মেসেজ ক্লিয়ার by সাজেদুল হক

ভোটের রাজনীতি আসলে এমনই। একদিনেই যেখানে বদলে যায় সব কিছু। রাজা হয়ে যান প্রজা, প্রজার ভূমিকা নেন রাজা।
অসহায় ক্ষমতাবঞ্চিত মানুষ ব্যালটকেই বেছে নেন জবাবের হাতিয়ার হিসেবে। একটা কথা প্রায়ই বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ ব্যালটে সিল মারতে কখনও ভুল করেন না। ’৭০-এর ব্যালট বিপ্লব যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকে অনিবার্য করে তুলেছিল। সেই শুরু। প্রতিবার এবং প্রত্যেকবার যখনই সুযোগ পেয়েছে জনগণ জবাব দিয়েছে। যদিও ক্ষমতাবানরা বরাবরই তাদের বোকা জ্ঞান করে এসেছেন। সুযোগ পেয়েই গাজীপুরের জনগণ আরও একবার বুঝিয়ে দিয়েছে, ব্যালটই সকল ক্ষমতার উৎস। সিলেট, রাজশাহী, খুলনা আর বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর গাজীপুরের নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল ক্ষমতাসীনরা। নিয়োগ করা হয়েছিল সর্বশক্তি। আর আত্মবিশ্বাসের সূত্রও খোলাসা করেছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ। বলেছিলেন, গাজীপুর রাজশাহী আর বরিশাল নয়। গোপালগঞ্জের পর গাজীপুরেই আওয়ামী লীগের সমর্থন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তারপরও দ্বিতীয় দুর্গের পতন ঠেকানো যায়নি। মাঝখানে আবারও পুরনো এরশাদকে দেখা গেছে রাজনীতির মাঠে। একবার আজমত আর একবার মান্নানকে দোয়া করেন তিনি। নির্বাচনের  আগ মুহূর্তে সমর্থন দেন আজমত উল্লাকে। তার দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারই এখন বলছেন, আজমত উল্লাকে এরশাদের সমর্থন যথেষ্ট কাজে আসেনি। গাজীপুরের নির্বাচন এরশাদকেও হয়তো একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব কতটা সে প্রশ্নও বড় হয়ে উঠেছে। যদিও এটা নিশ্চিত থাকতে পারেন, আগামী সংসদ নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নানা অভিনয় আপনাকে দেখতেই হবে। এর আগে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে হস্তক্ষেপ করে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল জাহাঙ্গীর আলমকে। কিন্তু কোন কিছুতেই ঠেকানো যায়নি লাখ ভোটের ব্যবধান। অনেকেই অনেক কারণ বলছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়ের নানা বিশ্লেষণ হচ্ছে, হবে। তবে চারটি সিটি করপোরেশনের পর গাজীপুরের দেয়া বার্তাটি ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউড। বলশালী শাসকদের প্রতি দুর্বল জনগণের ক্ষোভেরই প্রকাশ এ জনরায়। এর আরেক নাম জনঅনাস্থা। দরজা-জানালা সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার এক অনিবার্য ফল তা। আর আওয়ামী লীগ বিরোধী সকল শক্তির ঐক্য আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ক্রমশ কঠিন করে তুলেছে। মুদ্রার উল্টো পিঠই দেখতে শুরু করেছে ঐতিহ্যবাহী দলটি। তবে ২০০৯ সালের শুরুতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সবসময় অলআউট খেলেছে আওয়ামী লীগ। রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঠ ছাড়তে বাধ্য করেন তারা। দোয়া আর মিলাদ মাহফিলে প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রাখতে পারাই ছিল আওয়ামী লীগের সফলতা।
সবকিছু যখন সাদা মনে হচ্ছিল জনতার প্রথম জবাব আসে চার সিটিতে। এরপর আসে ‘গাজীপুর টেস্ট’। যে টেস্টে আপাত সফলই মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে মুখোমুখি করেছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের। যদিও এ ব্যালট উত্থান আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ পরিষ্কার করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংলাপের কথা বলেছেন অনেক বিজ্ঞজনেরা। সংসদের চলতি অধিবেশনে বাজেট বক্তব্যে দুই নেত্রীর মধ্যে কি এক ধরনের সংলাপ হয়নি? সেখানে তারা আবারও স্পষ্ট করে বলেছেন, আমরা নড়িব না। জানুয়ারির আগেই দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও কেউ জানেন না আসলে কি হবে? নানা গুঞ্জন, সংশয় চারদিকে। গাজীপুরের বার্তায় সে গুঞ্জনের মাত্রা আরও বেড়েছে। আর আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়েও যদি বিএনপি এবং তার মিত্ররা ভূমিধস জয়লাভ করেন তখনকার পরিস্থিতি কি হবে? আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে সে চিত্রও এখনই এঁকে ফেলেছেন কোন কোন বিশ্লেষক। তবে এত কিছুর পরও সমাধান খুঁজতে হবে ব্যালটেই। ব্যালটের একমাত্র বিকল্প ব্যালট। গণতন্ত্রের একমাত্র বিকল্প আরও বেশি গণতন্ত্র।

No comments

Powered by Blogger.