রাজনৈতিক সঙ্কট : উত্তরণের কোনো পথ নেই? by প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া

দেশ আজ নীরবে কাঁদছে। তবে কেন কাঁদছে আমরা সবাই জানি। মতার জন্য অন্ধ হয়ে গেছি বলেই জাতির এই ক্রন্দন আমরা আজ শুনতে পাচ্ছি। দেশের সব জায়গায় যেন একটা অস্থিরতার মহাবাষ্প ছড়িয়ে আছে। সম্প্রতি সংঘটিত ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে আমরা কি ভয়াবহ করুণ অবস্থা দেখতে পাই না? দুর্নীতি, গুম, হত্যা, জনগণের অধিকার হরণ, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং তাদের ধর্মীয় মন্দির-উপাসনালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ কোনো সভ্যদেশের সুস্থ রাজনৈতিক ধারা বলে দাবি করা যায় না। দেশে সুশাসন থাকলে তাহলে এগুলো হবে কেন? কেনই বা মানবতা ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে? কেন নিরীহ শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের ওপর আঘাত আসবে? এগুলো কারা সংঘটিত করেছিল? কাদের নেতৃত্বে এগুলো হয়েছিল? প্রশাসন সম্পূর্ণ নীরব ছিল কেন? কোনো ধর্ম কারো প-প্রতিপ হতে পারে না। রামু, উখিয়া ও পটিয়ার ঘটনা কী প্রমাণ করে? এতগুলো বৌদ্ধ স্থাপনা, ঐতিহ্য ও বসতবাড়ি ধ্বংস হলো, জ্বলে গেল, পুড়ে গেল কিন্তু কোনো বিচার হলো না। প্রশাসনকে কোনো আইন বা বিচারের আওতায় আনা গেল না। এটা কেমন কথা? এতে বৌদ্ধরা সাংঘাতিক ক্রুুদ্ধ। সেখানকার জনগণ এখনো ভীতসন্ত্রস্ত। দেশের নানা জায়গায় এখনো সংখ্যালঘুদের ওপর অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নিত্য ঘটে যাচ্ছে। প্রশাসন নীরব থাকবে কেন? প্রশাসন তো সরকারের আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য। এমনকি তাদের জবাবদিহিতাও আছে সরকারের কাছে। তার পরও প্রশ্ন জাগে সরকারের গোয়েন্দা, প্রশাসন ও আইন রাকারী বাহিনী যথাসময়ে পদপে নেয় না কেন? তাদের দায়িত্ব তো এগুলো অনুসন্ধান করা, খতিয়ে দেখা এবং ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু করে না কেন? এ চিন্তাও বারবার মনে আসে এবং বুঝতে আমাদের বেশ কষ্ট হয়। কষ্টে আমাদের মধ্যে অনেকে বলেন, সংখ্যালঘুরা কি এ দেশে জন্মগ্রহণ করে ভুল করেছে? আমি কিন্তু এ রকম চিন্তার ঘোরবিরোধী। আমি বলি এ দেশে জন্মগ্রহণ করে আমি, আমরা অনেক ধন্য হয়েছি। এতে আমরা গর্বিত। কোনো জাতি বা সম্প্রদায়কে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বিচার করা যায় না। বিচার করতে হয় তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে। আর কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দু’টি শব্দই আমাদেরকে ব্যথিত করে। আমাদের অনেকেই বলেন, ‘সংখ্যালঘু’ বললেই নাকি মন দুর্বল হয়ে যায়। মনে হয় এ দেশে আমরা এতিম, অসহায়। তাই আজ বলতে চাই এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার সমান। পবিত্র সংবিধানেও বলা আছে, ‘একই ভূখণ্ডে যেকোনো স্থানে বসবাসকারী বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণের যেকোনো নাগরিক সমান সুযোগ-সুুবিধা ভোগ করবে। কোনো রকম বৈষম্য করা যাবে না।’ আমরাও বলতে পারি ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’।

৫ জানুয়ারি দেশে কী হলো? যে নির্বাচনকে ঘিরে একটি সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হলো এবং তাদের সহায়সম্বল হারাতে হলো। আবার অনেকে গৃহহারা হয়েছে, আর অনেকে গোপনে দেশ ছেড়ে চলে গেছে, চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ সব কিছু মিলিয়ে বলা যায়, ওই জাতীয় নির্র্বাচনের ইতিহাসটি ‘এক কলঙ্কজনক’ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। একটি নির্বাচনকে ঘিরে এত সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, এত মিথ্যা, এত প্রহসন আর এত তামাশা তা ভাবতে খুব কষ্ট হয়। সঙ্ঘাত আর সহিংসতা বিবেককে কি দংশন করে না?
নির্বাচন কমিশনসহ সরকারের প্রশাসন, আইনসংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা এই নির্বাচনে সংযুক্ত ছিলেনÑ তারা কি বলতে পারবেন ভোটকেন্দ্রে অনেক লোক এসেছে? শতকরা মাত্র ৮-১০ জন লোক ভোটকেন্দ্রে গেছে। আমরা দেখেছি, প্রমাণও পেয়েছি। এদের মধ্যে আবার অনেককে জোর করে নেয়া হয়েছে। অনেক সংখ্যালঘু ভোট দিয়েছে একমাত্র ভয়ে, নতুবা বিপদ হবে তাই। ওই রকম ভয়ভীতির কথা ভোটের আগে এদেরকে বলেও দিয়েছে। এ রকম অনেক প্রমাণ আছে আমাদের হাতে।
এমনকি আমি নিজেও অনেক বড় বড় শিতিজনকে প্রশ্ন করেছি, আমি ঢাকাতে ভোট দিতে পারিনি কেন? আপনি কি দিয়েছেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকেরা কি ভোট দিয়েছেন? আমাদের উপাচার্য কি ভোট দিয়েছেন? উত্তরে বলতে হবে, দেননি। দিতে পারেননি। তাহলে প্রহসনের এই নির্বাচনকে কিভাবে স্বচ্ছ, সুন্দর এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে? প্রতিপ ছাড়া যুদ্ধে জয়ী হলে সেই বিজয়ের কোনো গৌরব ও মর্যাদা থাকে না। বিজয়ের স্বাদও পাওয়া যায় না। ওই বিজয় বেশি দিন টেকেও না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও সে রকম হয়েছে। ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। দীর্ঘ প্রতীতি জাতির আশা-আকাক্সার সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এতটুকু ছাড় দেয়া যায় না।
কোনো বিবেকবান মানুষ এ নির্বাচনকে মেনে নিতে পারেননি, পারছেনও না। এমনকি মূর্খ, অশিতি সাধারণ শ্রেণির মানুষও বিবেকের তাড়নায় ভুগছেন রীতিমতো। এখনো তারা বারবার প্রশ্ন করে জানতে চাচ্ছেন, দেশে এ কী নির্বাচন হলো? আপনারা চুপ হয়ে বসে আছেন কেন? এ রকম নির্বাচন তো আমরা জীবনে কখনো দেখিনি। তাই এ নির্বাচনকে অনেকে ‘গণতন্ত্র হত্যার নির্বাচন’ বলেছেন। অনেকে বলেছেন ‘একতরফা নির্বাচন’।
সঙ্ঘাত সহিংসতা কারো কাম্য নয়। তাই বলে যে বিরোধী দলকে নিঃশেষ করতে হবে এ রকম মনোভাব আনাটাও বোধ হয় ঠিক নয়। দেশে বিরোধী দল থাকবেই। নইলে সরকারের ভালো-মন্দ দেখবে কে? মতাসীন সরকারকে সব সময় বুঝতে হয় মতা চিরস্থায়ী নয়। শক্তি প্রয়োগেও এটাকে ধরে রাখা যাবে না। বাস্তবতা সেটা প্রমাণ করে। তাহলে এটা হবে কেন? বাংলাদেশের আজকের যে রাজনৈতিক সঙ্কট তা একমাত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে। জনগণের এই দাবি মানতে সরকারের অসুবিধা কোথায় তা আমি মোটেই বুঝি না। এটি বর্তমানে হয়ে উঠেছে জনগণের মূল দাবি। এটি আজ পরিণত হয়েছে জনদাবিতে। যদিও বা আওয়ামী লীগের অনেকেই এর পে বলছেন, সরকারের সাথে সুর মেলাচ্ছেন ভয়ে অথবা সংসদ-মন্ত্রী পদ হারাবেন বলেই। নতুবা বিবেকের তাড়নায় বলতেন। নির্বাচনের আগেও এ রকম বলেছেন অনেকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্টটি আসলে বর্তমান সরকারেরই সৃষ্ট। এটি বিএনপির সৃষ্টি নয়। অতএব এটি বহাল থাকলে আমাদের অসুবিধা কোথায়, বুঝতে বেশ কষ্ট হয়।

এখন বিএনপির সাথে সংলাপ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। যদিও বা প্রধানমন্ত্রী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, শুধু সংবিধান রা করার জন্যই এ নির্বাচন। এরপর বিরোধী দল চাইলে আবার নতুন ফর্মুলা নিয়ে আলাপ করতে পারেন। তিনি এটাও বলেছিলেন, জনগণ যদি চায় তাহলে সব রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের ব্যক্তিবর্গের সাথে সমঝোতার একটি ত্রে তৈরি করা যেতে পারে। একটি ভালো উদ্যোগের কথা বলেছিলেন সে দিন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রশ্ন, এখন কেন সেই উদ্যোগ নেই? আর সেই উদ্যোগের প্রশ্ন তুললে বারবার নাকচ হচ্ছেই বা কেন? এ দাবির প্রতি শুধু প্রধানমন্ত্রীর অসম্মতি নয়, তার দলের খুবই কট্টর ও অনুগত কতিপয় মন্ত্রীও তার সাথে সুর মেলাচ্ছেন। সব েেত্র দলীয়, একপেশে কিংবা গলা টিপে ধরার মতো শাসনব্যবস্থা দেশ ও জনগণের জন্য কখনো শুভ হতে পারে না। এর পরিণাম হয় ভয়াবহ। এতে দেশ ও জনগণ তিগ্রস্ত হয়। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বোঝা উচিত। প্রধানমন্ত্রী অনেক ভালো কাজ করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এর প্রশংসা করি। কিন্তু এমন কতকগুলো কাজ হচ্ছে যা খুবই নিন্দনীয় ও অগণতান্ত্রিক।
আমি আবারো বলছি আজকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি শুধু বিএনপির একার নয়। এমনকি ২০ দলেরও নয়। এটি দেশের সুশীলসমাজের দাবি। আপামর জনসাধারণের দাবি। আমরা এমনও দেখছি যারা কোনো রাজনীতি বা দলসম্পৃক্ত নন, তারাও বারবার এ দাবির কথা বলছেন। যেমন টিআইবির নির্বাহী উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সাবেক মন্ত্রী ও অন্যান্য সাবেক উপদেষ্টা। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা নিরপেক্ষা নির্বাচনের পরে তারা তো কোনো একটি বিশেষ দলের পে নন। তারা শুধু দেশের নানা সঙ্কট ও দুর্যোগে কথা বলেন এবং তাদের পরামর্শগুলো দেন।
বিশ্ব আজ উন্নত ও অনুন্নত দু’টি ভাগে বিভক্ত। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো শিা, প্রযুক্তি, জ্ঞান-ঐশ্বর্যে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। অপর দিকে অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা এমনিতেই শোচনীয়, তার মধ্যে আবার নানা সঙ্কট ও নানা বিপর্যয়। এ জন্যই তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে। তারা নানা প্রতিকূলতায় ভয়াবহ রূপে পিছিয়ে আছে। হাজারো সমস্যা তাদের পরিস্থিতি ও জনজীবনকে ক্রমাগতই ঘোলাটে করে তুলছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে ভাবতে পারছি না। খুবই ভয়াবহ ও সঙ্কটময় মনে হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর চার দশক অতিক্রম করলেও আমরা আশানুরূপ উন্নতি লাভে ব্যর্থ হয়েছি। এর প্রধান কারণ আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতীয় সমঝোতার অভাব। তার পাশে আছে অর্থ পাচার, অর্থ কেলেঙ্কারি আর দুর্নীতি নামক বিরাট সব ব্যাধি। এ জন্য বারবার প্রশ্ন জাগছে, আগামীতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বড়ই করুণ। দেশের প্রধান অর্থ জোগানের খাত গার্মেন্ট আজ বন্ধ হওয়ার পথে। কেন এ রকম হবে? পাশের উন্নত দেশগুলো আজ কোথায়? এদের দিকে তাকালে বলতে ইচ্ছে করে, আমার দেশটি টিকে থাকতে পারবে তো? ওই সব দেশে তো প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক বিপুল সমৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
আজ বলতে দ্বিধা নেই এ রকম বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। স্বাধীনতাযুদ্ধ তো এ জন্য হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সোনার বাংলাদেশ যেখানে থাকবে আমাদের মৌলিক অধিকার। ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোনো রকম বৈষম্যও। বাকস্বাধীনতা থাকবে, লেখনী স্বাধীনতা থাকবে; আরো থাকবে আমাদের সবার মৌলিক অধিকার ভোগ করার স্বাধীনতা। কিন্তু কই? বর্তমানে তা মোটেই দেখতে পাচ্ছি না। আজ দেশ এ জন্যই বেশ অস্থিরতার পথে।

একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌম মতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। গণমানুষের আশা-আকাক্সা থাকে এর মধ্যেই। সেটি আজ মৃত বললেই চলে। বর্তমান কেউ কোনো কথা বলতে পারছেন না। এ যেন এক অদ্ভুত দেশ। অথচ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে জনগণের ইচ্ছাই হলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেভাবে দেশ পরিচালনা করতে চায়, দেশ সেভাবেই চলবে। আমরা এ-ও জানি গণতন্ত্রে ব্যক্তিশাসন ও স্বৈরাচারের কোনো স্থান নেই। তাই আজ গণমানুষের রোষ আবার প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক আবারো দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে। ১৯৭১ সালে যে রক্তয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তার অন্যতম মূলনীতিই ছিল গণতন্ত্র। আজ সেই গণতন্ত্র কোথায়? গণতন্ত্রের আজ কান্না কেন?
সে দিন পাকিস্তানের শাসকদল আমাদের জনমত অগ্রাহ্য করেছে বলেই তো সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। এ কথা কারো অজানা নেই। মতা টিকিয়ে রাখার অশুভ ইচ্ছা অদম্য হলেও তা আর রাখতে পারেনি। সে হিসেবে পরবর্তীকালে বাকশালেরও একই অবস্থা হয়েছে। শক্তি আর অস্ত্র দিয়ে কখনো মতা টিকিয়ে রাখা যায় না। অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের সে কথাই বলে দেয়। যদিও বা মতার দাপটে দেশ চলে, তা হয় খুবই ণস্থায়ী। এতে দেশ বা রাষ্ট্রের জনগণের অনেক কষ্ট হয়। জাতি অসহায় হয়ে পড়ে।
এটা যেকোনো দেশের শাসককে বুঝতে হবে, মতা কোনো অবস্থাতেই চিরস্থায়ী নয়। আজকে যা ঘটছে আগামীতেও তা ঘটতে পারে। এ উপলব্ধি থাকতেই হবে। বাংলাদেশের মানুষ অধিকার আদায়ে যেকোনো সময় দীপ্ত ছিল, আগামীতেও থাকবে। ১৯৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭০, ’৯০-এর গণ-আন্দোলন প্রমাণ করেছে তারা কোনো অবস্থাতেই মাথা নত করে না। আশা করি আগামীতেও করবে না দেশ বাঁচানোর স্বার্থে।
প্রধানমন্ত্রী চাইলে একটি সংলাপের পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। এখন আমাদের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী এতে সাড়া দেবেন কি? এতে আমাদের দীর্ঘ দিনের উষ্ণতা, দীর্ঘ দিনের নীরবতা ও সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে একটি শুভ আলোর দিশা দেখা যাবে বলে আমি মনে করি।
আমি কখনো সঙ্ঘাত কিংবা সহিংস আন্দোলনকে সমর্থন জানাই না। কারণ এটি গণতান্ত্রিক নীতিধর্মও নয়। আমি শান্তি ও অহিংস মতবাদের পে থাকি। কারণ আমি জানি একটি জিঘাংসা আরেকটি জিঘাংসার জন্ম দেয়। একটি সঙ্ঘাত আর একটি সঙ্ঘাত তৈরি করে। এটি বৌদ্ধ যুক্তিবাদের কথা। অতএব এসব বিষয় চিন্তা করে আমি প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাতে চাই, আর একটু নমনীয় ভাব প্রদর্শন করার জন্য। তিনি একটু ছাড় দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়। সঙ্কটও কেটে যায়। রাষ্ট্রকে সবসময় চিন্তা করতে হবে গণতান্ত্রিক আদর্শ সমুন্নত রাখতে। এতে কখনো সঙ্ঘাত আসে না, সঙ্ঘাত তৈরি হয় না। রাষ্ট্র যখন তার আদর্শ থেকে চ্যুত হয়, আর রাষ্ট্রীয় উপাদানগুলো যখন নিজ স্বার্থে কিংবা মতা রা করার েেত্র ব্যবহৃত হয়, তখনই গণরোষ তৈরি হয়। আমাদের অবস্থাও আজ সে রকম।
বর্তমান পুলিশ-র‌্যাব এবং ল অ্যান্ড ফোর্সের সব বিভাগ থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিচারিক স্থান হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, এমনকি শিাপ্রতিষ্ঠান, শিাব্যবস্থা, জনপ্রশাসনের সব স্তর আজ যেন একদলীয় শাসনব্যবস্থায় চলছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জনগণের কথা বলার স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, লেখনী শক্তি, বাকশক্তি সব কিছুই যেন আজ রুদ্ধ হতে চলেছে। এগুলো পরোভাবে গণতন্ত্র হত্যার শামিল। সুশাসন বা গুড গভর্নেন্স বলতে যা বোঝায়, তা এখন দেশে নেই বললেই চলে।
অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সম্প্রতি একটি নির্বাচন হলো। তা কত সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অবাধ ছিল সে দিন আমরা দেখেছি। এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আচরণও আমরা দেখছি। তিনি দেশের প্রতি কত অনুগত এবং কত দেশপ্রেমিক তা আমরা তার প্রতিটি কাজের মধ্যেই বুঝতে পারছি। মোদি এখন কোনো দলের সমালোচনা করছেন না। এমনকি ভারতের রুট লেভেলের দল কংগ্রেসেরও না। ব্যক্তি সোনিয়া কিংবা রাহুলের কথা তো বাদই দিলাম। মোদির সব শ্রম, মেধা, চিন্তা ও স্বপ্ন বর্তমান দেশকে গড়ার কাজেই নিয়োজিত। তাই তো ক’দিন আগে তাকে দেখেছি ঝাড়– হাতে দিল্লির রাস্তা পরিষ্কার করতে। কোনো হাঁক-ডাক নেই, কোনো আড়ম্বরও নেই। তার রাষ্ট্রীয় সফরে আকাশ বহরের কোনো বাহুল্য দেখছি না। অথচ আগের মতো সহজ-সরল জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই এত বড় দেশকে শাসন করে যাচ্ছেন প্রায় ১০০ কোটি মানুষের দেশ বৃহৎ ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এগুলো আমাদের অবশ্যই অনুকরণীয় বিষয়।

ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন জাতির গর্বিত সন্তান। তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান। তিনি মারা গেলেন ৮ অক্টোবর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূর্যসন্তান। তিনি কোনো প-েবিপরে নন। অথচ রাষ্ট্র তার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানাতে পারেনি। এতে ভাষামতিন ছোট হননি, ছোট হয়েছি আমরা। এ দিকে প্রফেসর পিয়াস করিম দেশের একজন স্বনামধন্য শিক। তার অকালমৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় তি হয়েছে। জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, আদর্শিক কথা বলা এবং সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ লেখার তার যোগ্যতা ও দতার কথা আমরা সবাই জানি। শিক হিসেবে শুধু এ দেশে নয়, তিনি বাইরেও বেশ পরিচিত। আর বর্তমান মিডিয়া জগতে তিনি এক নন্দিত শিক, যার কথা শোনার জন্য আমরা রাত জেগে বসেই থাকি। অথচ তার মরদেহটি সর্বসাধারণের জন্য পবিত্র শহীদ মিনারে আমরা আনতে পারিনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। জাতি হিসেবে আমরা কলঙ্কিত হয়েছি। রাজনীতিতে অবশ্যই প-বিপ থাকবে। প্রকৃত গণতন্ত্রের আদর্শ তো সেখানেই। নতুবা আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রইল কোথায়? তাই বলে তার পবিত্র মরদেহটি শহীদ মিনারে আনা যাবে না, এটা আবার কেমন রাজনীতি!
দেশের সব জনগণ একদলে থাকে না, থাকবেও না, থাকার কথাও নয়। সবার স্ব স্ব মত আছে। একটি আদর্শিক অবস্থান আছে। এমনকি পছন্দ-অপছন্দের একটি জায়গাও আছে। এটি তাদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা। সেই স্বাধীন অধিকারটি আমি, আমরা কেউ খর্ব করতে পারি না। আর শহীদ মিনার তো কারো একার নয়, এটা দেশের সব নাগরিকের। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা রাষ্ট্র বা সরকারের কাছে এভাবে নিগৃহীত হবেন সেটা কারো কাম্য নয়। এগুলো রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো শুভ কাজ বলে আমি মনে করি না। অযথা সঙ্কট তৈরি করা, শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে তোলা। আর জনগণের মধ্যে দ্রোহ সৃষ্টি করা। জনগণ যখন তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখনই জনদ্রোহ বা গণরোষ দানা বেঁধে ওঠে। এটাই বাস্তবতা। এটা শুধু আজকের জন্য নয়, অতীতেও হয়েছে এবং আগামীতেও থাকবে। আমরা জানি একটি হিংসা আরেকটি প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশ কখনো তার কাক্সিত ল্েয পৌঁছাতে পারবে না। উন্নতির-সমৃদ্ধির সব সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হবে। সেটা হোক, আমরাও চাই না।
এই তো সম্প্রতি ইতালির মিলান শহরে অনুষ্ঠিত দশম আসেম শীর্ষ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহিংসতা ও চরমপন্থা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা অভিনন্দনযোগ্য। তিনি বলেছেন, বিশ্বশান্তি ও প্রবৃদ্ধির পথে এগুলো প্রধান অন্তরায়। তিনি সেখানে জিরো টলারেন্সের কথাও বলেছেন। অবশ্যই রাষ্ট্র, শাসকদল ও বিরোধী দলের ভালোর জন্য জিরো টলারেন্সের প্রয়োজন অপরিহার্য। এতে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে।
গত শুক্রবার ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালামও বলেছেন, পারমাণবিক শক্তি যখন মানবসভ্যতা ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন তা খুবই তিকর। তিনি তরুণদের উদ্দেশে এ কথা বলেছেন। তিনি উদ্ভাবনী শক্তির জন্য তরুণদের আহ্বান জানিয়েছেন। এসসিসিআইয়ের ১১০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি ঢাকায় আসেন।
যেকোনো অপশক্তি রাষ্ট্র, জনগণ তথা বিশ্ব মানবসভ্যতার জন্য কোনো শুভফল বয়ে আনতে পারে না। সেটি পারমাণবিক শক্তি হোক; আর পেশিশক্তি, রাষ্ট্রশক্তি কিংবা বিশ্বশক্তিই হোক। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের বোধোদয় হওয়া উচিত। আমরা কেউ মূর্খ নই। বিচার করার শক্তি আমাদের আছে। অতীতের শিা কিংবা চলমান বিশ্বের ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। অতএব এমন কোনো কর্ম করা উচিত নয়, যেই কর্ম পরবর্তীকালে আমার ওপরই আঘাত নিয়ে আসবে এবং আমাকেই আক্রমণ করবে।
পরিশেষে বলি, একটি দেশকে সাফল্যের দোরগোড়ায় নিতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও দেশ গড়ার চিন্তাভাবনা। পাশাপাশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতা। সততা ও দেশপ্রেম তো অবশ্যই থাকবে। কোনোভাবেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। কোনো ধরনের বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতাও আনা যাবে না। সুস্থ ও অবাধ গণতন্ত্রের পাশাপাশি সার্বভৌমত্বের প্রতি অঙ্গীকার কিংবা আনুগত্যও থাকতে হবে দেশোন্নয়নের একটি প্রধান শর্ত হিসেবে।
তাই আজ আমরা দেশের এ সঙ্কটের একটা সুরাহা চাই। আর বাড়াবাড়ি নয়। আসুন আমরা সংলাপের একটি ত্রে তৈরি করি। যে সংলাপ হবে আগামী দিনে আমাদের দেশ ও জাতি রার একটি প্রধান হাতিয়ার। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আবারো সবিনয়ে অনুরোধ জানাই, আপনি সংলাপে বসুন। আপনার হৃদয়কে বড় করুন। দেশের জন্য একটু ত্যাগী মনোভাব প্রদর্শন করুন। যেভাবেই হোক সঙ্কট উত্তরণের একটি পথ বের করুন, জাতিকে বাঁচান। নতুবা দেশ অগ্নিগর্ভে নিমজ্জিত হবে। চলুন আমরা আজ সবাই সেই আদর্শ অনুসরণ করি। দেশকে ভালোবাসি, দেশের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখি। আমরাও নিরাপদে থাকি। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বাংলাদেশসহ বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।

লেখক : সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার

No comments

Powered by Blogger.