আবু তোরাব, সিধুলী কাঁদছে কান্নার মিছিলে ক্যাথরিনরাও by কাজল ঘোষ

সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। তখন ঘোড়া গাড়ির চলন ছিল। মুজতবা আলীর সহিস দুর্দান্তরকমে ঘোড়ার গাড়ি টানতেন। রাস্তার মোড়ে গিয়ে প্রচ- বেগে ঘোড়ার গাড়ি ঘুরিয়ে আনার সময় মুজতবা আলী বরাবরই ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলতেন। একদিন গাড়ি থেকে নেমে তিনি সহিসকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাস্তায় ঘুরাবার সময় তুমি যে এত জোরে গাড়ি ঘোরাও তখন কি তোমার ভয় করে না? সহিস ভনিতা না করে চটজলদি বলে ফেললেন, আমিও আপনার মতো ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি। আমাদের অবস্থা আসলেই তথৈবচ। মুজতবা আলী তখন হয়তো ঘোড়ার গাড়ি বলে বেঁচে গেছেন। কিন্তু আমরা যে সকল গাড়িতে চড়ি তার তো বেশির ভাগই লাগাম নেই। কারণ রাষ্ট্র লাগাম নামক ফিটনেস না থাকাকেই মনে করে যৌক্তিক। অন্তত যোগাযোগমন্ত্রীর কথাই তা মনে হয়। অনেকটাই অবাক হলাম যোগাযোগমন্ত্রীর কথায়। ১০ই নভেম্বর থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর ঘোষণায়। সুতরাং, অন্তত সেই দিন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে রাস্তায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে পারবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের সরকারি বৈধতা দেয়ার কি কারণ থাকতে পারে এটাই মাথায় ঢুকছে না। আর ঘটা করে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান তারিখ বেঁধে দিয়ে কেন? একটি রাষ্ট্র নিয়মমাফিক চললে তো সেখানে ফিটনেসবিহীন কোন গাড়িই রাস্তায় চলার কথা না। তার মানে আমাদের ট্রাফিক বিভাগ বা আমাদের বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের অনুমতি দিয়ে দুর্ঘটনাকে দিনের পর দিন উৎসাহিত করে যাচ্ছে। সেই হিসেবে রাস্তায় সংঘটিত সকল দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির জন্য মন্ত্রণালয় বা সরকারই দায়ী। সব সম্ভবের দেশ বলে এটাও সম্ভব। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবে একটি দেশে সব অনিময়মই নিয়মের মোড়কে চলছে। তাহলে দুর্ঘটনা তো বাত কি বাত। অথবা আল্লাহ্‌র মাল আল্লায় নিয়ে গেছে এই বলেই সান্ত্বনা পেতে হবে। সকলের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা মীরসরাইয়ের আবু তোরাবের ট্র্যাজেডি। সেখানের কয়েকটি গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেরই কেউ না কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় চিরবিদায়ের পথে পা বাড়িয়েছে। ২০১১ সালের ১১ই জুলাই পাশাপাশি দু’গ্রামের একটি ফুটবল ম্যাচ ঘিরে একদল ছাত্রের নিয়ন্ত্রণহীন একটি পিকআপ ভ্যানে চড়াই কাল হয়েছিল। তাদের উৎসব আর হাসি আনন্দ মিইয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তেই। পুরো বাংলাদেশ সেই ঘটনাই শোকাচ্ছন্ন হয়েছিল। স্কুলের কোমলমতি শিশুরা কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। তারপর কি হয়েছে, চালক গ্রেপ্তার হয়েছে। একদিন তার জামিনও হয়েছে। কিন্তু যে ৪৬ তরুণ হারিয়ে গেল চিরতরে, যাদের পরিবার আজও শোকাকুল। যে দাদি আজও তার নাতির জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষায় আছেন। যে পিতা তার সন্তানদের জন্য রঙিন জামা কিনে দেবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বা যে সন্তান পিতা-মাতাকে কথা দিয়েছে বড় ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হবে? তার জবাব কি আমাদের কাছে? তার এক মাস পরেই মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের দুই কৃতীসন্তান তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে। একই রকমের দুর্ঘটনা তাদের কেড়ে নিয়েছে। তাদের মৃত্যুর পর ব্যাপক হারে প্রতিবাদ হয়েছে দেশজুড়ে। চারপাশে সড়ক দুর্ঘটনারোধে মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল, শহীদ মিনারে ঈদের দিনেও অবস্থান কর্মসূচিও হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে। উল্টো আমাদের মন্ত্রীরা চালকদের পক্ষে নিয়েছেন। অল্পশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত মানুষদের হাতেই ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলে দেয়ার কার্যক্রম পোক্ত করেছেন। আর মরণঘাতী এইসব লাইসেন্স দেয়ার পক্ষে যখন সাফাই গাইতে থাকেন আমাদের মন্ত্রীরা তখন এই রাষ্ট্র কিছুদিন পরপর মুত্যুর মিছিল দেখবে- এটাই তো স্বাভাবিক। মাঝে-মধ্যে মনে হয়, যারাই ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য গাড়ি চালকদের শাস্তি না দিয়ে অল্প টাকায় নৈতিকতা বেঁচে তাদের ছেড়ে দেন; ভুয়া লাইসেন্স দেখেও না দেখার ভান করেন; ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলে পরিতৃপ্তির হাসি হাসেন তাদের কোনও স্বজন কি কখনও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আমাদের ভিআইপি ও মন্ত্রীরা কি স্বজন হারাদের কান্না শুনতে পান। যদি সত্যিই শুনতে পান তাহলে কোনওভাবেই তো রাস্তায় অনিয়ম চলতে দেয়ার কথা না। মন্ত্রীকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল আটকাতে অভিযানে নামার কথা বলতে হতো না। খুব হাঁসফাঁস লাগে যখন এই রকম অভিযানে নামার কথা শুনি। কিছুদিন পরপরই এ রকম ঘোষণা দিয়ে সন্ত্রাসী ধরার অভিযান বা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নামার অভিযানে নামা কতটা হাস্যকর তা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়। মীরসরাইয়ের আবু তোরাব স্কুলে একটি স্মৃতিসৌধ হয়েছে। সেখানে অপরিণত বয়সে মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে পাড়ি দেয়া ছাত্রদের নাম খোদাই আছে। বছরের সেই দিনটিতে কোনও কোনও মিডিয়া হয়তো তা স্মরণ করেন আবার না-ও করেন। কিন্তু সে দিনের সেই শোককে আমরা যদি কাজে লাগাতে পারতাম তাহলে হয়তো আর কোনও প্রাণ এভাবে রাজপথে নিঃশেষ হতো না। একই ভাবে তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনে সড়কদ্বীপে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতি ভাস্কর্য। সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতি স্থাপনায় জ্বলজ্বল করছে ঢাকা মেট্রো-৮-১৩-০৩০২। সেদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় আহত শিল্পী ঢালী আল মামুনের পরিকল্পনাতেই এটি নির্মিত হয়েছে। এই স্থাপনা হয়তো আমাদের যুগ যুগ মনে রাখতে সাহায্য করবে গুণী দু’জন মানুষকে। কিন্তু অপমৃত্যুর মিছিল যদি আমরা না ঠেকাতে পারি তবে এরপর আর কতো গুণীজন লাইনে থাকবেন না তার কি কোন গ্যারান্টি এই রাষ্ট্র দিতে পারে? এটাই যেন আমাদের নিয়তি। কিছুদিন পরপর আমরা শোকে মুহ্যমান হবো। নিমজ্জিত হবো। পত্র-পত্রিকায় শোকের মিছিল দিয়ে হাহাকার করবো। কিছু সহায়তার নামে একটি তামাশার মঞ্চায়ন ঘটাবো। কিন্তু যা করলে এই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে তা করবো না। নাটোরের শিধূলিতে একই গ্রামের ১৪জন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এর মধ্যে এক পরিবারেই ৬ জন। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে গাড়ি দু’টিরই ফিটনেস সমস্যা ছিল। আর চালকরাও বেপরোয়া চালিয়েছে। অন্যদিকে দুর্ঘটনার পর হানিফ পরিবহনের গাড়ি হতাহতদের ওপর দিয়েই তাদের গাড়ি টেনে নিয়ে গেছে। যোগাযোগমন্ত্রীর ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা যদি নাটোর দুর্ঘটনার আগে হতো তাহলে হয়তো এই ৩৪টি প্রাণ এভাবে ঝরতে হতো না। জরিপে দেখা গেছে, ১৪ বছরে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৯ হাজার ৭৭৭টি। এর মধ্যে পথচারীদের চাপা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ২২ হাজার ৩৫৫টি। আর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ৭৫৪৩ বার। আর এ সব দুর্ঘটনার বেশির ভাগই সংঘটিত হয়েছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাবার জন্য। দুর্ঘটনার ৯১ ভাগই ঘটেছে চালকের জন্য। রাজধানীর আয়তন ও গাড়ির অনুপাতে ২৫ শতাংশ সড়কের স্থলে আছে মাত্র ৮ শতাংশ। সারা দেশে গাড়ি রয়েছে ২১ লাখ। তন্মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছে প্রায় ৯ লাখ গাড়ি। প্রতিদিনই রাজপথে নামছে নতুন ১৫০টি গাড়ি। পৃথক এক জরিপে দেখা গেছে, এই ২১ লাখের মধ্যে ১৮ লাখই অবৈধ। কি পরিহাসের মধ্যে আমাদের বাস। চারপাশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত খুনিদের বাস। যে কেউ চাইলেই যখন তখন গাড়ি চাপা দিয়ে আপনাকে আমাকে বা আমাদের স্বজনদের যে কাউকে থেঁতলে দিতে পারে। হাড়-মাংস মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে। তারা জানে, ভিআইপি হলে একটু প্রতিবাদ বেশি হবে। আর গরিব হলে বা সাধারণ হলে থোড়াই কেয়ার। গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা হবেই। আর এভাবে কারও মৃত্যু হলে তো বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। একজন কি শ’ শ’ মৃত্যু তাতে কি আসে যায়- আমাদের জন্য তো সাফাই গাইবে মন্ত্রী-নেতারা।

No comments

Powered by Blogger.