আজ স্বৈরাচার পতন দিবস- সেই এরশাদই এখন রাজনীতির কেন্দ্রে
আজ ৬ ডিসেম্বর, স্বৈরাচার পতন দিবস। ১৯৯০
সালের এই দিনে গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা
ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।দেশ মুক্ত হয়েছিল ‘বিশ্ব বেহায়ার খপ্পর’ থেকে।
তবে ২৩ বছর পর এই দিনটিকে এখন স্বৈরাচার উত্থান দিবস হিসেবেও পালন করা যেতে পারে। কারণ, কাকতালীয় হলেও এবারের স্বৈরাচার পতন দিবসে এরশাদই থাকছেন নির্বাচনী গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম মূল চরিত্র হয়ে। আজ ৬ ডিসেম্বর, সবারই নজর থাকবে এই এরশাদের ওপরেই। তিনি কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটিই এখন আলোচনার মূল বিষয়, রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক।
একতরফা নির্বাচনকে খানিকটা গ্রহণযোগ্য করতে আওয়ামী লীগের সরকার এখন এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে ধরে রাখতে দর-কষাকষি করছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেষ্টা করছে হঠাৎ করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া এরশাদ যেন তাদের সঙ্গেই থাকে। মূলত ২৩ বছর ধরে স্বৈরাচার এরশাদকে বর্জন করার পরিবর্তে নির্বাচনী রাজনীতিতে সুবিধা পেতে আন্দোলনকারী দুই দলই অব্যাহতভাবে তাঁকে এভাবেই নিজেদের বলয়ে রাখতে চেষ্টা করে আসছে।
অথচ এই দুই দলই জনগণের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে আন্দোলন করে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটায়। আর এখন এই দুই দলই দায়সারাভাবে দিবসটি পালন করে আসছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল এবার দিবসটি নিয়ে অনেকটাই নীরব। যদিও দিনটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১৯৯০ সালের এই দিনে স্বৈরাচারের পতন হয়।’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে কোথাও এরশাদের নাম উল্লেখ করেননি। এরশাদও এখন তাঁকে স্বৈরাচার বললে ক্ষুব্ধ হন বলে তাঁর দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন।
দিবসটি উপলক্ষে বিএনপি থেকে কোনো কিছুই বলা হয়নি। খালেদা জিয়াও কোনো বাণী দেননি।
রাজনৈতিক দলগুলো নানা হিসাব-নিকাশের কারণে স্বৈরাচার এরশাদ নিয়ে নীরব নীতি পালন করলেও দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে এখনো এরশাদ একজন সাবেক স্বৈরাচার। ফলে গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) আয়োজনে ডা. মিলন দিবসে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রওশন এরশাদকে। চিকিৎসকেরা এখনো ডা. মিলনকে হত্যার জন্য এরশাদের বিচার চেয়ে আসছেন। অথচ এরশাদকে নির্বাচনে রাখতে তাঁর স্ত্রী, সাবেক ক্ষমতাশালী ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদকে এই নভেম্বর মাসেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয় সরকার।
দিনটি পালনের প্রাক্কালে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেছেন, শাসক শ্রেণীর দলগুলোর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে নব্বইয়ের পরাজিত এরশাদ সরকার আর একাত্তরের পরাজিত জামাত-শিবির এখন রাজনীতিতে পুনর্বাসিত। রাজাকার, স্বৈরাচার আর তাদের আদর্শহীন আশ্রয়দাতাদের প্রত্যাখ্যান করার সময় এসেছে।
স্বৈরাচার দিবস পালন উপলক্ষে আজ বিকেল চারটায় রাজধানীর মুক্তিভবনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে সিপিবি ও বাসদ। অন্যদিকে একই উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ ডেকেছে গণফোরাম। ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় সমাবেশে স্বৈরাচার পতনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ ডা. মিলনের মা বক্তব্য রাখবেন।
২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ সামরিক আইন জারি করেন এবং বিএনপির রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর দুই দফা বিতর্কিত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ ও বামপন্থী ৫-দলীয় জোট একসঙ্গে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চিকিৎসক নেতা শামসুল আলম খান মিলনের মৃত্যু আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত করে। শুরু হয় গণ-অভ্যুত্থান। ৪ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ পদত্যাগ ও তিন জোট মনোনীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেন।
৬ ডিসেম্বর উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ (বর্তমান কারাবন্দী বিএনপির নেতা) পদত্যাগ করেন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ওই দিনই রাষ্ট্রপতির পদ থেকে এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ক্ষমতা হারানোর পর এরশাদ গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরশাদ পতনের পর দুবার বিএনপি ও দুবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসেছে। এই দুই দলই ক্ষমতায় থাকার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এরশাদ ও তাঁর জাতীয় পার্টির সহায়তা চেয়েছে। তবে বেশি সহায়তা পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
No comments