মুক্তবুদ্ধির প্রাজ্ঞপুরুষ by আবুল আহসান চৌধুরী

বহুমাত্রিক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানসাধক, দাবাড়ু, সংগীত-সমঝদার, সাহিত্যসেবী—নানা অভিধায় চিহ্নিত হলেও তাঁর মূল পরিচয় সংস্কৃতিসাধক ও সমাজভাবুক মননশীল লেখক হিসেবেই। তাঁর প্রথম বই, প্রবন্ধসংকলন সঞ্চরণ, প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে ১৯৩৭-এ। এই বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘আপনি বিচিত্র ভাবকে এবং আলোচনার বিষয়কে স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষায় রূপ দিয়ে যে প্রবন্ধগুলি আপনার সঞ্চরণ গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন তা পড়ে পরিতৃপ্ত হয়েছি। আপনার বলবার সাহস এবং চিন্তার স্বকীয়তা সাধুবাদের যোগ্য। সাহিত্যপথে আপনার অধ্যবসায় জয়যুক্ত হোক এই কামনা করি।’ রবীন্দ্রনাথের এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য মোতাহার-মানস ও তাঁর রচনা-বৈশিষ্ট্যের প্রতি যথার্থ ইঙ্গিত দেয়। ‘স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষা’, ‘বলবার সাহস’ ও ‘চিন্তার স্বকীয়তা’র আদর্শ উত্তরকালে মোতাহার হোসেনের রচনাকে আরও মনোগ্রাহী ও স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করে তোলে। তাঁর চিন্তা-চেতনায় যে সমাজমনস্কতা ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় মেলে, তা তিনি মূলত পেয়েছিলেন ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’-এর সূত্রে। প্রকৃতপক্ষে উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব থেকে বাঙালি মুসলমান সমাজে আধুনিক শিক্ষা ও সাহিত্য-প্রয়াসের উদ্যোগ রচিত হয়। গড়ে ওঠে সমাজ ও সম্প্রদায় সম্পর্কে সচেতনতাবোধ। সমাজ-জাগরণের এই ধারায় প্রাণিত হয়ে বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ঢাকায় গড়ে ওঠে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’। বুদ্ধির মুক্তিই ছিল এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের ভেতর দিয়ে একটি সংস্কারমুক্ত আধুনিক প্রগতিবাদী সমাজ গড়ে তোলাই ছিল এই প্রতিষ্ঠানের অন্বিষ্ট।
এই সংগঠনই মোতাহার হোসেনের মন-মনন-মানসে মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিচিন্তার বীজ বপন করে দেয় এবং কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তচিন্তার একনিষ্ঠ সাধক। ‘সাহিত্য-সমাজে’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার এবং এই সংগঠনের মুখপত্র শিখার সম্পাদক হিসেবে তিনি যে মুক্তবুদ্ধি ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, তা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর রচনায়। মোতাহার হোসেন তাঁর মননচর্চার প্রেরণায় পটভূমি ও তার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য এবং বিষয় ও প্রকরণ সম্পর্কে নিজেই পাঠককে ধারণা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন: ‘বস্তুতঃ সমাজে সংস্কৃতি, শিল্প ও ধর্ম নিয়ে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে বাঙালী মুসলমান সমাজে যে নতুন চিন্তার উদ্্গম হয়—নব-জাগরণের সেই চিন্তার ধ্বনি আমাদের সকলের চিন্তায় আশ্রয় গ্রহণ করে। আমার অনেকগুলি প্রবন্ধে সেই মানসিকতার ছাপ রয়ে গেছে। বিশেষ ক’রে যে-গুলো ধর্ম, সমাজ, শিল্প, সংগীত ও সংস্কৃতি নিয়ে সে-গুলোর মধ্যে’। পাশাপাশি তিনি তাঁর রচনার শিল্পগুণ রক্ষার ব্যাপারে যে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, সে-বিষয়টিও স্পষ্ট করে বলেছেন: ‘একটি কথা আমি আমার পাঠকদের বলব, আমার লেখায় প্রসঙ্গক্রমে ধর্ম ও সমাজের কথা অনেকবার এসেছে, এসেছে সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের কথা, শিল্প ও সংগীতের কথা—কিন্তু সে-সব কথা যাতে রিপোর্ট অর্থাৎ বিবরণী না হ’য়ে যায় সে দিকে আমার লক্ষ্য ছিল। আমি সাহিত্যকে সাহিত্য-রস থেকে বঞ্চিত করে বুদ্ধির ও বিজ্ঞানের ওকালতি করিনি। সে-জন্যেই রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আমার প্রথম প্রবন্ধ-গ্রন্থ সঞ্চরণ-এর কিছু প্রশংসা করেছিলেন’। মোতাহার হোসেনের চিন্তা-চেতনার মূল ধারাটি তাঁর সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম,
বিজ্ঞান ও ভাষা-সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধের মাধ্যমেই প্রকাশিত। তাঁর সমাজবীক্ষণ মূলত বাঙালি মুসলমান সমাজকেন্দ্রিক হলেও তা প্রসঙ্গক্রমে সমগ্র বাঙালি সমাজকেও অনেক সময় স্পর্শ করেছে। বাঙালি মুসলমানের সংকট-সমস্যা-অবক্ষয়-অনগ্রসরতার কার্যকারণ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। ‘বাঙ্গালীর সামাজিক জীবন’, ‘শিক্ষিত মুসলমানের কর্তব্য’, ‘সাম্প্রদায়িক বিরোধ’, ‘আনন্দ ও মুসলমানগৃহ’ প্রভৃতি প্রবন্ধে মোতাহার হোসেন বাঙালি মুসলমানের কুসংস্কারাচ্ছন্ন উত্থান-রহিত জীবন, শিক্ষা-সংস্কৃতির অভাব, দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ, অন্তঃপুরবাসিনী মুসলিম নারীর দুঃসহ অবরুদ্ধ জীবন, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিবাদ ও বিভেদ এবং উভয়ের জীবনযাপনের তুলনামূলক চিত্র—মূলত এসব বিষয় তাঁর আলোচনায় এসেছে। সমাজ স্বভাবতই চলিষ্ণু—কিন্তু মুসলমান সমাজ স্থবির এবং তার বাস অজ্ঞতা-অশিক্ষা-কুসংস্কার-অনৈক্যের অন্ধকার বিবরে। মোতাহার হোসেন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘জীবনের একটা প্রধান লক্ষণ হাসি ও আনন্দ’। ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’,—কিন্তু তাঁর চোখে ধরা পড়েছে, এই আনন্দ কেবল বাঙালি মুসলমানের জীবনে, মনে ও গৃহে অনুপস্থিত। তাঁর বিবেচনায় বাঙালি মুসলমানের কোনো ‘কালচার’ নেই। তার ওপরে সুশিক্ষা-সুরুচির অভাব আছে বলেই—‘মুসলমান গান গাইবে না, ছবি আঁকবে না, এক কথায় মনোরঞ্জনকর ললিতকলার কোনও সংশ্রবেই থাকবে না। মুসলমান পুরুষেরা কেবল কাজ করবে, আর ঘর শাসন করবে; মেয়েরা কেবল রাঁধবে বাড়বে, আর ব’সে ব’সে স্বামীর পা টিপে দেবে’ (‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’, সঞ্চরণ)।
নারী—বিশেষ করে মুসলিম রমণীর জীবনের ছবিও তাঁর রচনায় পরম মমতায় আঁকা হয়েছে,—যে অবরোধবাসিনী রমণী পর্দা-প্রথার শাসনে ম্রিয়মাণ, ঘরকন্না-সন্তানপালন আর স্বামীসেবায় সমর্পিত, গৃহগত আনন্দ ও সুখ যাদের কাছে চির অধরা। শাস্ত্র-ধর্ম-সংস্কার-সমাজ-পরিবারের শাসনে ও চাপে এইসব রমণীর জীবনযাপন যে কতোখানি শোচনীয় ও দুর্বিষহ ছিল, তার খণ্ডচিত্র এই রকম: ‘... খেলা-ধুলা, হাসি-তামাশা বা কোনও প্রকার আনন্দ তারা করবে না—সব সময় আদব-কায়দা নিয়ে দুরস্ত হয়ে থাকবে’ (‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’)। বাঙালি হিন্দু রমণী যেখানে শিক্ষার প্রভাবে ‘সমস্ত কর্মে পুরুষের সহকর্মিণী’ হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি সামাজিক আনুকূল্য না থাকায় মুসলিম রমণী সেখানে অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে ‘দিনগত পাপক্ষয়’ করে চলেছে। মোতাহার হোসেন এই অসম অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষার চাঞ্চল্যে পর্দার কুহক কাটাইয়া উঠিতে না পারিলে তাহাদের সত্বর মুক্তি নাই’ (‘বাঙালীর সামাজিক জীবন’, সঞ্চরণ)। নারীশিক্ষা ও নারীজাগরণ সম্পর্কে তাঁর এই বক্তব্য নিছক তত্ত্বকথা ছিল না,—তাঁর আগ্রহ, সমর্থন ও প্রযত্নে নিজের পরিবারেও তার যথাযথ অনুশীলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। সমাজ-প্রগতি ও জাতীয় স্বার্থে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মসম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্য যে বিশেষ জরুরি, সেই বিষয়টির ওপরও তিনি জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে দেশভাগের পর পূর্বাঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে তিনি উল্লেখ করেছেন: ‘হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের উন্নতি হইলে তবেই বাঙলা প্রদেশের উন্নতি হইতে পারিবে। অতএব যাহাতে সামাজিক ও ধর্ম-সংক্রান্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রভেদ অগ্রাহ্য করিয়া মূল সূত্র ধরিয়া বৃহত্তর মানবতার ক্ষেত্রে মিলন সম্ভবপর হয়,
তাহার চেষ্টা করা প্রত্যেক শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমানের কর্তব্য’ (‘শিক্ষিত মুসলমানের কর্তব্য’, সঞ্চরণ)। মোতাহার হোসেন পেশায় ছিলেন শিক্ষক। তাই তাঁর পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার ব্যবহারিক দিক ও প্রকৃত জ্ঞান-অর্জনে শিক্ষার ভূমিকা—এসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। তাঁর সেই চিন্তাধারাকে সংক্ষেপে সূত্রাকারে এইভাবে প্রকাশ করা যায়: ‘কোন্্ জাতি কতটা সভ্য, তা নির্ণয় করবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাপমাঠি হচ্ছে তার শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যপুস্তক ও সাধারণ সাহিত্য’ (‘শিক্ষা-প্রসঙ্গে’, কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী, ২য় খণ্ড)। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষাকেই তিনি সমর্থন করেছিলেন। মোতাহার হোসেনের ধর্মে বিশ্বাস ছিল, ছিল নিষ্ঠাও। ধর্মচর্চায় কখনো শৈথিল্য আসেনি তাঁর। কিন্তু ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার কালিমা তাঁকে স্পর্শ করেনি কখনো। তিনি ধর্মকে উপলব্ধির বিষয় ও অন্তরের সম্পদ বিবেচনা করতেন। তাই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে তিনি কখনো অনুমোদন করেননি। স্পষ্টই তাঁকে বলতে শুনি: ‘সচরাচর আমাদের ধর্ম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে—অজ্ঞদিগের ধর্মোন্মত্ততা সৃষ্টি করে তার সুযোগ মতলব হাসিল করে নেবার জন্য—ভোট সংগ্রহ বা পার্টি গঠন দ্বারা প্রভুত্ব ও প্রতিপত্তি লাভ করবার উদ্দেশ্যে। আজকাল তাই দেখা যায়, ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির একটি প্রধান অস্ত্র। কিন্তু প্রকৃত ধর্ম যে এর থেকে স্বতন্ত্র বস্তু, এ কথা যেন আজকাল আমরা বুঝেও বুঝতে চাচ্ছিনে’ (‘বাংলা ভাষার নতুন বিন্যাস’, কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী, ৩য় খণ্ড)। এই কথাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কত যে সত্য,
তা দেশের মানুষ নিয়তই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন। মোতাহার হোসেনের বিজ্ঞানচিন্তা ছিল নিখাদ ও যুক্তিশাসিত। আমাদের দেশের অনেক মনীষীর মতো তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞানের অযৌক্তিক সমন্বয় ও সরল সমীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তিনি বলতে দ্বিধা করেন না: ‘বিজ্ঞান ও যুক্তির সহিত সংঘর্ষে (অর্থাৎ জ্ঞানবিচার ও বুদ্ধির ক্রমিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে) ধর্মের আনুষঙ্গিক বিশ্বাসগুলির যদি একটু পরিবর্তন হয় তবে তাহা দূষণীয় নহে বরং সেইটিই প্রয়োজন’ (সঞ্চরণ)। সক্রেটিস ও গ্যালিলিওর সত্য-প্রকাশের চরম পরিণাম-ফলের দৃষ্টান্ত টেনে এ কথাও তিনি বলেছেন: ‘... মত বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে পৃথিবীতে জ্ঞানের উন্নতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হত। বর্বরতা স্থায়ী করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে নতুনের সন্ধান ছেড়ে দিয়ে স্থায়ী হয়ে পুরাতনকেই আঁকড়ে বসে থাকা’। বিশ্বাস নয়, নির্ভুল তথ্য আর অকাট্য যুক্তিই বিজ্ঞানের প্রধান অবলম্বন—সিদ্ধান্তের মূল উপকরণ। তাই রক্ষণশীল শাস্ত্রবিশ্বাসী সাধারণের চোখে বিজ্ঞানীর স্বরূপ ভিন্নভাবে উদ্্ঘাটিত। তাদের কাছে বিজ্ঞানীকে ‘বস্তুতান্ত্রিক নির্মম বিশ্লেষক ও নাস্তিক’ আখ্যাও পেতে হয় অনেক সময়। কিন্তু তা-যে সঠিক মূল্যায়ন নয়, যুক্তি দিয়ে তা তিনি প্রমাণ করেছেন। ভাষা-সাহিত্য আলোচনা-বিশ্লেষণেও তিনি মুক্তদৃষ্টি ও নির্ভীক চিত্তের পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্যের সঙ্গে জীবন ও সমাজের যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, তা যে বায়বীয় কল্পনার বিষয় নয়, এই ধারণায় আস্থাবান ছিলেন তিনি। তাই এক আলাপচারিতায় তিনি ‘শিল্পের জন্য শিল্প’—এই তত্ত্বকে ‘ছেঁদো কথা’ বলে খারিজ করে দিয়েছিলেন। সাহিত্যের স্বরূপ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে এই রচনায়: ‘মানবচিত্তের বিভিন্ন অবস্থায় রসযুক্ত সম্যক্্ প্রকাশ লইয়াই সাহিত্যের কারবার।
সাহিত্য কখনও বা অগ্রদূত হইয়া সমাজকে কল্যাণের পথে আহ্বান করে, আবার কখনও বা গভীর অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা সমাজের প্রতিস্তরের প্রকৃত অবস্থা উদ্্ঘাটন করিয়া দেখায়। এইরূপে সাহিত্যের ভিতর দিয়ে একদিকে যেমন দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষা উদ্বোধিত হয়, অন্যদিকে তেমনি দেশের চিত্তের প্রকৃত ইতিহাস রচিত ও রক্ষিত হয়’ (‘বাঙলা সাহিত্যের স্বরূপ’, সঞ্চরণ)। মোতাহার হোসেনের সাহিত্যবিষয়ক আলোচনাতে লেখকের সামাজিক ভূমিকা ও সেই সঙ্গে শিল্পবোধের বিষয়টিই মূলত গুরুত্ব লাভ করেছে। রাষ্ট্রভাষা, ভাষা-সংস্কার কিংবা হরফ-পরিবর্তন সম্পর্কে মোতাহার হোসেনের মত ছিল স্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণ। এসব বিষয়ে কখনো আবেগতাড়িত হয়ে নয়, বরং তথ্য ও যুক্তি দিয়ে তাঁর মত-প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন। রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেনের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ১৯৪৭-এর ১৫ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাসের মধ্যেই প্রকাশিত তাঁর ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষাসমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন: ‘... পূর্ব-পাকিস্তানের রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা বাংলাই হওয়া স্বাভাবিক ও সমীচীন। কোনও কোনও পরমুখাপেক্ষী বাঙ্গালীর মুখেই ইতিমধ্যে উর্দুর ঝনৎকার শুনা যাচ্ছে। কিন্তু এঁদের বিচার-বুদ্ধিকে প্রশংসা করা যায় না।... এ সমস্ত উক্তি ‘কলের মানুষে’র অবোধ অপুষ্ট মনেরই অভিব্যক্তি। এতে বাঙ্গালীর জাতীয় মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাবে।
এর ফল এই দাঁড়াবে যে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান ইংরাজ-রাজের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে অমনিই পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিরাজের কবলে যেয়ে পড়বে।’ ওই একই প্রবন্ধে তিনি সতর্ক করে দিয়ে এ কথা উচ্চারণ করেছিলেন যে: ‘বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা করা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশী দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।’ ইতিহাসের পথ বেয়েই এ উক্তি চরম সত্যমূল্য লাভ করেছে। কেননা প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মানসিক ব্যবধান রচনা করেছিল এবং বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার আন্দোলনকে ভিত্তি দিয়েছিল। বাঙালির এই গণজাগরণ ক্রম-পরিণতি লাভ করে মুক্তি-সংগ্রাম ও স্বাধীনতার আন্দোলনে—পূর্ব ও পশ্চিমের চিরবিচ্ছেদের ভেতর দিয়ে। এইভাবে গড়ে উঠেছে মুক্তজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার সাধক কাজী মোতাহার হোসেনের মননের অক্ষয় মৌচাক। প্রগতি-ভাবনার এই মনস্বী পুরুষের কাছ থেকে উত্তরকাল চেতনা ও কাজে পাবে প্রত্যাশিত নিরন্তর প্রেরণা।

No comments

Powered by Blogger.