আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার by সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল

কোনো কোনো দেশে আইনের শাসন বলতে ন্যায়বিচারকে বোঝানো হয়। আবার কোনো কোনো দেশে আইনের শাসন বলতে পক্ষপাতদুষ্ট অন্যায় বিচারকে বোঝানো হয়।
প্রথমটি হলো আইনে উল্লিখিত বিধান লঙ্ঘন এবং অগ্রাহ্য করলে অবস্থান-পরিচয়-মর্যাদা নির্বিশেষে সেটি বিচারের আওতায় এনে 'আইন-দণ্ডের' প্রতীক কালো কাপড় চোখে বেঁধে দোষী কিংবা নির্দোষ সাব্যস্ত করা হয়। আর দ্বিতীয়টি হলো আইনের বিধান যাই হোক, চোখে বাঁধা কালো কাপড় খুলে আগে অবস্থান-পরিচয়-মর্যাদা দেখে তারপর নির্ধারিত হয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচার কায়েম করা হবে কি, হবে না। প্রথমটি কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া উদাহরণসহ প্রযোজ্য উন্নত বিশ্বে; আর দ্বিতীয়টির প্রয়োগ হলো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশসহ অনুন্নত বহু দেশে। তবে 'আইনের শাসন-আইনের শাসন' বলে এত চেঁচামেচি কিংবা তর্ক-বিতর্ক বোধহয় বাংলাদেশের মতো অন্য কোথাও নেই। এখানে যেমন, ৪২ বছর পর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রণমূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হয় শাসকগোষ্ঠী, ১১ বছর পর রাজনৈতিক সহিংসতার কথিত দায়ীদের বিচারের প্রক্রিয়ার জন্য আইনের সঠিক শাসন খুঁজতে প্রচুর মেধা ও শ্রম ব্যয় করে শাসক দল, তখন এর চেয়ে হাজার গুণ বেশি রাষ্ট্রীয় কল্যাণকর্ম ফাইলচাপা পড়ে থাকে অনির্দিষ্টকাল। তেমনি শোষিত প্রতিবাদীরাও কখনো কখনো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হয়ে বাধ্য হয় রণমূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হতে। অথচ দেখা যায়, বহু চলমান তাজা অবিচার-অত্যাচার-নৃশংসতা নিয়ে মেয়াদি আইনের শাসন বাস্তবায়নকারীদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আবার শোষিত প্রতিবাদীরাও একসময় ঝিমিয়ে পড়েন বলতে বলতে, লিখতে লিখতে। তাঁদের এই সাময়িক চুপ থাকা বোধ হয় ভবিষ্যতের সুযোগ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় যে একসময় পূর্ববর্তীদের মতো 'মেয়াদি শাসক' হতে পারলে তখন এর ন্যায়বিচার করা হবে। উভয় ক্ষেত্রেই 'বিচারের বাণী কিন্তু নিভৃতে কাঁদে'। আবার অবস্থান-পরিচয়-মর্যাদা নির্বিশেষে কোনো বিবেকবান আদালত যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবিধানে কোনো নির্দেশনা দেন, তা-ও দেখা যায়, মেয়াদি শাসকদের তোষণকারী মৃত বিবেকধারী কর্মকর্তারা লোকদেখানো একটা প্রলেপ দিয়ে তারপর চুপ মেরে যান। এ ক্ষেত্রে বিচারের বাণী সাময়িক আশাবাদী হয় বটে, তবে একপর্যায়ে গিয়ে আবার নিভৃতে কাঁদে, এই অনুষঙ্গগুলো ক্রমেই বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে বিচার ও আইন প্রণয়ন তথা আইন প্রয়োগের ধারক ও বাহকদের মধ্যে। এই অশনিসংকেত পুরো জাতিকে যেন অনির্দিষ্টকালের মহাপ্রলয়ের দিকে ক্রমেই না নিয়ে যায় সেটা গভীরভাবে ভাবার ও প্রতিবিধান করার সময় কিন্তু আছে, কারণ ৪২ বছর বয়সী কোনো মানুষ যেমন শিশুর মতো হামাগুড়ি দেয় না, বরং দৃঢ় পায়ে দাঁড়ায়-হাঁটে, প্রয়োজনে দৌড়ায়, তেমনি বাংলাদেশ কিন্তু এমন আর সদ্য স্বাধীন না কিংবা ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে কেবল হাঁটতে শিখেছে, এমন নয়। তাহলে জটিলতা কোথায়? এ প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক, সংক্ষেপে বলতে গেলে গণতন্ত্র শুধু ভোটাধিকার নয়, ভোট হলো ক্ষমতায় যাওয়ার একটি বাহন মাত্র। আর গণতন্ত্র হলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বাস্তবায়ন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ই কিন্তু আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচারে সম-অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা রয়েছে। ক্ষমতার বাহন হিসেবে ভোট নামক গণতন্ত্র ব্যবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার লোভ সামলাতে হবে সবার আগে। সৃষ্টি করতে হবে মনোজগতের কমিটমেন্ট, জাতির প্রতি কমিটমেন্ট, দেশাত্মবোধের কমিটমেন্ট এবং সেটা করার ক্ষেত্রে শাসকদলকেই কাজের মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে সবার আগে। মনে রাখতে হবে, অভিযুক্ত মানেই কিন্তু দোষী সাব্যস্ত নয়। দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। একটি হচ্ছে প্রাথমিক অভিযোগ; মূল বিষয়টি হচ্ছে, অভিযোগের যাচাই-বাছাই এবং তদন্ত ও বিচার (সঠিক) প্রক্রিয়ার সমাপনান্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়া। অথচ বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের একটি অভিযোগের অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে দেশের বিভিন্ন জেলায় অর্ধশতাধিক মামলা করা হলো। ফারুকের অভিযোগের ভিত্তি ছিল সরকারি একটি চিঠি। বিষয়টি সংক্ষেপে এ রকম- পেট্রোবাংলার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষে পেট্রোবাংলার প্যাডে আবু সিদ্দিকী অভিযোগ করেন, মুচাইতে নতুন আবরণে পুরনো কম্প্রেসর বসানোর মাধ্যমে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর প্রকল্পের বিনা দরপত্রে একক প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে মার্কিন কম্পানি শেভরনকে একটি কাজ পাইয়ে দেন জ্বলানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। ৫২.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ কাজ রীতিনীতি উপেক্ষা করে পাইয়ে দেওয়ার জন্য চৌধুরী সাহেব শেভরনের কাছ থেকে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উৎকোচ গ্রহণ করেন। অভিযোগে বলা হয়, এর মাধ্যমে দুই মিলিয়ন ডলার প্রধানমন্ত্রীর নামে গ্রহণ করা হয় এবং স্বয়ং তৌফিক-ই-ইলাহী ১৪ অক্টোবর, ২০০৯ সালে আমেরিকার টেক্সাসে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে ওই অর্থ প্রদান করেন। অভিযোগটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়ার পরদিনই পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ মর্মে বর্ণিত ঘটনার সরকারি চিঠিপত্রও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ তসরুফ হয়েছে কি না জানতে চাওয়াই অপরাধ? আবার এই জ্বালানি উপদেষ্টাই সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, যারা রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিরুদ্ধে কথা বলবে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে কটূক্তি করায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের প্রসঙ্গে বলেছেন, ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হবে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্পিকার থাকাকালে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায়িত করেছেন। আবার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি থাকাকালেই তিনি মানিক সাহেবকে অ্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি পদে পুরস্কৃত করেছেন। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে একটু বেশি মাত্রায়ই, বর্তমান সরকারের আমলে। ক্ষমতার দণ্ড নিয়ে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের কথা নাই-বা প্রত্যাশায় আনলাম। কিন্তু 'বিধাতার ন্যায়দণ্ড' হাতে বিচারকরা যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের জন্য কবিগুরুকে প্রাসঙ্গিক কারণে একটু স্মরণ করতেই হয়। রবিঠাকুর তাঁর 'ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত' প্রবন্ধে বলেছেন, 'ভয়ের বিষয় এই যে ধর্মকে বিস্মৃত হইয়া প্রবৃত্তির কাছে পাছে আত্মসমর্পণ করি, পরকে দণ্ড দিতে গিয়া পাছে আপনাকে কলুষিত করি।'
বিচারক হতে যোগ্যতা হিসেবে দীর্ঘ আইনি অভিজ্ঞতা, আইনের বইয়ের বিধানগুলোর গুরুত্ব তো রয়েছেই, তবে দণ্ডদাতা কিংবা খালাসদাতার অন্তর ও বিবেক কী বলছে, সেটাও বোধ করি মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের আপিল আদালত আদালতের 'অন্তর্নিহিত ক্ষমতা' প্রয়োগের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে এ মর্মে বিদেশি এক বিচারককে উদ্ধৃত করে বলেছেন, এ রকম ক্ষেত্রে (বিচার বিভাগের উচ্চ আসন সমুন্নত রাখতে) কখনো কখনো আদালতকেই বাদী পক্ষ, জুরিমণ্ডলী ও বিচারক হিসেবে কাজ করতে হয়। রাষ্ট্র মানুষের তৈরি, সেটাকে পরিচালনার জন্য ফৌজদারি, দেওয়ানি, সংবিধানসহ বিবিধ আইন মানুষের তৈরি। এই আইনগুলো খাটিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকারও গঠন করে মানুষ। এই সরকার বানানোর জন্য সংসদ তৈরি করেছে; আবার সংসদ নির্বাচন করার জন্য আইনও পাস করেছে, আবার উল্লিখিত আইন ও বিধিবিধান সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য আইন দিয়েই কিন্তু বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে। সবই তো মনুষ্য সৃষ্ট এবং কল্যাণের উদ্দেশ্যে। তাহলে ঘাপলাটা কোথায়? আমার উত্তর হচ্ছে, TO ERR IS HUMAN। মানুষ মাত্রই যেহেতু ভুল করা স্বাভাবিক, সুতরাং মানব-সৃষ্ট ও পরিচালিত সব প্রতিষ্ঠানেই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সে মাত্রা যদি সুজাতার গাওয়া 'ভুল সবই ভুল/এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা/সে ভুল' গানের মতো হয়, তাহলে এই প্রজন্ম তো অন্যায়-অবিচারের শিকার হবেই, সঠিক মাত্রায় ও সময়োপযোগী সংশোধন না হলে পরবর্তী প্রজন্মও হবে এর শিকার এবং তার দায় হবে আমাদের।
লেখক : সভাপতি, জাতীয়তাবাদী যুবদল

No comments

Powered by Blogger.