের এক বড় অংশ তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী ও শিশুরা। ২৫ বছরের কম বয়সী নাগরিকেরা বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ। জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১২ থেকে ৩২ বছর পর্যন্ত বয়সের মানুষকে তরুণ বলে গণ্য করা হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের এক-তৃতীয়াংশ তরুণ-তরুণী। এদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দরিদ্র এবং পল্লীবাসী। দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম এগিয়ে চলছে ধীরগতিতে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। তার পরের ৩৯ বছরে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাস করে আমরা এখনো দেখি যে, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগই দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন ধারণ করছে। দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে যারা আছেন, তাদেরও জীবন দুধ ও মধুর নহর নয়। অল্পসংখ্যক উচ্চবিত্ত ছাড়া বাকি সবাই আর্থিক অসচ্ছলতায় ভোগেন।
গত প্রায় চার দশকে অর্থনীতি বেশ কিছু উন্নয়ন লাভ করলেও সার্বিক অসচ্ছলতা তেমন বড় মাত্রায় কমেনি। শুধু রাজনৈতিক নয় অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও শিােেত্র নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অপারগতা, পরিকল্পনায় দূরদৃষ্টি ও সংহতির অভাব এবং ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিল্পে ব্যবস্থাপনার মারাত্মক অমতা ও ত্র“টি দেশ ও সমাজকে নানাবিধ সমস্যা ও সঙ্কটে জর্জরিত করে রেখেছে। শিাব্যবস্থা অসংহত ও বাস্তব প্রয়োজন সম্পর্কে উদাসীন হওয়ায় শিা জীবনমুখী রূপ নিতে পারেনি। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও ধর্মীয় শিার তিন ধারার মধ্যে আবার রয়েছে ১১টি উপধারা। বর্তমান সরকার নতুন শিানীতির মাধ্যমে এ নৈরাজ্যকর বিভক্তির অবসানের উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তুু জরাজীর্ণ শিাব্যবস্থাপনার যন্ত্র এ নয়া নীতি কতটুকু এবং কত দিনে বাস্তবায়িত করতে পারবে অথবা আদৌ পারবে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন।
সে যা হোক, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত অনগ্রসরতার সাথে মিলিত হয়ে এ জীবনবিমুখ ও অপূর্ণাঙ্গ শিা বেশির ভাগ তরুণ-তরুণীকে ঠেলে দেয় নির্মম বেকারত্বের অন্ধকার গহ্বরে। শিতি বেকারেরা হতাশা ও বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত হয়। অশিতি, অল্পশিতি ও অর্ধশিতি তরুণ-তরুণীর দীর্ঘ কাতার নিরাশার অন্ধকারে বৃথাই অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খোঁজে। এই উদভ্রান্ত নিরাশাকে কাজে লাগায় সুযোগ-সন্ধানী চরমপন্থী ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী। ধর্মীয় জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক হোতারা বিপুল অর্থ ও কৌশলী প্রচার ও প্রণোদনার মাধ্যমে তাদের অর্থ-উপার্জনের এবং পারলৌকিক পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে। পরিণামে এরা নিজের অজান্তেই হয়ে দাঁড়ায় সহিংস সঙ্ঘাতের পদাতিক সেনা। সমাজে আসে অশান্তি ও অস্থিরতা। রাষ্ট্রের সংহতি ও স্থিতির প্রতি সৃষ্টি হয় মারাত্মক চ্যালেঞ্জের। এর ফলে জনজীবনে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ এবং ভয়াবহ অনিশ্চিতি। উন্নতি তো দূরের কথা, এসব েেত্র দেশের অস্তিত্ব প্রবল হুমকির মুখোমুখি হয়, যেমনটি হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের েেত্র। বাংলাদেশে গত প্রায় দুই দশকে যে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটেছে, তা মূলত জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রচলিত পথেই অগ্রসর হয়েছে। এ দেশের জমি উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদের উর্বর ত্রে নয়। প্রায় ৯ শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলে পরমতসহিষ্ণু উদার ইসলামে বিশ্বাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সাথে শান্তিতে, সম্প্রীতিতে, সৌহার্দ্যে বাস করে এসেছে। এদের এত সহজে উগ্রবাদে দীা দেয়া যাবে না। তবে এখানে নেতৃত্ব বিশেষত মতাসীন নেতৃত্বকে সজাগ, সতর্ক ও যতœবান দৃষ্টি রাখতে হবে। জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসীদের মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে সুশাসন ও দ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবল ও শক্তিশালী করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, অদ ও অম অনুগতদের পোষণ ও নির্বিচার দলীয়করণ চললে পরে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। শক্তিহীন ও অপারগ এসব প্রতিষ্ঠান সুসংগঠিত এবং কৌশলী জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম সফলভাবে রোধ করতে পারে না। তখন এমনকি আন্তর্জাতিক সামরিক সহায়তাও বিশেষ কাজে লাগে না, যেমনটি দেখা যায় হাল আমলে সোমালিয়া, ইরাক ও সিরিয়ার েেত্র। তবে শক্ত হাতে দমনপীড়ন এককভাবে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদকে সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করতে পারে না। শুধু আইনশৃঙ্খলা রী, নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে নয়, শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয় বরং সঠিক, আদর্শিক ও নৈতিক প্রেরণা দিয়ে এবং তার সাথে সাথে অভাব, অপুষ্টি ও বেকারত্বের বেড়াজাল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুক্তির ব্যবস্থা করে তাদের হৃদয়-মন জয় করতে হবে। তা না করতে পারলে এক দিকে যেমন ধর্মীয় বা সাম্যবাদী চরমপন্থীরা তরুণ-তরুণীদের ভুল পথে নিয়ে যাবে, তেমনি তাদেরই আর এক অংশ পেশিশক্তি ও অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থবিত্ত লুট করার কাজে ব্যস্ত থাকবে।
এরই অলামত আমরা দেখছি গত কয়েক দশক ধরে। যখনই যে দল মতায় যায়, তার আশ্রিত ছাত্র ও যুব সংগঠনের এক প্রবল অংশ চাঁদাবাজি, জমি দখল ও বেদখলের কাজে অথবা টেন্ডার ছিনতাই করে ব্যবসা জবরদখলে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আগেও হয়েছে এখনো দেখা যাচ্ছে যে, মতাসীন দলের অনুসারী ছাত্র সংগঠন শিার মূলমন্ত্র নদীতে বিসর্জন দিয়ে বেআইনি ও সমাজবিরোধী সহিংসতার মাধ্যমে ভাগ্য ফেরাবার চেষ্টায় লিপ্ত। এদের সুপথে আনতে উপদেশ, উপরোধ যথেষ্ট নয়। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের চিহ্নিত করে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। বলতে হবে এরা কোনো দলের নয়, কাজে-কর্মে, আচার-ব্যবহারে প্রকৃত ছাত্রও নয়, মারাত্মক অপরাধের কুশীলব। সেভাইে তাদের শনাক্ত করে দৃসন্তমূলক শাস্তি দিয়ে ভবিষ্যতের অন্যায়, অনাচার রোধ করতে হবে। ভাষণ ও আহ্বানে কাজ হবে না। এ েেত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাবধান বাণী উপলব্ধি করে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে :
‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’

লেখক : চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.