ভোটের ফলাফল প্রচারে ইদুঁরদৌড় by তুষার আবদুল্লাহ

দর্শকরা কি আমাকে ক্ষমা করেছেন?  যারা ৬ জুলাই  বিকেল চারটার পর টেলিভিশন সেটের সামনে বসে ছিলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ফলাফল জানতে।
তাদের শুরু থেকেই বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিলাম। বিভ্রান্তির ঘূর্ণিতে নাকানিচুবানি খাইয়েছি তাদের। যেহেতু গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ছিল না, তাই ভোটগ্রহণ শেষের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে কোথাও ভোট গণনা শেষ হয়নি। অবশ্য নির্ধারিত সময় শেষ হবার দেড় ঘণ্টা পরেও ৩৭টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ চলছিল। টেলিভিশন চ্যানেলে ভোটের ফল প্রচার শুরু হয় সোয়া ছয়টার দিকে। তখন প্রায় সব চ্যানেলেই ১২টি ভোট কেন্দ্রের ফল গ্রাফিক্সের মাধ্যমে পরিবেশিত হচ্ছিল। এই ফলগুলো সংবাদকর্মীরা সংগ্রহ করছিলেন রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে অবস্থান নেয়া বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টের কাছ থেকে। কোনো কোনো টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা কিছু কিছু কেন্দ্রের ফল সরাসরি প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে সংগ্রহ করছিলেন। এই সময় পর্যন্ত রির্টানিং অফিসার বেসরকারিভাবে কোনো কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেননি। শুরু থেকেই বিএনপি সমর্থিত প্রাথী অধ্যাপক এম এ মান্নান আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রাথী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লার থেকে এগিয়ে ছিলেন। এই ধারা শেষ অবধি অব্যাহত ছিল। শুধু বেড়েছে ব্যবধান। কিন্তু রাত যতো বেড়েছে ফল জানানোর প্রতিযোগিতায় ততোই বেপরোয়া হয়ে উঠছিল টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। রির্টানিং অফিসার মধ্যরাত পর্যন্ত ফল ঘোষণায় ১০০ কেন্দ্র না পেরোলেও, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এই সময়ের মধ্যে ৩৯২টি কেন্দ্রের ২০০ ভোটকেন্দ্রের ফল প্রচার করে ফেলে। এই ফল তারা কোন সূত্র থেকে পাচ্ছে কোনো চ্যানেলই নিশ্চিত করেনি।

কেউ বলেছে অসমর্থিত সূত্র, আবার কেউ বলেছে নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু  এক চ্যানেলের সঙ্গে অপর চ্যানেলের কেন্দ্র ও ভোটের সংখ্যায় মিল ছিল না। ফলে দর্শকরা নির্দিষ্ট কোনো চ্যানেলকে আস্থায় রাখতে পারছিলেন না। তাই রিমোট কন্ট্রোলের উপর জ্বালাতন বেড়ে যায়। চ্যানেল বদলাতে গিয়ে দর্শকরা পড়ে যান বিভ্রান্তির খাদে, কোন ফলকে তারা বিশ্বাস করবেন। একটা বিষয় দর্শকরা বুঝে গিয়েছিলেন যে  এগিয়ে আছেন টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে এম এ মান্নান। কিন্তু ভোটের অংক তারা মেলাতে পারছিলেন না। একদিকে টেলিভিশন চ্যানেলের বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত ফলের গরমিল, অন্যদিকে রিটার্নিং অফিসারের পক্ষ থেকে ধীরগতিতে ফল ঘোষণা দেখে, দর্শকরা নানা  ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-র অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে খানিকটা নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিলেন।

ফল প্রচারের এক পর্যায়ে দেখা যায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বেশ কয়েকটির কেন্দ্রের সংখ্যা একই। কিন্তু ভোটের সংখ্যা এক নয়। প্রথম ভাবা হয়েছিল কেন্দ্রের সংখ্যা এক হলেও, হয়তো কেন্দ্র এক নয় তাই ভোটের সংখ্যা ভিন্ন। কিন্তু এই অবস্থা বেশ কিছুক্ষণ থাকার কারণে সংশয় বাড়ে। দেখা যায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন ২৭৯টি ভোটকেন্দ্রে টেলিভিশন প্রতীকের প্রাথী’র ভোট দেখাচ্ছিল ২ লাখ ৩ হাজার আর সময় টেলিভিশন ২০৩টি ভোট কেন্দ্রে ভোটের সংখ্যা একই দেখাচ্ছিল। দোয়াত কলম প্রতীক প্রার্থীর ক্ষেত্রে  এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার। যদিও সময় টেলিভিশন প্রায় এক ঘণ্টা ২০৩টি ভোট কেন্দ্রতে টেলিভিশন প্রতীকের ভোট দেখিয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার এবং দোয়াত-কলম প্রতীকে ১ লাখ ২৮ হাজার। পরে তারা ভোটের সংখ্যা কমিয়ে আনে। এদিকে একাত্তর টেলিভিশন ফল প্রচারের ক্ষেত্রে রাত ৯টার পর থেকে স্থিতাবস্থায় চলে যায়। সব চ্যানেল এমনকি রিটার্নিং অফিসারের ফল ঘোষণায় গতি এলেও একাত্তর টেলিভিশন মধ্যরাত পর্যন্ত স্থির ছিল ৯৭টি ভোট কেন্দ্রের ফল প্রচারে। মধ্যরাতের পর  আচমকা দেখা গেল, একাত্তর টেলিভিশন সর্বশেষ সংবাদ হিসেবে দর্শকদের জানাচ্ছে ৩৯২টি ভোট কেন্দ্রে দোয়াত-কলম প্রতীক পেয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার ভোট এবং টেলিভিশন প্রতীক পেয়েছে  ৪ লাখ  ৬৮ হাজার ভোট। এই একই ফল ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেশ টেলিভিশন এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনও প্রচার করতে থাকে। বাংলাভিশন নিজে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে একই ফল জানাতে থাকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং একাত্তর টেলিভিশনের বরাত দিয়ে। এই ঘটনাটি সম্ভবত বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের ইতিহাসে প্রথম ঘটলো। যদিও একই সময়ে বাংলাভিশন তাদের টিকার বা স্ক্রলে জানাচ্ছিল ৩২০টি কেন্দ্রের ফল জানাচ্ছিল সেখানে টেলিভিশন প্রতীকের ভোট দেখানো হচ্ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার  ৩২১ ভোট  এবং দোয়াত –কলমের ১ লাখ ৫২ হাজার ৩২০ ভোট। দর্শকের ভিড়মি খাবার বিষয় হলো যদি টেলিভিশন ৪ লাখ ৬৮ হাজার ভোট পায় আর দোয়াত কলম পায় ৩ লাখ ১২ হাজার তাহলে এই দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত মোট ভোট দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। এতে ভোটার উপস্থিতি শতকরা ৮৫ ভাগ ছাড়িয়ে যায়। ভোটার উপস্থিতির এই হার নির্বাচন কমিশন এমনকি কোনো প্রার্থী বা জোটও করার দু:সাহস দেখায়নি। তাহলে একাত্তর এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট এতো ভোট ঐ দুই প্রার্থীর জন্য কোথা থেকে জোগাড় করলো? ভোটের এই যোগানদাতায় পরদিন সকালে কালেরকণ্ঠ পত্রিকাও যোগ দিয়েছে। তারা নিজেরা ভোটের হিসেব করার ফুরসত বা ঝুঁকি না নিয়ে রোববারের পত্রিকার প্রধান খবরে সেই একাত্তর টেলিভিশন এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের হিসেবটিই তুলে দিয়েছে।

শনিবার রাতে অনলাইন পত্রিকাগুলোতে অভিযান চালিয়ে দেখেছি প্রথম আলো অনলাইন, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, বিডি নিউজ রিটানিং অফিসার ঘোষিত ফলাফলকে অনুসরণ করেছে। বাকি অনলাইন পত্রিকাগুলোর ফলের সংখ্যার সঙ্গে মিল ছিল একাত্তর ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সংখ্যার। শনিবার ও রোববার যারা ভোটের ভুল পরিসংখ্যান দর্শকদের কাছে পরিবেশন করেছেন, সেই টেলিভিশন এবং অনলাইন পত্রিকা এবং সংবাদপত্রগুলোকে দু:খ প্রকাশ করতে দেখিনি। সময় টেলিভশনের একজন রিপোর্টার দু’বার রিটার্নিং অফিসারের অফিস থেকে জানিয়েছেন কেন ভোটের হিসেবে তারতম্য ঘটছে। সূত্রেরও খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভ্রান্তিহীন এবং একই সংখ্যার ফলাফল ঘোষণার স্বার্থেই জানাটা জরুরি ৮৫ ভাগ ভোটার উপস্থিতির ফল দুটি টেলিভিশন কোন সূত্রে পেলো, এবং যাচাই বাছাই ছাড়া কেন প্রচার করলো, সেই সংগে ঐ সূত্রকে আগামীতে সকলে মিলে বর্জন করার শপথ নিতে হবে। একই সাথে প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে না নেমে ফল ঘোষণার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো কেবলমাত্র রিটার্নিং অফিসারের ঘোষিত ফলাফলের প্রতিই আস্থা রাখতেও পারে কিনা। সবাই একই গতিতে ফলাফল প্রচার করলে, অস্থিরতা কমে আসবে। সংবাদকর্মী হিসেবে এই যাত্রায় দর্শকদের বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্য দু:খ প্রকাশ করছি।

"৭১ টিভি জানায়, ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রের সবগুলোতে অধ্যাপক মান্নান পেয়েছেন ৪,৬৮,০০০ ভোট। দোয়াত কলম প্রতীক নিয়ে আজমত উল্লাহ পেয়েছেন ৩,১২,০০০ ভোট। ফলে অধ্যাপক মান্নান ১,৫৬,০০০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।"

এ ব্যাপারে একজনের মন্তব্য: ‘৭১-র এই রিপোর্ট সত্য হইলে তো ভোট দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। এত ভোট আইলো কইত্থে। রাবিশ মিডিয়া কোনহানকার....’---

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন- tushar.abdullah@gmail.com


No comments

Powered by Blogger.