বোতাম by গোলাম শফিক

কিছু একটা নিশ্চয় পড়েছে। নইলে শব্দটা হলো কেন? অফিসের করিডরে হাঁটার সময় পায়ের কাছে একটা মৃদু ধ্বনি পায় শাহেদ। হয়তো পকেট থেকেই পড়েছে কিছু। শাহেদ এদিক-ওদিক তাকাতেই একজন মেম্বার অব লোয়ার সাব-অর্ডিনেট সার্ভিসেস দৌড়ে এসে বলে, ‘স্যার বোতাম।’ তারপর তুলে দেয় হাতে। দেখে, ব্লেজারের ডানপাশের মাঝখান থেকে এটি ছিঁড়ে পড়েছিল। এর আগে শাহেদ লক্ষ করে বোতামটি নড়বড় করছে। কিন্তু আলসেমিবশত টাইট দেওয়া হয়নি। কাজটা কিছুটা জটিলও, তাই স্ত্রীর ভরসায় ফেলে রাখে। সম্পূর্ণ ছিঁড়ে আসায় ভরসাটা আরও বাড়ল। বিচ্ছিন্ন বোতামটাকে বুকের মাঝখানে লাইন বরাবর লাগাতে হবে, একই রঙের সুতোয়। এ কাজে বউ-ভগ্নিরাই পারদর্শী। এই যে এত এত বস্ত্রবালিকা প্রতি প্রত্যুষে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী মেখে ছুটে যায় কাজে, তা বঞ্চনা সত্ত্বেও এঁদের পারদর্শিতার জয়জয়কার ঘোষণা করে। শাহেদের মনে পড়ে রমণীদের বিশেষত্ব মূল্যায়নের কিছু স্মৃতি। ও তখন নবিশ, সবে মাত্র সার্ভিসে যোগ দিয়েছে। একজন সিনিয়র আপার সঙ্গে রুম শেয়ার করে বসে। এক দুপুরে শৌচাগার থেকে ফিরে এসে তড়িঘড়ি করে বাসায় ঘুরে আসার কথা বলতেই আপা হাসলেন। বললেন, ‘কেন—এ অল্প সময়ের মধ্যে বউয়ের মুখ দেখতেই হবে?’ 
নিলু আপা, জরুরি প্রয়োজন।’ ‘প্রয়োজনটা কী বলো না ছোকরা।’ শাহেদ লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে জানায়, ‘আমার প্যান্টের জিপারটা হঠাৎ করে লাগছে না, তাই একটু পাল্টে আসি আপা।’ নিলু আপা তাৎক্ষণিক কোত্থেকে একটি সেফটিপিন বের করে দিয়ে বললেন, ‘তার প্রয়োজন নেই, এটা লাগিয়ে নাও, তবে সাবধানে।’ শাহেদ লক্ষ করে, এ জন্য নিলু আপাকে ড্রয়ার খুলতে হয়নি। টেবিলের কলমদানির একপাশের পিন-ক্লিপের চেম্বারটিতে হাতও দিতে হয়নি। গায়ের কোথাও থেকে বিদ্যুৎগতিতে বের করে নিয়ে আসেন অথবা জাদুমন্ত্রের মতো আঙুলের ডগায় এসে বসে এটি। সেই থেকে শাহেদের ধারণা বদ্ধমূল, কিছু কাজে মেয়েদের ব্যুৎপত্তি ও দক্ষতা অনস্বীকার্য। ঘরে ফিরেই শাহেদ জানায়, ‘সোনিয়া, তোমাকে বলেছিলাম না, যেটি নড়বড় করছিল সেটি আজ সম্পূর্ণ খুলে পড়েছে।’ তারপর ব্লেজারের পকেট থেকে বের করে বোতামটি ওয়ারড্রবের ওপর রাখে। বলে, ‘টাইট করে লাগিয়ে দিয়ো।’ মেরুন কালারের ব্লেজারের সঙ্গে ম্যাচিং বোতামটি এক দিন, দুই দিন, তিন দিন ঘুমায় ওয়ারড্রবের ওপর। পরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। শাহেদ রাগত স্বরে বলে, ‘তোমাকে তখনই বললাম লাগিয়ে দাও, তা তুমি করলে না। এখন গেল তো!’ সোনিয়ার জবাব দার্শনিকতাপূর্ণ, ‘তুমি শুধু বলেছিলে যে ওটা রাখলাম এখানে, কিন্তু কোথায় রাখলে তা আমাকে দেখিয়ে দাওনি।’ ‘বলেছিলাম না, ওয়ারড্রবের ওপর।’ ‘ওয়ারড্রবের ওপর তো কত কিছুই রাখো। আর তখন তুমি “বোতাম” কথাটা একটুও উচ্চারণ করোনি।’ 
শাহেদ আর কথা বাড়ায়নি। ওয়ারড্রবের ওপর প্রতিটি বস্তু তুলে পরখ করে দেখেছে, দেখেছে প্রতিটি বক্সের ভেতর। ঘরের মেঝের আনাচ-কানাচে ঝাড়ু দিয়ে বহু বছরের পুরোনো ময়লা ও ঝুল পরিষ্কার করেছে। সে সময়ও ও বলে, ‘দ্যাখো তো সোনিয়া, সকালে আইডি কার্ড আর সঙ্গের কাগজগুলো পকেটে ভরার মুহূর্তে হালকা একটা শব্দ শুনেছিলাম, হয়তো মেঝেতেই পড়েছে আবার।’ দুজন তন্ন তন্ন করে খোঁজে। সোনিয়া খাটের নিচে পায় এক টাকার ধাতব মুদ্রা আর কনট্রাসেভটিভের একটি খালি ছেঁড়া পলি। শাহেদ কষ্টের মধ্যেও রসিকতা করে, ‘হ্যাঁ, তখন একটির দাম এক টাকাই ছিল।’ এ যেন এক ইতিহাস। কত বছর পার হয়ে গেছে! খাটের নিচে দিনের বেলায় টর্চ মেরে মেরে নেয়ে উঠেছে শাহেদ। ‘আচ্ছা, আজ কি এশামণি এসেছিল?’ ‘কেন, এ প্রশ্ন কেন?’ ‘এমনি বলছি।’—শাহেদ মৃদুস্বরে জবাব দেয়। ‘আসলেই কী? ওর হাত কি ওখানে যায়?’ ‘না, তুমি তো ওকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য ওয়ারড্রবের ওপরে কত কিছু দেখাও। কখনো এটা-সেটা দাও।’ ‘বিশ্বাস করো, আমি তোমার ব্লেজারের বোতামটা কখনো দেখিনি।’ ‘তা হলে কি মিথ্যা বলছি?’ ‘সে তুমিই জানো। তবে আমি তা বলছি না।’ শাহেদ কথা না বাড়িয়ে আজকের মতো ক্ষান্ত দেয় উদ্ধার অভিযানে।
২. ইন্দোনেশিয়ার বন্ধু উতোমো তৃতীয় দেশের রাজধানী সোউলে এটি ওকে উপহার দিয়েছিল। শাহেদের একটি গিফট পেয়ে উচ্ছ্বাসে গদগদ উতোমো আর কিছু চিন্তা না করেই গা থেকে খুলে দেয় ব্লেজারটি। এহেন মেরুনরঙা আর কোনো ব্লেজার, কোট বা কোর্তা কোথাও দেখেনি সে। এই স্মৃতিকে সে টেনেছে সাত বছর। আফটার অল, অ্যা গিফট ফ্রম এ ফরেন ফ্রেন্ড। কিন্তু এত বছর পর পোশাকটির অঙ্গহানি হওয়ায় শাহেদের মন খারাপ হয়ে যায়। একটা বিষণ্নতা পেয়ে বসে ওকে। অতিশয় কারুকার্যময়, কী চমৎকার দেখা যেত। এখনো দেখায় বাকি পাঁচটিতে—দুটি বাঘ কিংবা সিংহ একটা কিছুকে অবলম্বন করে মুখোমুখি পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন দেশের ন্যাশনাল অ্যান্থেম? ইন্দোনেশিয়ার, সে তো এক গারুদা। অন্য একটি দেশের জাতীয় প্রতীকের সঙ্গে কিছুটা সামঞ্জস্যময়। ওরা বলে ‘জাতা নেগারা’। শাহেদ ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাসে এটিকে বারবার পরখ করে। গ্লাসটি কাছে-দূরে করলে প্রতীকটি বড়-ছোট হয়। রাতে ঘুমিয়ে পড়লে শাহেদ দেখে, বোতামের জন্তুগুলো ওকে আক্রমণ করতে এসেছে। আতশি কাচে দেখার মতো এগুলো বড় হয়, ছোট হয়। সে ভয়ে নড়েচড়ে ওঠায় খাট থেকে পড়ে গেলে ওর বউ বলে, ‘কী হয়েছে?’ ‘কিছু না, বোতাম।’ ‘সোনিয়ার হাতের তালু একপাশ খালি বিছানায় ঘষে ঘষে খাটের কিনারায় যায়। তারপর উপুড় হয়ে হাত মেঝে স্পর্শ করার আগেই শাহেদের স্পর্শ পায়। ‘বোতামটা পেয়েছ নাকি?’ ‘না।’ ‘তাহলে?’ ‘জানি না।’
৩. কোনো পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য শাহেদের একমাত্র ইনপুট তার মনোবেদনা। বোতামটির কথা সে ভুলতেই পারে না। আপাতত সে ভাবে, ডানপাশের বোতাম গেছে তাতে কী, একই হরিজন্টাল লাইন থেকে বাঁ পাশেরও একটা তুলে ফেলবে, তাতে আর বেখাপ্পা দেখাবে না। কাট ইয়োর বাটন অ্যাকোর্ডিং টু ইয়োর...। কিন্তু পড়ে যাওয়া বোতামটি মাঝখানের। একপাশের হলে সেটি করা যেত। না হয় একপাশ খালি করে বাকি চারটা বোতাম পুনঃস্থাপন করা যাবে। পরবে তো বছরে মাত্র দুই মাস। কিন্তু শাহেদের কাছে পরিকল্পনাটা আদৌ মানানসই ঠেকল না। কেমন খালি খালি লাগবে। বিকল্প পরিকল্পনাটিও জুতসই মনে হয়নি তার। সেটি ছিল দুই হাতার ছয়টি বোতামের যেকোনো একটিকে বুকে পুনঃস্থাপন; যেমন প্লাস্টিক সার্জারি করে উরুর মাংস লাগানো হয় কপালে। কিন্তু হাতেরগুলো পৃথক সেট, সাইজে অনেকটাই ছোট। তার চেয়ে পুরো সেট পরিবর্তন করা ঢের ভালো। আচ্ছা, উতোমোকে মেইল করলে কেমন হয়? ভাবনামতো উতোমোকে মেইল করেও কোনো জবাব পায় না। তবে বোতামের সেট পরিবর্তনের আগে বিভিন্ন মার্কেট খুঁজে দেখা যেতে পারে। শাহেদ বঙ্গবাজারের পুরোনো কাপড়ের মার্কেট,
ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাত, গুলিস্তান—সর্বত্রই বোতামটি খোঁজে।ফুটপাতের এক বোতামওয়ালা বলে, ‘স্যার, কুটের একটা বোতাম খুইল্লা নিয়া আহেন, মিলাইয়া দেহি।’ ‘খুললে তো লাগানো বড় কষ্ট ভাই।’ ‘তাইলে বেলেজার নিয়া আহেন।’ পরদিন সে ব্লেজার হাতে নিয়ে বোতামগুলো দোকানিকে দেখায়। তাৎক্ষণিক কোনো ম্যাচিং হয় না। তবে দোকানদার দেখবে বলে একটা বোতাম খুলে রেখে দেয়। শাহেদ ফুটপাত ধরে হাঁটছে। মাথার ওপর তীব্র রোদ। একজন তার হাতে ব্লেজার দেখে বলে, ‘কী শাহেদ ভাই, খবর কী, ফরেন মিনিস্ট্রিতে পোস্টিং হইছে নাকি?’ ‘না রে ভাই, একটা সেমিনারে আসছিলাম।’ শাহেদের মনে খেলা করে সেই বোতাম ও বন্ধুর মুখ। তবে এ দুয়ের মধ্যে তীব্র বৈপরীত্য। একদিকে আজব প্রাণী ও অন্যদিকে বন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল মুখ। এ দুই বিপরীতধর্মিতা একসূত্রে মিলিত হয়ে শাহেদকে যুগপৎ যন্ত্রণা ও আনন্দে অবগাহন করায়। তবে বোতামটি হারিয়ে যাওয়ার পর শাহেদ উতোমোকে ফিরে পেতেই বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়। এ কারণে নয় যে, বন্ধুকে ফিরে পেলে সে বোতামটিও পাবে। পরদেশে এমন অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু ওরা একে একে সব হারিয়েও যায়। শাহেদ উতোমোকে অন্তত হারাতে দেবে না। এ বন্ধুর উপঢৌকনটি ছিল খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ। কিন্তু এত দিন অন্যান্য বিদেশি বন্ধুর মতো উতোমোকেও সে ভুলতে বসেছিল।
৪. মেইল করে সাড়া না পেয়ে শাহেদ নানা কিছু ভেবেছে। হয়তো ই-মেইল আইডির পরিবর্তন বা পারমানেন্টলি ক্লোজড। বদনবইয়েও ঘাঁটাঘাঁটি কম করেনি। তবে আকাশজোড়া মেঘের অন্ধকার ভেদ করে আকস্মিক এক ঝলক রোদ উঁকি দেয়। ইন্টারনেটে চাউর হয়, সে ইন্দোনেশিয়া গমনের একটি সুযোগ পেয়েছে অল্প কদিনের জন্য। ইতিমধ্যে সে উতোমোর দপ্তরের ঠিকানাটি বগলদাবা করে ফেলে। আর বোতামের একটি স্যাম্পলও আগেভাগে ব্যাগে পুরে রাখে। হলে কী হবে, গারুদার দেশে গিয়ে সে আগের চেয়ে বেশি হতাশ। উতোমোর দপ্তরের ঠিকানা ধরে গিয়ে শোনে ও চাকরি বদল করেছে। তার বর্তমান দপ্তরের ঠিকানাটি কেউ নিশ্চিত জানে না। কেউ কেউ একটা দিকনির্দেশনা দিতে চাইলেও ভাষাগত কারণে সেটা অতটা ফলপ্রসূ হয়নি। ওদিকে নিজের মনের দুঃখটা শাহেদ কাউকে বুঝিয়েও বলতে পারে না। হঠাৎই চার দিনের সিম্পোজিয়াম শেষ। একটি শূন্যতা ও হাহাকারের সুর বেজে ওঠে। রাতে একটি পার্টি বসে বিদেশিদের জন্য। মনমরা ভাব কাটাতেই কেবল পার্টিতে যায় শাহেদ। ওখানে নৈশাহারের পর স্থানীয় ট্র্যাডিশনাল মিউজিককে ছাপিয়ে একটি পশ্চিমা মিউজিক হঠাৎ করেই বেজে ওঠে। মিউজিকের সঙ্গে মৃদু তালে কেউ কেউ নাচছে। শাহেদ ফ্লোরে যায় একটি কোমল পানীয়র গ্লাস হাতে নিয়ে, অতিথিদের সে ভাবার সুযোগ দিয়েছে। ফ্লোর অতিক্রম করে সে ওই পাশে যাচ্ছে আরও ড্রিংক আনতে। তবে মাঝখানে কয়েক মুহূর্ত থেমেছিল। 
আবার চলে যাচ্ছে দেখে নৃত্যরতা রমণীটি বলে, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট টু ডান্স?’ শাহেদ কিছু না বলে ড্রিংকসের এক সারি বোতলের পাশে গ্লাসটি রেখে মাঝখানে এসে নাচতে শুরু করে। রমণীটি কিছুটা স্থূলাঙ্গী। একটি স্কার্ট ও ব্লেজার পরে সে হালকা তালে নাচছে। হাঁটুর নিচ থেকে পা জোড়া দৃশ্যমান। পায়ের নিচে হাইহিল তাকে অনিন্দ্য সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলেছে। কিন্তু শাহেদ ওই দিকে না তাকিয়ে বারবার মহিলার বুকের দিকে তাকায়। তার চোখ রমণীটির বুক বরাবর ব্লেজারের বোতামের ওপর চলে যায় উপর্যুপরি। কখনো বুকের কাছে মাথা নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঈষৎ আলোয়। ‘ম্যান, আই এম এ মুসলিম লেডি। ডোন্ট সি মি লাইক দ্যাট।’ ‘ইউ হ্যাভ নাইস বাটন।’ ‘ও, রিয়েলি?’ পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সারা দিনই কর্মহীন শাহেদ। তার ফ্লাইট সন্ধ্যা পেরিয়ে। স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনেছে, ওখানে বোতামের একটি আলাদা মার্কেটই আছে। আয়োজক সংস্থার একজনকে নিয়ে সেখানে যায় সে। রং-বেরঙের বোতাম দেখে এক প্রকার বিভ্রম জাগে তার। তৃতীয়বার বোতাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে এক সেট মেরুন বোতাম কিনে নেয় তাৎক্ষণিক। তা সত্ত্বেও মূল বোতামটি বারবার দোকানিদের দেখায়। ভাবে, আঁতুড়ঘরে হয়তো পেয়েও যেতে পারে। বোতামটি দেখে এক দোকানি আমতা আমতা করে বলে, ‘ইউ ক্যান ফাইন্ড ইট ইন মালয়েশিয়া।’

No comments

Powered by Blogger.