মন্ত্রী-উপদেষ্টারা পদত্যাগ করেননি- সরকারের সঙ্গে দর কষাকষিতে এরশাদ

ঘটমান রাজনীতির রুদ্ধশ্বাস নাটক হঠাৎ যেন থিতিয়ে গেছে। সরকারের সঙ্গে চিরাচরিত দর-কষাকষিতে নেমেছে সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা)।

নির্বাচনকালীন সরকার থেকে জাপার বেরিয়ে আসার গরম ঘোষণা গতকালের নির্ধারিত সময়ে কার্যকর হয়নি। পদত্যাগ করেননি দলটির চার মন্ত্রী, দুই প্রতিমন্ত্রী ও এক উপদেষ্টা।
পদত্যাগ অবশ্য একরকম হয়েছে। জাপার মহাসচিব ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার দাবি করেছেন, তাঁরা (মন্ত্রী-উপদেষ্টারা) দলীয় চেয়ারম্যানের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
কিন্তু সংবিধানের ৫৮(১)(ক) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে যদি, তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র জমা প্রদান করেন।’
মঙ্গলবার নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ২৬ ঘণ্টার আত্মগোপন, বুধবার বিকেলে আবার দৃশ্যমান; ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক, তারপর সরকার ছাড়ার ঘোষণা; বৃহস্পতিবারের মধ্যে দলের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের পদত্যাগের নির্দেশ, বাড়ির সামনে র‌্যাব-পুলিশের আগমন; রাত সাড়ে সাতটায় স্ত্রী স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী রওশন এরশাদের গৃহপ্রবেশ-বোঝাপড়া এবং সর্বশেষ রাত সাড়ে ১১টায় ‘গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে আত্মহত্যার হুমকি’ দিয়ে ঘুমাতে যান এরশাদ।

গতকাল প্রথম আলোর এ-সংক্রান্ত খবরের শেষ লাইন ছিল ‘ঠিক কী কারণে এরশাদ আকস্মিক এ সিদ্ধান্ত (নির্বাচন ও সরকার বর্জন) নিয়েছেন, তা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়।’

 বিএনপি-জামায়াতের নয় দিনের অবরোধে হত্যা, মানুষ পোড়ানো, রেল উপড়ানো, বোমা-ককটেলে পর্যুদস্ত জাতিকে বেশিক্ষণ স্নায়ুচাপে রাখেননি এরশাদ। খোলাসা হতে শুরু করেছে সব।

দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে পতাকাবিহীন গাড়িতে চেপে রওশন এরশাদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছোটেন। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে খবর এল, পদত্যাগ নয়, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেলা আড়াইটার দিকে বেরিয়ে তাঁরা ছোটেন এরশাদের বাসা প্রেসিডেন্ট পার্কের দিকে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বেলা একটার পর তিন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে যান। ঘণ্টা খানেক কথা বলেন তাঁরা। তিন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনটি দাবি পেশ করেন। এরশাদের বিরুদ্ধে থাকা জেনারেল মঞ্জুর হত্যা ও জনতা টাওয়ার মামলা প্রত্যাহার এবং নির্বাচনের তফসিল কিছুদিন পেছানো।

প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করেন। আস্থা রাখতে বলেন। তফসিল পেছানোর বিষয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বলে মনে করিয়ে দেন। পাশাপাশি বর্তমান তফসিলে নির্বাচন করার পক্ষে তাঁর আগ্রহের কথা জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্য, আলোচনার একপর্যায়ে রওশন এরশাদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা পদত্যাগ করতে এসেছি।’ প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, ‘পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন রাষ্ট্রপতি। তিনি তো দেশে নেই।’ পদত্যাগ প্রসঙ্গ এখানেই পরিত্যক্ত হলো।

তিন মন্ত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে ঢোকেন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও নারী উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন আহমেদ। ঘণ্টা খানেক চলে আলোচনা। তাঁরা বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসস্থান গণভবনে চলে যান।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, গত দুই দিনের তুলনায় প্রধানমন্ত্রী গতকাল কিছুটা খোশ মেজাজে ছিলেন। একাধিক ঘনিষ্ঠজনকে তিনি বলেছেন, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। সময়মতো নির্বাচন করতে হবে।

বারিধারায় তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়-ফেরত জাপার তিন মন্ত্রী এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয় এরশাদকে অবহিত করেন। বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকের দল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যান রওশন এরশাদ।

বিকেলে রুহুল আমিন হাওলাদার নিচে নেমে সংবাদ ব্রিফিংয়ে দাবি করেন, তাঁর, বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদের, প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক ও সালমা ইসলামের পদত্যাগপত্র এরশাদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তাঁর ভাষ্য, ‘পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ আমাদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। তিনি এ নিয়ে দলের সবার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিদেশ থেকে ফিরলে দলের চেয়ারম্যান আমাদের পদত্যাগপত্র তাঁর কাছে জমা দেবেন।’ রওশন এরশাদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুও এরশাদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন বলে জানান তিনি।

জি এম কাদের এরশাদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে রুহুল আমিন হাওলাদার দাবি করলেও সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে পতাকাবাহী গাড়িতে করে এরশাদের বাসভবনে ঢোকেন জি এম কাদের। এরশাদের ভাই জি এম কাদের গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বেলা একটায় সচিবালয়ে যান। তবে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।

সন্ধ্যায় একে একে এরশাদের বাসায় আরও আসেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন আহমেদ। এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তাঁরা। বাসায় ঢোকার সময় নিচে দুই দিন ধরে অবস্থান নেওয়া দলের এরশাদ-সমর্থক কর্মীরা আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ‘দালাল’ বলে দুয়ো দেন। সূত্র বলছে, আনিসুল ইসলাম বাসায় গিয়ে বিষয়টি এরশাদকে জানালে তিনি কর্মীদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেন।

এরশাদের বাসভবনের সামনে আগের দিন অবস্থান নেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গতকালও মোতায়েন ছিল। গতকাল বিকেলের দিকে তাদের জনবল বাড়ানো হয়।

রাতে যমুনা গ্রুপের প্রধান নুরুল ইসলাম বাবুল এরশাদের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে একটি গাড়িতে ওঠানোর চেষ্টা করেন। বাধা দেন জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা। ধস্তাধস্তিতে জিতে তারা বাবুলকে এরশাদের বাসভবনের ভেতরে নিয়ে যান। নুরুল ইসলাম বাবুলের স্ত্রী সালমা ইসলাম জাতীয় পার্টির মনোনয়নে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতিমন্ত্রী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রকাশ্য আলোচনার বাইরে সরকারও নানা মাধ্যমে এরশাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে। এরশাদের দাবিদাওয়া জানার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব লোকজনের মাধ্যমে বিষয়টি দেখভাল করছেন।

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আকবর হোসেন আগের দিনের মতো গতকালও এরশাদের বাসায় যান। তিনি বেলা ১১টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ওই বাসায় ছিলেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তিনি আবার ফিরে আসেন এবং সাড়ে ছয়টার দিকে বেরিয়ে যান।

আগের রাতে আত্মহত্যার হুমকি দেওয়া এরশাদ গতকাল সারা দিন বাসায় ছিলেন। দিনের বেলায় কেবল একবার ফটকে এসে অক্ষেমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ভালো আছি।’

সর্বশেষ: রাত আটটা ২০: এরশাদের বাসায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদের প্রবেশ।

আটটা ৩০: নুরুল ইসলাম বাবুল ও রুহুল আমিন হাওলাদার এরশাদের বাসা থেকে বের হয়ে হাওলাদারের গাড়িতে চড়ে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ একজন উপদেষ্টার চায়ের দাওয়াতে যান।

নয়টা পাঁচ মিনিট: এরশাদের বাসা থেকে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের প্রস্থান।

রাত ১০টা: এরশাদ বাসার নিচতলায় নেমে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

সাংবাদিক: আজ জাপার মন্ত্রীদের পদত্যাগ করার কথা ছিল, কেন করেননি?

এরশাদ: সবার পদত্যাগপত্র আমার কাছে আছে। রাষ্ট্রপতি দেশে নেই। তিনি ফিরলে তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়া হবে।

প্রশ্ন: নিয়মানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিতে হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে কেন?

জবাব: মন্ত্রীরা শপথ নেন রাষ্ট্রপতির কাছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিলেও তিনি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান। আমরা সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দেব।

প্রশ্ন: আবার মত পাল্টাবেন না তো?

জবাব: আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এর বাইরে গেলে আমার মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

প্রশ্ন: নুরুল ইসলাম বাবুলকে ধরার চেষ্টা হয়েছিল কেন?

জবাব: সরকারের মনে কী আছে, জানি না। পরে ফোন করে মনে হয়েছে, সরকার মনে করে, আমি বাচ্চা ছেলে, ক্লাস ফাইভে পড়ি। আর বাবুল আমাকে শিক্ষা দেন।

সাংবাদিকদের সামলে এরশাদ তাঁর কর্মীদের কাছে জানতে চান, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে কে? তিনি কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার দলের মধ্যে সবাই জাতীয় পার্টি করে। কেউ আওয়ামী লীগ করে না। আমি ভদ্রলোকের রাজনীতি করি।’

No comments

Powered by Blogger.