খোলা চোখে- মুক্তিযুদ্ধ না গণতন্ত্র? by হাসান ফেরদৌস

এক অর্থহীন, অযৌক্তিক বাদানুবাদে, সোজা বাংলায় এড়ে তর্কে আমাদের ‘বাচাল শ্রেণী’ মেতে উঠেছেন। এঁদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশের জন্য কোনটা বেশি জরুরি: গণতন্ত্র, না মুক্তিযুদ্ধ?

যে সংকটের দোরগোড়ায় এখন বাংলাদেশ এসে পৌঁছেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ তর্কের অবতারণা। কারও কারও বিশ্বাস, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মোর্চা ক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে গত সাড়ে চার দশকে—বিশেষত গত পাঁচ বছরে—মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত করতে বাংলাদেশ যে অর্জন করেছে, তার অনেকটাই বিলুপ্ত হবে। সবচেয়ে বড় ভয় একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার নিয়ে। আপিলের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় ঘোষিত রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। যদি জানুয়ারির নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিসমূহ ক্ষমতা দখলে সক্ষম হয়, তাহলে তাদের একটা বড় লক্ষ্য হবে এই বিচারের রায় বাতিল ঘোষণা।
এমন ধারণার পেছনে একদম যে যুক্তি নেই তা নয়। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যে কজন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির নেতা। বিশেষ আদালতে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার সময় থেকে জামায়াত এই বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। প্রতিটি রায় ঘোষণার সময় ও পরে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে শুধু নিরীহ নারী-পুরুষ নয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সদস্যরাও হতাহত হয়েছেন। শুধু জামায়াত নয়, এই তাণ্ডবের পেছনে প্রধান বিরোধী দলটির স্পষ্ট সমর্থন রয়েছে, এমন কথা ভাবারও কারণ রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপির অন্যতম নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় ঘোষিত হওয়ার পর এ দলের একজন প্রথম সারির নেতা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে শুধু বিচারের রায়ই বদলানো হবে না, যাঁরা সেই বিচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেই সব বিচারপতি ও কৌঁসুলিকেও তাঁরা ‘দেখে নেবেন’।
সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলসমূহের এই আন্দোলন ভয়াবহ রক্তপাতের কারণ হয়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ নিরীহ—রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়—এমন নারী-পুরুষ ও শিশু হতাহত হয়েছে। যারা এই রক্তপাতের জন্য দায়ী, তারাই যদি ক্ষমতা দখল করে, ভাবা অযৌক্তিক নয়, তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বিসর্জন দেবে না, সম্ভবত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেও কার্পেটের নিচে লাথি মেরে ঢোকাবে। যাঁরা এই যুক্তিতে বিশ্বাস করেন, তাঁদের প্রস্তাব, এই মুহূর্তে গণতন্ত্র রক্ষার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ধরে রাখা। আর সে জন্য যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে কিছু ‘আপস’ করতে হয়, তা-ও ভালো।
এই যুক্তি অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই মুহূর্তে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জোটটির বিজয়ের সম্ভাবনা আছে। আর তা ঠেকাতেই সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিতে হবে। এমনকি এর জন্য যদি বর্তমানের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বনকারী সরকারটিকে কিছু কিছু আপাততভাবে অগণতান্ত্রিকও ব্যবস্থা নিতে হয়, তবুও।
যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের এই আপাত বৈপরিত্যের কথা বলেন, তাঁরা যেমন গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি নন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্গত শক্তি সম্পর্কেও পুরোপুরি সচেতন নন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নির্মিত হয়েছিল বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে। যে চার নীতির কথা আমরা বলি, তার কেন্দ্রীয় সূত্রই ছিল গণতন্ত্র। একাত্তর-পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে চোরাবালুতে মাথা ঠুকরে পড়ে, তার কারণ একদল মানুষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা অর্জনকে তাদের অগ্রাধিকার বিবেচনা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণেই দরকার পড়েছিল গণতন্ত্রকে ঝেটিয়ে ফেলা। আমার ভয়, মুক্তিযুদ্ধ বনাম গণতন্ত্রের ঝুট বাদ-বিবাদে আমরা সেই ভুলই স্বীকার করে নিচ্ছি। এক নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন নস্যাৎ সম্ভব নয়। কেউ সেই চেষ্টা করলে দেশের মানুষ তার প্রতিরোধ করবে। দেশের মানুষের ভেতরে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আনুগত্য না থাকে—তাদের বোধ ও বিশ্বাসে মরচে ধরে যায়—তাহলে গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে সেই চেতনার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।


গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এক অভাবনীয় হত্যাযজ্ঞ চলছে বাংলাদেশে। হরতাল ও প্রতিরোধের নামে এমন এক পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা চলছে, যার কারণে অশাসনতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামেই এই পাঁয়তারা, অথচ এখন দিনের মতো ফরসা যে এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে সবার আগে বিসর্জিত হবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা।
কারা এই রক্তের হোলিখেলায় নেমেছেন? প্রথম আলোর প্রতিবেদনেই দেখেছি, বোমা ছোড়ার আগে হাতেনাতে ধরা পড়া এক বালক স্বীকার করেছে, বিএনপির এক নেতা তাকে নগদ টাকা দিয়ে এ কাজে প্রলুব্ধ করে। অন্যান্য তথ্যমাধ্যমেও আমরা সেই অভিযোগের প্রমাণ দেখেছি। সেই সব প্রতিবেদনের প্রতিবাদ বিএনপি কর্তৃপক্ষ করেছে, তা চোখে পড়েনি।
যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই তাদের উদ্দেশে একটি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। রাজনৈতিক সহিংসতা এখন আর শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন উদাহরণ দেখেছি, যেখানে রাজনৈতিক বা নির্বাচনসংক্রান্ত সহিংসতার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে।’ (মূল বিবৃতিটি পড়ুন: http://bit.ly/1jcLZbO)।
২০০৭-০৮ সালে কেনিয়ায় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ এক অভাবনীয় সহিংসতায় মেতে ওঠে। একদিকে সংখ্যাগুরু কিকুয়ি গোত্র, অন্যদিকে লুয়ো। দুই গোত্রের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয় প্রায় দেড় হাজার মানুষ, গৃহহারা হয় পাঁচ লাখের অধিক। হেগ-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজ উদ্যোগে এই সহিংসতা বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর পর মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ২০১৩ সালে নির্বাচিত কেনিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা। ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সহিংসতার সময় কেনিয়াত্তা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। অভিযুক্ত বাকি পাঁচজনও নানা রকম সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এঁদের একজন একটি রেডিও স্টেশনের প্রধান হিসেবে গোত্রগত ঘৃণা ছড়াতে বড় ভূমিকা পালন করেন।
হেগে আদালতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই ছয়জনের বিরুদ্ধে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কাজে তাঁদের দেশে থাকা জরুরি এবং মামলার প্রস্তুতির জন্য আরও সময় প্রয়োজন—এই অজুহাতে প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তা ও তাঁর দল বার কয়েক বিচার শুরুর তারিখ পেছাতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু আর নয়, অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে তাঁদের বিচারের কাজ শুরু হবে। অভিযুক্ত প্রত্যেককে বিচারের সময় হেগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
নাভি পিল্লাই প্রকারান্তরে বাংলাদেশের নেতাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, নির্বিকার গণসহিংসতার জন্য তাঁরাও অভিযুক্ত হতে পারেন। যাঁরা এই সহিংতার জন্য দায়ী, তাঁরা ব্যাপারটাকে যেন গুরুত্বের সঙ্গে নেন, সে জন্য মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার নিজে এই বিবৃতি দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিয়ম অনুসারে চুক্তিবদ্ধ যেকোনো দেশ বিচার প্রার্থনা করতে পারে। কিন্তু কোনো রাষ্ট্র তার সরকারের মাধ্যমে বিচার প্রার্থনা না করলে আদালত নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করতে পারেন এবং তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। কেনিয়ার ক্ষেত্রে ঠিক সে ঘটনাই ঘটেছে।
সহিংসতা দমনে এই আন্তর্জাতিক আইনের পূর্ণ সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে মানবাধিকার-সম্পর্কিত নাগরিক সংস্থাসমূহের। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড, প্রতিটি সহিংসতার ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করে তথ্য-প্রমাণসহ তার পূর্ণাঙ্গ অভিযোগনামা প্রস্তুতের এখনই সময়। একাত্তরে ঘাতক-দালালদের সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হয়নি, ফলে তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণপত্র নেই, এমন অভিযোগ দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে আমরা শুনেছি। সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর হতে দেওয়া যায় না। আমাদের চোখের সামনে নিহত হচ্ছে নিরীহ মানুষ, আগুনে ঝলসে যাচ্ছে শিশু, নারী ও পুরুষ। শুধু ন্যায়বিচারের খাতিরেই নয়, এসব মানুষের প্রতি আমাদের নাগরিক দায়িত্ববোধ থেকেও প্রতিটি অপরাধের পর্যাপ্ত তদন্ত সম্পন্ন করা উচিত।
আর সে কাজ করতে হবে আজ, এখনই।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.