জননিরাপত্তাই মানবাধিকার
মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার মানবাধিকারের মূল বিষয়। জনসাধারণকে নিরাপদ রাখা এবং স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীতে ন্যায়নীতির প্রতিফলনের মাধ্যমে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য কর্তব্য এবং নাগরিকদের ইমানি দায়িত্ব। সুতরাং মানবসমাজে কোনো রকম অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, অগ্নিসংযোগ, রক্তপাত, গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইসলামে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ তাআলা সাবধানবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর এতে বিপর্যয় সৃষ্টি কোরো না।’ (সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ৫৬) প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় তুলে ধরে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ।’ (বুখারি ও মুসলিম) সমাজে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, কলহ-বিবাদ ও সন্ত্রাস-সহিংসতাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে; সকল প্রকার হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত ও অরাজকতা প্রত্যাখ্যান করেছে; সৎ কাজে সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছে, চরম পন্থা অবলম্বন ও জুলুম-নির্যাতনমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেতনা, মানবতাবাদী অর্থনৈতিক দর্শন ও অপরাধ দমন কৌশল ইসলামকে দিয়েছে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা। কিন্তু শান্তির ধারক-বাহক নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে সর্বদাই অশান্তিকামী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী স্বার্থপর লোকেরা খড়্গহস্ত থাকে। নিরীহ মানুষকে হত্যা করা ইসলাম কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের গুলি করে, বোমা মেরে বা অগ্নিসংযোগে হত্যা করা ইসলামের সঙ্গে কখনো সংগতিপূর্ণ নয়। নাশকতামূলকভাবে মানুষ হত্যা, জানমালের ক্ষতিসাধন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করাকে কবিরা গুনাহ আখ্যায়িত করে এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২)
আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা কোরো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৩) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি) মানবসমাজে অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, হানাহানি ও সন্ত্রাস দমনে শান্তির ধর্ম ইসলাম কঠোর দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে কঠিন শাস্তি আরোপ করেছে। ইসলামের আলোকে যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত আইনে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের উপযুক্ত ন্যায়বিচার করা হয়, তাহলে আর কেউ নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সাহস পাবে না। পবিত্র কোরআনে গণহত্যাকে জঘন্য অপরাধ সাব্যস্ত করে ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যা করার শাস্তির কঠোর বিধান সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে সে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে, অবশ্য ভুলবশত করে ফেললে অন্য কথা। ...আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৯২-৯৩)
শান্তির ধর্ম ইসলামের মর্মবাণীর মাধ্যমে সারা বিশ্বে শান্তি-শৃঙ্খলা ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সংঘাতমুক্ত পৃথিবীর প্রয়োজনে ইসলামের জনকল্যাণধর্মী নীতি অনুসরণীয়। মানুষের সামগ্রিক জীবনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধানে ইসলাম এক অনন্য কালজয়ী আদর্শ। ইসলামে চরম পন্থা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের স্থান নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো একজন নিরপরাধ মানুষকে প্রকাশ্যে বা গুপ্তহত্যা করেননি। শত অত্যাচার ও নির্মম-নির্যাতন সহ্য করেও তিনি কখনো বাড়াবাড়ি, কঠোরতা বা গোঁড়ামির পরিচয় দেননি, বরং দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে চরম পন্থার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ইসলামের প্রতিরক্ষামূলক সমরনীতি ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা কখনো আগে অস্ত্র উত্তোলন কোরো না বা অস্ত্রের ভয়ভীতিও প্রদর্শন কোরো না।’ অথচ দেশে যেভাবে ফিতনা-ফ্যাসাদ, গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন চলছে, সর্বস্তরে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগে জনদুর্ভোগ হচ্ছে, এতে যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম ব্যাঘাত হচ্ছে, তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। যে সমাজে মানবাধিকারের গ্যারান্টি নেই, সেই সমাজে আইনের শাসন নেই। জানমালের নিরাপত্তাই যদি বিঘ্নিত হয়, তাহলে মানুষ সমাজে কীভাবে একত্রে শান্তিতে বসবাস করবে? ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের অনিবার্য পরিণতিতে নির্মমভাবে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ও অগ্নিসংযোগে হত্যাকাণ্ড, অমানবিকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় ঘৃণা ব্যক্ত করে জোরালো প্রতিবাদ জানানো এবং জনগণের জানমাল রক্ষায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ও দেশের কল্যাণার্থে মানবতার ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বিবদমান দল-মত-গোষ্ঠীর জরুরি ভিত্তিতে পারস্পরিক সংলাপ ও সমঝোতায় উপনীত হওয়া দরকার।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments