রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হোক- দেশে সুস্থ রাজনীতি বিকশিত হোক by এমাজ উদ্দীন আহমদ

সারা দেশে গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ঢাকায় ৫০টিসহ সারা দেশে ১৯৬টি অপহরণের মামলা হয়েছে। এ সময়ে এক হাজার ২৯০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অপহৃতদের বেশির ভাগকে পুলিশ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত অপহরণ এবং পরে তাদের হত্যাকাণ্ডে অর্থ আদায়ের জন্য পুলিশ ও র‌্যাবের যোগসাজশের কথা উঠছে। দেশের উচ্চ আদালত র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশও দিয়েছেন। জনমনে এক দিকে যেমন গভীর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তেমনি অন্য দিকে ভীতি ও আতঙ্ক গভীর হয়েছে। মানুষ যাবে কোথায়? যারা জনগণের নিরাপত্তা বিধান করবে, তারাই এখন ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা কিভাবে দেয়া যাবে? দেশে এমন পরিস্থিতি একবারই দেখা গিয়েছিল এবং তা ১৯৭৪-৭৫ সময়ে। তখনকার রক্ষীবাহিনী এবং আজকের র‌্যাব জনগণের সামনে একই আদলে উপস্থিত যেন; কিন্তু কেন হলো?
নারায়ণগঞ্জে যা ঘটেছে তাকে আমি ব্যাধি বলে মনে করি না। নারায়ণগঞ্জের নারকীয় ঘটনা উপসর্গমাত্র। একটি লক্ষণ শুধু। ব্যাধি হলো রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যাকে লন্ডনের The Economist পত্রিকা চিহ্নিত করেছে Toxic Politics (অথবা বিষাক্ত রাজনীতি)। যে রাজনীতি দূরকে কাছে টানে, পরকে আপন করে, সেই রাজনীতির চরম দুর্বৃত্তায়নই হলো মূল ব্যাধি। ক’জন পুলিশ কর্মকর্তা অথবা র‌্যাবের সদস্যকে গ্রেফতার করে এই ব্যাধির উপশম ঘটানো সম্ভব নয়। দেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের বিষক্রিয়া সব ক’টি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা ও সংগঠনকে বিষাক্ত করে ফেলেছে। জাতীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে বিকৃত করে তুলেছে। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি নাগরিক জীবনে স্বস্তি আনে এখন তাদের কারো কারো উপস্থিতি নাগরিকদের আতঙ্কিত করে। একটি এলিট ফোর্স (Elite Force) হিসেবে যে র‌্যাবের সৃষ্টি হয়েছিল সঙ্কটকালে নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে, এখন তাদের কোনো কোনো সদস্য গুম, খুন ও নাগরিক অপহরণের দায়ে অভিযুক্ত। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে নির্বাচন প্রক্রিয়া কোনো জনপদের জনসমষ্টিকে গণতন্ত্রের প্রশস্ত রাজপথে তুলে আনে এবং শান্তিপূর্ণপ্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, সেই নির্বাচনপ্রক্রিয়ার বিকৃত রূপ ক্ষমতাশ্রয়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিনা ভোটে অর্ধেকেরও বেশি নেতা জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান এই অপরিণামদর্শী প্রক্রিয়ার সহযোগী হলো। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নিশ্চিত। নাগরিকদের সমাবেশ করার, মিটিং-মিছিল প্রতিটি সংগঠনের অধিকার মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত। বাংলাদেশে সরকারের কোনো কার্যক্রমের বিরোধিতা কিন্তু এখন মহাপাপ। তার শাস্তি হলো জেল-জুলুম-হামলা-মামলা।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো মেধা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে সুসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা, জার্মান দার্শনিক ম্যাক্স ওয়েবারের Ideal- typical Framework-এর আদলে। বাংলাদেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা সংগঠিত হয়েছে প্রধানত সরকারের সহযোগী সংগঠন থেকে সংগৃহীত দলীয় ক্যাডার বা অনুগতদের দ্বারা। শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন, বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ গঠনেও দলীয় ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করার যে উদগ্র আকাক্সা তার ফলেও বিসর্জন দেয়া হয়েছে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং মেধা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। প্রত্যেকটি সরকারি ব্যাংক ডুবতে বসেছে। হারিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যেটাকে অর্থমন্ত্রী ফটকাবাজি বলে চিহ্নিত করেছেন সেই শেয়ারবাজারে যে লুটপাট চলেছে সে সম্পর্কে তদন্ত্র কমিটি দিয়ে তদন্ত করাও হলো; কিন্তু তার কোনো বিচার হলো না। কারণ তার মধ্যেও ধরা পড়ল বড় বড় রুই কাতলা এবং তার বেশির ভাগই সরকারি দলের। বিশ্বময় নন্দিত গ্রামীণ ব্যাংক এবং সেই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের সর্বপ্রথম নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার ব্যাংককে নিয়ে যা করা হয়েছে তা সীমাহীন প্রতিহিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ ও অসূয়ার বশবর্তী হয়ে।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটলে সমগ্র সমাজে সৃষ্টি হয় হিংসা-প্রতিহিংসার দুরপনেয় কালিমা, হিংসা-বিদ্বেষ এবং অবিশ্বাস-অনাস্থার হিংস্র পরিবেশ। দেশের অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়িত সমাজের একাংশ সীমাহীন ক্ষতির মধ্যে পড়ে। রাজনীতি দুর্বৃত্তের নিয়ন্ত্রণে এসে সমগ্র সমাজ জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সভ্য জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। বর্তমানে দেশের যেসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া বিদ্যমান রয়েছে তা দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করাও সম্ভব নয়। এগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এসব প্রতিষ্ঠান এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে, যে উদ্দেশ্যে রাজনীতির জন্ম হয়েছে তা অর্জিত হবে না যদি না রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হয়। আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় যেসব সমস্যা হঠাৎ করে মাথা উঁচু করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে বিঘিœত করতে উদ্যত হয় তার সমাধানের জন্যই তো রাজনীতি। সমস্যাটাকে উসকে দেয়া নয়, ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে, অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টি নিয়ে, পরস্পরকে কাছে টেনে নেয়ার স্বতঃস্ফূর্ত আকাক্সাই হলো রাজনীতির অঙ্গীকার। তাই সুষ্ঠু রাজনীতিতে কোথাও মিলবে না সঙ্কীর্ণতা, কোথাও পাওয়া যাবে না স্বার্থপরতা, নীচতা, নোংরামি। এসব জঘন্য ব্যত্যয় যেখানে বাসা বাঁধবে সেখানে আর যা-ই থাক, রাজনীতি অবস্থান করে না। অন্য দিকে রাজনীতি উন্নত স্তরে উপনীত হয় শুধু গণতন্ত্রের সংস্পর্শে এসে। গণতন্ত্র শুধু এক সুষম সামাজিক ব্যবস্থা নয়, ইনসাফ-সিক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থাও। গণতন্ত্র হাজার বছরের কাক্সিত সাংস্কৃতিক অর্জনও। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক পরশমণির স্পর্শে ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতি, এমনকি দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্ষমতা অথবা ক্ষমতার কেদ তখন সমাজ পরিবর্তনের মহান দায়িত্বে রূপলাভ করে। সাম্য-স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্যের মতো সমাজে মহামূল্যবান মণিমুক্তারূপে যুগে যুগে চিহ্নিত মহান শিল্পরূপে আবির্ভূত হয়।
গণতন্ত্র তাই এত কাক্সিত; কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতি পরিচালনার জন্য এমন এক নেতৃত্ব দরকার, যা আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো গভীর, সর্বংসহা মাটির মতো সহিষ্ণু। প্রফেসর ইরাজিম কোহাকের গণতন্ত্র হলো পরিপূর্ণতার, অসম্পূর্ণতার নয়। গণতন্ত্র হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের, সঙ্ঘাত বা সংঘর্ষের নয়। গণতন্ত্র হলো আদর্শের, লোভের নয় Democracy is about maturity, not pettiness; goodwill, not contentiousness; idealism, not greed.. যেকোনো রাষ্ট্রের সুষ্ঠুৃ শাসন প্রশাসনের মূলে থাকে নৈতিকতার সুদৃঢ় এক বাতাবরণ। সাময়িকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিতে পারে; কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা এবং জনকল্যাণমূলক বিধিবিধানের ভিত যদি শক্তিশালী হয় এবং জনগণ চূড়ান্তপর্যায়ে ন্যায়বিচার সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে তাহলে সঙ্কটও কেটে যায়, কেননা এগুলোই ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রের বিভূষণ; কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের হিংসাত্মক কার্যক্রম, প্রতিশোধমূলক আচরণ, বিশেষ করে হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কীর্তকদের দুর্ব্যব্যহার, ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা এবং সন্দেহ একবার জনগণের মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে গেলে সেই বিভূতি বিনষ্ট হয়। তখন সরকারের সফলতাকেও জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করে না। জাতীয় সংসদে ১৫৩ জন বিনা ভোটে সদস্য হয়েছেন। অন্য ১৪৭ জন পেয়েছেন সর্বাধিক ১০ শতাংশ ভোট। জাতীয় সংসদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সংস্থা। জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তা গঠিত হওয়ার কথা। বিরোধী দল আন্দোলন করুক বা না-ই করুক এই সম্মানীয় সংস্থায় যথার্থরূপে যারা সদস্য হননি তাদেরই আত্মমর্যাদাবোধ নির্বাচনকে অপরিহার্য করে তুলতে পারে। জনগণ তা প্রত্যাশাও করে।
বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়পর্যায়ে ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগে নগ্ন দলীয়করণের ফলে মেধা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দলীয় পঙ্কে যেভাবে নিমজ্জিত হয়েছে সে দিকে দৃষ্টি দিলেই চলবে। যোগ্য ব্যক্তিদের ওপর দায়িত্ব না দিয়ে শুধু অযোগ্য অনুগতদের বাছাইকরণ শিক্ষকদের গুণগত মানকে কোনপর্যায়ে নিয়ে যাবে ভাবতে পারি না। অনেকেই অস্থির হয়ে ভাবেন, আগামী দিনগুলো কাটবে কিভাবে? তাই দেশের রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে দুর্বৃত্তায়নের নিয়ন্ত্রণ থেকে। রাজনীতিকে বের করে আনতে হবে মুক্ত আলোয়। তবেই প্রতিষ্ঠানের বিকৃতির অভিশাপ থেকে জাতি মুক্ত হবে।
জাতীয় রাজনীতির সব স্তরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং রাষ্ট্রীয় কীর্তকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতে হবে। সবপর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে জনগণের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা অত্যন্ত কাক্সিত পদক্ষেপ। নীতির স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি স্মরণযোগ্য যে, গণতন্ত্রের সঙ্কটে অধিক গণতন্ত্রই কাম্য পদক্ষেপ। গণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ অথবা গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি সঙ্কটকে জটিল করে তোলে। সঠিক নেতৃত্বের এসব বিষয়ে সম্মতি থাকা চাই।

No comments

Powered by Blogger.