উপাচার্যের অনিয়মের দায়ভার by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

বর্তমানে দুটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থির অবস্থা আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি জাহাঙ্গীরনগর, অন্যটি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
অস্থিরতার কারণ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুটা ভিন্ন হলেও এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আমাদের সম্মানিত উপাচার্যরা। অবশ্য দ্বিতীয়টির অবস্থা একটু ভিন্ন। পূর্বেকার উপাচার্যের কর্মের ফল ভোগ করতে হচ্ছে বর্তমান উপাচার্যকে, যিনি চলে গেছেন, তাঁর এখন দায় নেই। বর্তমানে যিনি আছেন তিনি যদি পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবিলা করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে তাঁকে হয়তো মূল্যও দিতে হতে পারে। একজনের কর্মকাণ্ডের দায় অন্যকে নিতে হবে- এটা স্বাভাবিক। যখন সেই কর্মকাণ্ডগুলো খারাপ হয়, তখন তার ঘানি টানতে কষ্ট ও রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। ভালো কাজ বহন করার মধ্যে রয়েছে আনন্দ এবং ভবিষ্যতে আরো ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা। কিন্তু এমনটি চোখে পড়ছে না রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এখানকার পরিস্থিতি বেশ জটিল। কখনো বামপন্থী শিক্ষক, কখনো ডানপন্থী শিক্ষকের একাংশ; আবার কখনো বা শিক্ষক সমিতির একাংশ- কখন, কিভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে আন্দোলন করছে, তা বুঝতে হলে রীতিমতো গবেষণা করতে হবে।
১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। একজন ভালো শিক্ষক ও প্রগতিশীল মনমানসিকতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি সবার কাছে সুপরিচিত। কিন্তু তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে শিক্ষক সমিতির একাংশ আজ ঐক্যবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকরাই আগেকার উপাচার্যকে অপসারণ করতে বাধ্য করেছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনার সংস্কৃতি একদম নেই। ঠিক এমনটিই আমরা লক্ষ করি শিক্ষকসহ অন্যান্য পেশাজীবী গোষ্ঠীর ভেতর। এখানে যেদিন উপাচার্য সংবাদ সম্মেলন করেন, তার পরের দিন শিক্ষক সমিতি একই কাজ করে। কেউ কারো সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় রাজি নয়। উপাচার্য আলোচনার প্রস্তাব দিলেও প্রতিপক্ষ ফিরিয়ে দেয়। দাবি হলো, উপাচার্যের পদত্যাগ। সব কিছু মানি কিন্তু তালগাছটি আমার।
২০০৮ সালে তৎকালীন কেয়ারটেকার সরকারের সময়ে উত্তরবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নাম থাকলেও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এটিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করে। এটি প্রশংসার দাবি রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়টি দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং নতুন নতুন বিভাগ খোলার মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের বড় বিদ্যাপীঠ হওয়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হলেও বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। একজন উপাচার্যের দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বহু দিন ধরে এখানকার শিক্ষকরা আগেকার উপাচার্যের অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল। এ জন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে হেনস্তা হতে হয়েছে। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক গঠিত অনিয়ম তদন্তে কমিটি তাঁকে অপসারণের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে কোনো ফল হয়নি। তাঁর যাবতীয় অনিয়মের রেশ টানতে হচ্ছে বর্তমান উপাচার্যকে। পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ তা বোঝা যায় যখন বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়ে যায়। এদের আন্দোলনে অনেকটা অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমান উপাচার্যের জন্য এ আন্দোলন মোকাবিলা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকটা অসহায় এবং সমাধানের প্রত্যয়ে তাঁকে বলতে শোনা যায়, আমাকে সময় দিতে হবে- আমি ৩৬০ জনের (সংখ্যাটি কম-বেশি হতে পারে) চাকরির সমস্যার সমাধান করব। তিনি সময় নিয়ে হয়তো ইউজিসির সঙ্গে দেনদরবার করে পূর্বেকার উপাচার্যের নিয়োগের বৈধতা দেবেন ঠিক; কিন্তু এতে অনিয়মের শাস্তি হবে না, বরং অনিয়ম বৈধতা পাবে মাত্র।
সরকারি কর্মকর্তাদের পদমর্যাদার তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অবস্থান সচিবের একধাপ নিচে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধিতে তাঁকে এমন সব একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা একজন সচিবের রয়েছে কি না সন্দেহ। একজন উপাচার্য তাঁর নিজ ক্ষমতাবলে কর্মচারী থেকে শুরু করে শিক্ষক পর্যন্ত অনধিক ছয় মাস এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারেন। এ ছাড়া রয়েছে মাস্টাররোলে নিয়োগ। রয়েছে পদ না থাকার ফলে ছুটিজনিত শূন্যপদে নিয়োগের ব্যবস্থা। অনধিক ছয় মাস নিয়োগদানের পর এটিকে অব্যাহত রাখার জন্য উপাচার্যকে সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পুরো আর্থিকব্যবস্থা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে বিধায় এক খাত থেকে অন্য খাতে অর্থ স্থানান্তর করা হয় সহজ। এভাবে নয়-ছয় করে অতিরিক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করা হতো রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ কাজগুলো পূর্বেকার উপাচার্য ভালোভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিধায় এখন বিপদে পড়েছেন তাঁরাই, যাঁরা এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছিলেন। এ জন্য একমাত্র উপাচার্যের দায় নয়। যাঁরা বুঝে কিংবা না বুঝে কিংবা বিভিন্ন চ্যানেল অনুসরণ করে আজকে বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী হয়েছেন, তাঁদেরও এ দায় নিতে হবে। আমরা হয়তো অনেকে জানি, জোট সরকারের সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ৫৪৪ জনের একটি বড় নিয়োগ ছিল। তখনকার উপাচার্য দারুণভাবে এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আমরা তখন তীব্রভাবে এর সমালোচনা করেছিলাম। কিন্তু একই ঘটনা এ সরকারের সময়ে ঘটছে। আমাদেরও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বেকার উপাচার্যের অনিয়ম ও দুর্নীতির নিন্দা জানানো ও শাস্তি দাবি করা উচিত।
শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. সালেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ ছিল না। তিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি বর্তমান মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা উপাচার্য আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন, যা আমাদের জন্য সাহসের ও গর্বের বিষয়। আমরা এমন উপাচার্য চাই, যাঁরা নিজেদের লোভ-লালসা, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক দুর্নীতি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবেন। যাঁরা নিজেরা মনে করবেন যে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি কিংবা দুর্নীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারব না, অনুগ্রহপূর্বক তাঁদের এ পদে যাওয়া উচিত নয়।
ইউজিসি হয়তো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা করবে, কিন্তু চাকরি দেওয়া এবং নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকবেন, তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থা কে করবে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, পূর্বেকার উপাচার্যের অনিয়মের দায় কেন সরকারকে বহন করতে হবে। এ প্রশ্ন বিবেকবান মানুষের কাছে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.