এমপি রনি কারাগারে-দায় স্বীকার, ক্ষমা প্রার্থনা

সাংবাদিক হত্যাচেষ্টার মামলায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টায় একটি সাদা রঙের গাড়িতে করে গোলাম মাওলা রনিকে আদালতে নেওয়া হয়।
তাঁকে আদালতের হাজতখানায় মাইক্রোবাসে রেখেই তাঁর পক্ষে করা জামিন আবেদনের শুনানি শুরু হয়। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আশিকুর রহমান রনির জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিকে সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় নিজের অসংযত আচরণের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন গোলাম মাওলা রনি। গতকাল রনির কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্ষমা চাওয়া হয়।
রনির আইনজীবীরা জানান, গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে আদালতের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় রনি আইনজীবীদের জানিয়েছিলেন তাঁর পক্ষে যেন কোনো জামিনের আবেদন না করা হয়। সে অনুযায়ী আইনজীবীরা তাঁর জামিনের আবেদন করা হবে না বলে শুনানির আগে সাংবাদিকদের জানান। কিন্তু রনি আদালতে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং তাঁর পক্ষে জামিনের আবেদন করা হয়।
আসামিপক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মো. কবির হোসেইন। তিনি শুনানিতে বলেন, 'সেদিন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল। আমরা এ জন্য দুঃখিত। গোলাম মাওলা রনি একজন সম্মানিত সংসদ সদস্য ও আইনপ্রণেতা। আসামির জামিন বাতিলের আবেদন করতে হলে আসামির উপস্থিতিতেই শুনানি হতে হবে বলে আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। আর ওই শুনানিতে আসামিকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ দিতে হবে। রনিকে আদালত থেকে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এ ছাড়া জামিনে গিয়ে তিনি বাদীকে হুমকি দিয়েছেন বলে বাদী যে আবেদন করেছেন তা অসত্য। একটি ল্যান্ডফোনে বাদীকে হুমকি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ল্যান্ডফোনে কোন নম্বর থেকে ফোন দেওয়া হচ্ছে তা বাদী উল্লেখ করেননি। এমনকি পুলিশি তদন্তেও ফোন নম্বরটির কথা উল্লেখ নেই। কাজেই পুলিশি প্রতিবেদনের বিষয়টিও বিশ্বাসযোগ্য নয়।'
অন্যদিকে প্রসিকিউশন পক্ষে সহকারী পুলিশ কমিশনার মিরাশ উদ্দিন বলেন, 'আসামি একজন আইনপ্রণেতা হয়ে আইন ভঙ্গ করেছেন। আবার জামিন পেয়ে জামিনের শর্ত ভঙ্গ করেছেন। আসামিকে পরোয়ানা মুলে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি সদ্য ধৃত, বর্তমানে মামলা তদন্তাধীন। এ অবস্থায় তাঁকে জামিন দেওয়া হলে তদন্তে এর প্রভাব পড়বে ও বিঘ্ন ঘটবে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে আটক রাখা হোক।'
বাদীর পক্ষে তাঁর ব্যক্তিগত আইনজীবী পরিমল গুহ আদালতে বলেন, আদালত থেকে জামিন নিয়ে গোলাম মাওলা রনি জামিনের অপব্যবহার করেছেন। তিনি বাদীকে ক্রমাগত মামলা প্রত্যাহারের হুমকি দিচ্ছেন। পুলিশ তদন্ত করে বাদীর অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। কাজেই রনির জামিন বাতিল করতে পারেন আদালত।
বাদীর অপর আইনজীবী আজিজুর রহমান বলেন, রনির জামিন বাতিল করা না হলে সাক্ষীরা ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসবেন না।
পরে বিচারক তাঁর আদেশে বলেন, মামলার বাদী বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেনডেন্টের সহকারী ব্যবস্থাপক ইউনুস আলীর জিডির পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক তদন্ত করে গত বুধবার তদন্ত কর্মকর্তা হুমকির বিষয়ে সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ফলে আদালত আসামির জামিন বাতিল করে পরোয়ানা জারি করেন। রাষ্ট্রপক্ষের নিবেদনমতে এই আসামি জামিনে গেলে তদন্তে এর প্রভাব পড়বে। এ পর্যায়ে জামিন নামঞ্জুর করা হলো।
এ সময় শারীরিক অসুস্থতার জন্য কারাগারে রনির চিকিৎসার আবেদন করা হলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন এবং কারা কর্তৃপক্ষকে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এদিকে রনিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়ার পর ঢাকার সিএমএম আদালতে আগত তাঁর নির্বাচনী এলাকার কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কারের দাবিতে মানববন্ধন করেন।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান গত বুধবার রনির জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। ওই দিনই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রনিকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল।
গত ২০ জুলাই রাজধানীর তোপখানা রোডে মেহেরবা প্লাজায় ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক ইমতিয়াজ সনি ও ক্যামেরাম্যান মহসিন মুকুল সংবাদ সংগ্রহের কাজে গেলে তাঁদের মারধর করেন ও আটকে রাখেন রনি ও তাঁর লোকজন। এ ঘটনায় ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সহকারী ব্যবস্থাপক ইউনুস আলী বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন।
রনির ক্ষমাপ্রার্থনা ও দায় স্বীকার : সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় নিজের অসংযত আচরণের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। তাঁকে গত বুধবার গ্রেপ্তার ও গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে গতকালই রনির নিজ কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্ষমা চাওয়া হয়। পৃথক এক চিঠিতে রনির স্ত্রী কামরুন্নাহার রুনু বলেন, গ্রেপ্তারের আগেই রনি বিবৃতি তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর করেন।
বিবৃতিতে গোলাম মাওলা রনি বলেন, 'এই ঘটনায় সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে অসংযত আচরণের দায় পুরোপুরি আমার। গণমাধ্যমে যুক্ত/কর্মরত সকল সাংবাদিক বন্ধু, এ আচরণে ক্ষুব্ধ সকল শুভানুধ্যায়ীর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।' তবে বিবৃতিতে রনি নিজেকে পরিস্থিতির শিকার বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, নানা বিষয়ে মতপার্থক্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে তিনি এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। রনি আরো বলেন, 'ঘটনার পূর্বাপর বিশ্লেষণে বোঝা যায়, আমি মূলত পরিস্থিতির শিকার।'
রনির বিবৃতিতে আরো বলা হয়, কিছুদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। তিনি আরো বলেন, 'এসব অভিযোগের একটিরও সত্যতা প্রমাণিত হলে আমি রাজনীতি থেকে চিরদিনের মতো সরে দাঁড়াব।' রাজনৈতিক আদর্শ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক জীবনে তিনি বরাবরই আওয়ামী লীগের অনুসারী এবং এ থেকে কখনো বিচ্যুত হবেন না।
এদিকে রনির স্ত্রী রুনু গতকাল গণমাধ্যমকে লেখা চিঠিতে বলেন, 'গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য আমার স্বামী গতকাল (২৪ জুলাই ২০১৩, বুধবার) এই সঙ্গে যুক্ত বিবৃতিটি প্রস্তুত এবং স্বাক্ষর করেন। তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় তাঁর পক্ষ থেকে আমি এ বিবৃতিটি প্রকাশের জন্য প্রেরণ করছি।'
কাশিমপুর কারাগারে
গোলাম মাওলা রনিকে আদালতের নির্দেশে গতকাল রাতে গাজীপুরের কাশিমপুরস্থ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২-এ নেওয়া হয়েছে।
জেলার সুভাষ চন্দ্র সাহা জানান, রাত সোয়া ৯টার দিকে রনিকে ঢাকা থেকে কাশিমপুর কারাগারে আনা হয়। তাঁকে কারাগারের ভিআইপি বন্দিশালার সুরমা সেলে রাখা হয়েছে। তিনি ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির সুবিধা পাবেন। ওই সেলে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, আলোচিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীও বন্দি রয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.