ভালোই হয়েছে প্রভাত এসেছে মেঘের সিংহবাহনে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। শনিবার (৬ জুলাই) যখন ভোট গ্রহণ শুরু হয়, তখন শুনছিলাম ভোটার সমর্থন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর দিকে। কিন্তু সন্ধ্যার (লন্ডন সময়) সময়েই জানতে পারি আওয়ামী প্রার্থীর কোনো আশা নেই। রাতে তার পরাজয়ের খবর জেনেই বিছানায় শুতে গেছি। সত্যি কথা বলব, আওয়ামী লীগের এই পরাজয়ে বিস্মিত হইনি, হতাশও হইনি। পাঠকেরা শুনে হাসবেন, মনে মনে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার লাইন আবৃত্তি করেছি, ‘ভালোই হয়েছে প্রভাত এসেছে মেঘের সিংহবাহনে।’ দেশ থেকে বহুদূরে বাস করি। তাই নির্বাচনের দিন যখন খবর পেয়েছিলাম, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের জয়ের আশা আছে, তখন মনে ক্ষীণ প্রত্যাশা জাগেনি তা নয়, সেই প্রত্যাশা ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে লেখা আমার কলামে ব্যক্তও করেছিলাম। কিন্তু স্থির নিশ্চিত হইনি যে আওয়ামী লীগ জিতবে। এখন আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ায় মনের ক্ষীণ প্রত্যাশাটুকুও নিভে গেল। এখন মনে মনে ভাবছি, গাজীপুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে কী হতো, আর এখন পরাজিত হওয়ায় কী হতে যাচ্ছে? আমার আশংকা এবং আমার প্রেডিকশন সত্য না হোক এই কামনা করছি। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখছি।
আমি সব সময় জনমত এবং জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জনরায় বা গণম্যান্ডেট যদি হয় বাংলাদেশে জামায়াতের শাসন (যা আমার কাছে অসম্ভব ব্যাপার) প্রতিষ্ঠা পাবে, আমি তাতেও রাজি। কিন্তু বন্দুকের ও স্বৈরাচারীর শাসন মানতে রাজি নই। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে বিজেপির মতো কট্টর সাম্প্রদায়িক দল একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। তাতে ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটেনি। বন্দুকের শাসন এলে গণতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটত।
বাংলাদেশেও বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একাধিকবার গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এসেছে। তাদের শাসন সব সময় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করেনি। কিন্তু গণতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটায়নি। এবারেও বিএনপি ক্ষমতায় এলে ক্ষতি নেই। কিন্তু বিএনপি এখন ট্রয়ের ঘোড়া, তার পেটের ভেতর লুকিয়ে আছে জামায়াত ও হেফাজত। দেশের মানুষ যতই ধর্মপ্রিয় হোক, তারা জামায়াতকে ভোট দেয় না। কিন্তু জামায়াতিরা বিএনপির পেটে আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে। জনগণের রায়ে নয়, জনগণকে প্রতারণা করে তারা ক্ষমতায় আসে। একবার এসেছে। এবারও আসতে পারে। সেটাই আমার আশংকা। আর তা যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ গভীর তমসাচ্ছন্ন। গাজীপুরের নির্বাচনের ফল দেখে এই শংকাটিই আমার মনে জাগছে।
আওয়ামী লীগ যদি গাজীপুরের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে টেনেটুনেও জয়ী হতো, তাহলে তার ভালো দিক হতো এই যে, আগামী সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকর্মীদের মনোবল এমনভাবে ভেঙে পড়ত না। সিটি কর্পোরেশনের সাম্প্রতিক চারটি নির্বাচনে পরাজয় থেকে তারা শিক্ষা নিতেন, নতুনভাবে সংগঠিত হতেন। হয়তো সাধারণ নির্বাচনে বর্তমান পরাজয়ের ধাক্কা এড়িয়ে উঠতে পারতেন। গাজীপুরের পরাজয় সে সম্ভাবনা অনেকটা নষ্ট করেছে। আগামী চার-পাঁচ মাসে আওয়ামী লীগ কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা এখন অনেকের কাছেই সন্দেহের বিষয়।
গাজীপুর নির্বাচনেও একটা দৃশ্য চোখে পড়েছে তা হলো দলে কোন্দল এবং স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের বিভীষণের ভূমিকা গ্রহণ। গাজীপুর থেকে খবর পেয়েছি, দলীয় মেয়র প্রার্থীকে স্থানীয় তিনজন সংসদ সদস্যই সমর্থন দেননি। এরা হলেন- কালিয়াকৈরের রহমত আলী, গাজীপুর সদরের আকম মোজাম্মেল, এমনকি টঙ্গীর এমপি আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন এদের মধ্যে দলের এই দারুণ দুর্দিনে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায়।
মনে হয়েছিল তিনি সফল হয়েছিলেন। বাস্তবে হননি। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এরা নিজ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে। রাসেলের টঙ্গী এলাকায় প্রদত্ত ভোটের হার মাত্র ৪০ শতাংশ। আওয়ামী সমর্থক অধিকাংশ ভোটদাতাকেই এই এলাকায় ভোট দিতে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বরিশাল এবং খুলনার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেও এই দলীয় বিভীষণদের অপতৎপরতা দেখা গেছে। সন্দেহ নেই সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের অনেক বড় বড় কারণ আছে। তার মধ্যে একটি বড় কারণ সংগঠনের দুর্বল অস্তিত্ব এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
আমি আওয়ামী লীগের একজন নগণ্য শুভাকাক্সক্ষী, তথাপি দলের হাইকমান্ডকে বারবার সাংগঠনিক দুর্বলতা দূর করার জন্য সতর্ক করেছি। পার্টটাইম মন্ত্রী এবং পার্টটাইম জেনারেল সেক্রেটারি দিয়ে যে দল চলে না একথা বহুবার লিখেছি। কেউ তাতে কান দেননি। ফল হয়েছে নির্বাচনের সময় একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী এবং আÍঘাতী এমপিদের সামলাতে প্রধানমন্ত্রীকে নিজে তৎপর হতে হয়েছে, বৈঠক করতে হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনে আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণ হল, আওয়ামী লীগ এত বড় দল, কিন্তু তার সংগঠন-শক্তি নেই। দলের ওপর হাইকমান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেই। সংকীর্ণ দলাদলিতে দলটি জর্জরিত।
দলের বিভীষণদের সম্পর্কে শেখ হাসিনা সম্ভবত অনেক বিলম্বে হলেও এখন শক্ত হবেন। আমার কাছে পরামর্শ চাইলে বলব, তালিকা করে এদের দল থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হোক। বহিষ্কৃত হলেই দেখা যাবে, দেশে কিংবা দেশের মানুষের কাছে এদের আধা পয়সার দাম নেই। আওয়ামী লীগ আর কতদিন এবং কেন এই লায়াবিলিটি বহন করে চলবে? বাংলার নবাব মীর কাশিম দু’শ বছর আগে বিশ্বাসঘাতক জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফদের নৌ ভ্রমণে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাটনায় নিয়ে নৌকাডুবি ঘটিয়ে হত্যা করেছিলেন। রূপক অর্থে বলছি, আওয়ামী লীগের উচিত দলের বিভীষণদের জন্য ক্ষমাহীন নৌকাডুবির ব্যবস্থা করা।
এটা তো গেল গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভগ্ন শিবিরের ভগ্নদশার কথা। এবার বলি বিজয়ী বিএনপি-শিবিরের ভাঁড়ামিসর্বস্ব রাজনৈতিক নাটকের কথা। চার চারটি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার পরও গাজীপুরে ভোটদান শুরু হতেই বিএনপির বড় নেতা, পাতি নেতা সবাই চিৎকার শুরু করেন। বিএনপি সমর্থক ভোটদাতাদের ভোট দিতে দেয়া হচ্ছে না, তাদের পোলিং অফিসারকে সেন্টার থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মর্মে তারা নির্বাচন কমিশনের কাছেও দরখাস্ত করেছিলেন। এই সর্বৈব মিথ্যা তারা প্রচার করছিলেন গাজীপুরে তারা হেরে যাবেন এই আশংকায়। কিন্তু সকাল-দুপুরের এই প্রচারণা বদলে গেল সন্ধ্যায় বিএনপি প্রার্থীর জয়ের খবর পাওয়া যেতেই। অমনি ‘অবাধ নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে জনরায়’ বলে বিএনপি শিবিরে সে কী জয়োল্লাস! রাজনীতিতে ‘ইকোনমি অব ট্র–থ’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু সর্বৈব মিথ্যাভিত্তিক রাজনীতি করার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতই প্রতিষ্ঠা করেছে।
গাজীপুর নির্বাচনের ফল জানাজানির পর ঢাকা থেকে বিএনপি-সমর্থক এক প্রবীণ বন্ধু টেলিফোনে আমাকে ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে তো আপনি সব সময় পরামর্শ দেন। এবার বলুন, তাড়াতাড়ি গণরায় মেনে বিএনপির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে।’ তাকে বলেছি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে সে সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত? তিনি বললেন, তাহলে আর কে যাবে? বললাম, বিএনপির সাইনবোর্ড লাগিয়ে যাবে জামায়াত। জামায়াতকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য দেশের মানুষ ভোট দেয়নি। তারা বিএনপিকে ভোট দিয়ে থাকতে পারে।
বিএনপির বন্ধু বললেন, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়লে দেশে রক্তপাত হবে না।
বলেছি, ধীরে বন্ধু ধীরে। অত উল্লসিত হবেন না। মিসরের সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে তাকিয়ে দেখুন। অত বড় নির্বাচনে জিতে মুসলিম ব্রাদারহুড ও তাদের প্রেসিডেন্ট মুরসি এক বছরও ক্ষমতায় থাকতে পারলেন না। সিভিল আনরেস্ট তৈরি করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। পেছনে রয়েছে পশ্চিমা মদদ।
প্রবীণ বন্ধু বললেন, মিসরের সেনাবাহিনী মূলত সেকুলারিস্ট। এখনও অনেকটা নাসেরপন্থী। মুসলিম ব্রাদারহুডের বিপক্ষে তারা তাই অবস্থান নিয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী তা নয়। বরং তাদের অনেকের মধ্যে সেকুলারিজম ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে এখনও ভীতি আছে।
তাকে হেসে বলেছি, কে আপনাকে বলল, সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করবে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বিবাদ তুঙ্গে তুলে বাংলাদেশে এবার মিলিটারি নয়, সিভিল ত্রাণকর্তা পাঠানো এবং তাকে ক্ষমতায় বসানোর উদ্যোগ শুরু হয়ে গেছে। ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সুশীল সমাজের চায়ের কাপে তুফান সৃষ্টি, দুটি তথাকথিত নিরপেক্ষ ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকের শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হেট ক্যাম্পেইন দেখেও তা কি আপনারা বুঝতে পারছেন না?
প্রবীণ বন্ধু আমার কথার কী অর্থ বুঝলেন জানি না। বললেন, আপনারা তাহলে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দেবেন না?
বলেছি, আমরা নই, বিএনপিকে এখন যারা নাচাচ্ছে, তারাই তাকে ক্ষমতায় আসতে দেবে কিনা সন্দেহ। আমার ধারণা, বিএনপিকে তারা আওয়ামী লীগকে হটাতে ব্যবহার করছে। কিন্তু ক্ষমতায় বসতে দিতে চায় না। পর্দার আড়ালে তাদের পছন্দের লোক অপেক্ষা করছে।
বন্ধু বললেন, সে যাই হোক আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় থাকছে না।
বললাম, তাও বলতে পারি না। এক-এগারোতেও আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নিপুণ ছক পাতা হয়েছিল। সেই ছক পাতা সফল হয়নি। আগামী সাধারণ নির্বাচনেও (যদি হয়) এমন কিছু ঘটতে পারে, যাতে বর্তমানের সব অংক কষা ফল ভুল প্রমাণিত হতে পারে। বাংলাদেশের জনসিংহ শেষ মুহূর্তে জেগে উঠবে না তা কে বলতে পারে?

No comments

Powered by Blogger.