রাজনীতি-রাজনীতিতে ভারসাম্যহীন মেরুকরণ by সুভাষ সাহা

বাংলাদেশের রাজনীতি ভারসাম্যহীন মেরুকরণের দিকে এগোচ্ছে?
আমাদের দীর্ঘকালের ধর্মীয় সহনশীলতার আদর্শ ধর্মীয় গোঁড়ামির কাছে মার খাচ্ছে।
রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে সামাজিক নিরাপত্তাও আজ হুমকির সম্মুখীন। সর্বোপরি ব্যক্তির জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রাজনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি বিধানের পরিবর্তে ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এসব কারণে আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
দেশবাসী অনুভব করেন যে, অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দল ও জোট গত দুই দশকেও প্রত্যাশিত সুশাসন, মানবাধিকার, অপক্ষাকৃত ক্লিন প্রশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের শান্তিপূর্ণ না হোক স্বস্তিদায়ক জীবন নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে প্রতিবারই জনগণ নির্বাচিত সরকারকে পরেরবার ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। তারা ভোট দিয়ে প্রধান বিরোধী দলকেই ফের ক্ষমতায় এনেছে। কিন্তু বারবার পরিবর্তনেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা দেখা দিয়েছে_ তা কিন্তু বলা যাবে না। বরং পূর্ববর্তী সরকারের ঘাড়ে যাবতীয় ব্যর্থতার দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও এর নেতা-নেত্রীদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার কারণে দেশে চরম রক্ষণশীল ধর্মীয় রাজনীতি প্রসারের সুযোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মীয় ও উগ্রবাদী রাজনীতি এতটাই শিকড় গেড়ে বসেছে যে, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত দল ও ব্যক্তিবর্গও এখন সমাজের একটি বড় অংশের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। তরুণদের একটি অংশ এদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই তরুণরা তাদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের যুদ্ধাপরাধকেও ক্ষতিকর কিছু মনে করে না। সম্প্রতি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সহিংস কর্মকাণ্ড এর প্রমাণ।
দেশের প্রধান দুটি দল নিজেদের সুবিধামতো ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করায় এবং কট্টর ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করার কারণে ধর্মীয় রাজনীতি এখন বাংলাদেশে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সুশাসন প্রদানে ব্যর্থতা ও দৃশ্যমান কিছু মোটাদাগের দুর্নীতির অভিযোগ, নমনীয়তা প্রদর্শনের পরিবর্তে ড্যামকেয়ার মনোভাব, প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, মানুষের ধর্মীয় অনুরাগ বিস্মৃত হওয়া এবং ভোটার জনগণের প্রতি এক ধরনের অশ্রদ্ধার কারণে মানুষ তাদের দিকে ইতিমধ্যেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিএনপি দল হিসেবে দুর্বল হয়ে পড়ায় তার প্রধান অবলম্বন হিসেবে আবির্ভূত হয় জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো এবং সর্বশেষ চরম রক্ষণশীল ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। বিএনপি তার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ইসলামী দল ও সংগঠনের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম দক্ষিণপন্থি মেরুকরণের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। কালক্রমে বিএনপিই হয়ে দাঁড়িয়েছে কট্টরপন্থি ইসলামী দলগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এতে দেশের গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দ্রুত মেরুকরণের দিকে ধাবিত হয়। এই মেরুকরণ বাঙালির আবহমান অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে পর্যন্ত গ্রাস করতে উদ্যত। দেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব কতটা বিস্তৃত হয়েছে, সেটা বোঝা যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ, প্রায়শ মন্দিরে হামলা অথবা রাতের অন্ধকারে মন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাঙার ঘটনায়। খালেদা জিয়া বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও এসব সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড কমেনি। এতেই বোঝা যায়, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো নির্দিষ্ট তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে বিএনপিকে ব্যবহারের জন্যই বেছে নিয়েছে মাত্র।
দেশে ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমেই চরম দক্ষিণপন্থি মেরুকরণকৃত রাজনীতির বিজয় সূচিত হওয়ার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং এযাবৎকালে বাংলাদেশের ইতিবাচক অর্জনগুলো নস্যাৎ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে আমাদের সমাজ আবার পিছিয়ে পড়ার আলামত। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের বুকে মধ্যম আয়ের মডারেট দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানো অলীক কল্পনা হয়েই থাকবে। এর পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত, আদর্শিকভাবে বিভাজিত, ধর্মের বিভিন্ন মাজহাবে বিভক্ত চরম সংঘাতময় একটা ভবিষ্যৎ পাব আমরা। যাকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদী হিংসায় বিদীর্ণ পাকিস্তানের ছায়াও বলা যায়। যারা গর্বভরে বাংলাদেশের সমাজ কখনও পাকিস্তানের মতো ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূকতায় আচ্ছন্ন হবে না বলে মনে করেন, তাদের ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানকে মিলিয়ে ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি করার আহ্বান জানাই। তাহলেই তাদের মানসচক্ষু খুলে যাবে। কী মূর্তিমান বিভীষিকা সামনে অপেক্ষা করছে, তা তারা উপলব্ধি করতে পারবেন।
ধরে নেওয়া গেল যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট পরাজিত হবে আর বিজয়ী হবে বিএনপি নেতৃত্ব্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। ২০০১ সালে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোট করে বিএনপির ক্ষমতাসীন হওয়া এবং সরকারের জামায়াতকে কৃষি ও সমাজসেবা মন্ত্রণালয় দেওয়ায় ধর্মীয় রাজনীতির শিকড় কত গভীরে বিস্তৃত হয়েছে, তা সাম্প্রতিক যুদ্ধাপরাধবিরোধী ট্রাইব্যুনালের রায়ের পূর্বাপর জামায়াতি সহিংসতার বিস্তৃতিতেই প্রমাণিত। এর সঙ্গে হেফাজতি চরম ধর্মীয় রক্ষণশীলতা যুক্ত হয়ে কী ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য জন্ম দিতে পারে তা তো সবাই প্রত্যক্ষ করছেন। গত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জনমতের সম্যক প্রতিফলনও পাওয়া গেছে। বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান অনেক। বলা যায়, এই ব্যবধান রাজনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা জন্ম নেওয়ার ইঙ্গিতবাহী।
বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যে ধরনের হাইপ তৈরি হবে তাকে পুঁজি করে বিরোধী মত, এমনকি ব্যক্তিবর্গকেও টার্গেটে পরিণত করা হতে পারে। সংখ্যালঘুরা এর আঁচ অনুভব করবেন সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে জামায়াতি ও হেফাজতি মিলেমিশে একাকার হয়ে কিছুদিন এক ধরনের ধর্মীয়-রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করবে, যার মধ্যে পড়ে নিট ক্যাজুয়ালটি হবে প্রগতিশীল বহুত্ববাদী রাজনীতি, মানবাধিকার, বাঙালির পরমতসহিষ্ণুতা। এতে অনাগত ভবিষ্যতে তালেবানি (হেফাজতি) ভাবধারা শিকড় গাড়ার ক্ষেত্র পাবে। এ ধরনের একটা অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ সম্ভবত বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ চায় না। আবার তারা এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকারকেও ক্ষমতায় দেখতে চায় কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বলা যায়, এক ধরনের শূন্যতার মাঝে এখন বাংলাদেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে।
আসলে রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করা যায় না। অব্যাহত সংকট কি রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন দাবি করছে না? কিন্তু কারা সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনবে ও কীভাবে সেটা সম্ভব হবে_ সে ব্যাপারে রয়েছে অনেক জিজ্ঞাসা।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই ভারসাম্যহীন ও পশ্চাৎমুখী যাত্রাকে ঠেকাতে হলে রাষ্ট্রীয়-রাজনীতিতে সর্বাত্মক সংস্কারমুখী পরিবর্তন ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ জন্য জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টিকারী একটি অর্থবহ অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে। তবে এ ব্যবস্থা যাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল না করে আরও শক্তিশালী ও অর্থবহ করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।


সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.