বিশেষ সাক্ষাৎকার : ইমতিয়াজ আহমেদ-জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে গাজীপুর

গাজীপুর সিটি করপোরেশনসহ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা, জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব ও নির্বাচনসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে কালের কণ্ঠ-এর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
গাজীপুর নির্বাচনের প্রাক্কালে দেওয়া এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন মোস্তফা হোসেইন।
কালের কণ্ঠ : নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : নির্বাচনে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রথম কথা হচ্ছে, এই নির্বাচন হওয়ার কথা নির্দলীয়ভাবে। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে প্রকাশ্যেই মাঠে কাজ করেছে। আর এই সুযোগে তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বিষয়ে কিছু চিত্র আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে। বড় দলগুলো যে আগের মতো বড় নেই, তা বোঝা গেছে। এককভাবে নির্বাচন করার মতো অবস্থা তাদের নেই। যে কারণে তাদের জোটের বিষয় গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে হয়েছে। জাতীয় সংসদের নির্বাচন আসন্ন হওয়ার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বসহ নিয়েছে এ নির্বাচনকে। একই সঙ্গে এ নির্বাচনের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে গোটা দেশের মানুষের।
কালের কণ্ঠ : আদর্শগত কারণে জোট গঠন হতে পারে কিন্তু গাজীপুরের ক্ষেত্রে এটা কি প্রযোজ্য?
ইমতিয়াজ আহমেদ : সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে হওয়ার কথা না থাকলেও প্রতিটি নির্বাচনেই দলগুলো সরাসরি নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে। গাজীপুরকে যদি আলোচনায় আনেন, তাহলে দেখবেন, সেখানে আদর্শের কোনো বিষয় নেই। ওখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত কিংবা হেফাজত, কোনো ভেদাভেদ নেই। যাকে পাওয়া যায়, তাকেই কাছে টানার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় পার্টি কোন পক্ষে যাবে, তা অস্পষ্ট ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাই কথা বললেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে। স্থানীয় পর্যায়ে হেফাজতকে নিয়ে দুই বড় দলই টানাটানি করেছে। আসলে আবারও আমাদের বলতে হবে, বড় দলগুলোর অক্ষমতাই প্রকাশ পেয়েছে গাজীপুরের নির্বাচনে।
কালের কণ্ঠ : এ নির্বাচনকে দুটি দলেরই এতটা গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে কী কারণ রয়েছে? আর তাদের অর্জনের বিষয়ও কিভাবে দেখছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয়ের মাধ্যমে দলগুলোকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দল আগে থেকেই নির্বাচনে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির আন্দোলন তাকেই কেন্দ্র করে। কিন্তু বিজয়ে তাদের উৎসাহে নতুন মাত্রা পায়। সরকারি দল চার সিটি করপোরেশনে হেরে গেলেও তারা বোঝাতে চেষ্টা করে, এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। কিন্তু দলীয়ভাবে ভরাডুবি তাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। সে কারণেই হয়তো গাজীপুর নির্বাচনে তারা বদলে যেতে থাকে। সরকারি কাঠামোও জড়িত হয়ে পড়েছে। রাজস্ব বোর্ড জড়িয়ে গেল। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত হলেন। নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভীও গেলেন। বিরোধীদলীয় সমর্থক প্রার্থীর কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করা হলো নির্বাচনের প্রাক্কালে। এখানে বিরোধী দল চেয়েছে বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আর সরকারি দল চেয়েছে নিজেদের সমর্থন প্রমাণ করতে। স্বাভাবিকভাবেই উভয়ের কাছেই এ নির্বাচন অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : এতে করে রাজনৈতিক অর্জন কী হতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : গাজীপুরের নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দল সুবিধা পাবে। তাদের মূল জাতীয় দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। কে মেয়র হলেন, এটা প্রাধান্য পাবে না। তারা বোঝাতে পারছে, বর্তমান সরকার নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকতে পারছে না। তাই জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই।
কালের কণ্ঠ : বিধিসম্মত না হওয়ার পরও প্রতিটি স্থানীয় সরকারের দলীয় অংশগ্রহণ প্রমাণিত। একে কিভাবে দেখছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এখানে সব কিছুরই রাজনীতিকীকরণ হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভাবুন। এখানে ব্লু আর হোয়াইট দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছেন শিক্ষকরা। অফিস-প্রতিষ্ঠান- সবখানেই রাজনীতি ঢুকে গেছে। পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সংগঠন- কোনোটাই আর রাজনীতির বাইরে নয়। বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই- কোনটার কথা বলবেন? কেন হচ্ছে, দেখার বিষয়। নারায়ণগঞ্জের কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। মেয়র আইভী দলীয় প্রার্থী ছিলেন না। তিনিও বললেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। দলীয় সমর্থন না থাকলে এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয় বলেই এই পরিণতি।
কালের কণ্ঠ : দলীয় রাজনীতির এই অনুপ্রবেশ কি গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবও শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় সরকারের দলীয়করণ হওয়ার ব্যাপারে। স্থানীয় সরকারেরও যদি দলীয়করণ হয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্র থাকে কোথায়! অথচ দলগুলো নিজেরাই গণতন্ত্র চর্চা করে না। দলের ভেতরই গণতন্ত্রের প্রকট অভাব।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও স্থানীয় সরকারে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বিধিসম্মত।
ইমতিয়াজ আহমেদ : অন্য দেশের তুলনা আমাদের এখানে কতটা প্রযোজ্য, ভেবে দেখতে হবে। অন্যান্য দেশে যে কাঠামোগত সুবিধা আছে, আমাদের এখানে তা অনুপস্থিত। সুতরাং বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করার সময় আমাদের অবস্থান বিবেচনা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অঢেল টাকার খেলা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ : আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো এখনো শক্তিশালী করতে পারিনি। যে ক্ষমতায় থাকে, তার সর্বতো চেষ্টা থাকে, যেকোনো উপায়েই হোক, ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে ক্ষমতায় যেতে চায় তারা। তাদেরও একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, যেনতেন উপায়েই তারা সেটা পেতে চায়। প্রার্থীদের মধ্যে সমাজচিন্তা কাজ করে খুবই কম। স্বার্থচিন্তা এত বেশি সবার মধ্যে যে, টাকা ছড়াতেও পিছপা হয় না কেউ। অর্থের অবৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে সাময়িক ফায়দা পাওয়া গেলেও এর পরিণতি কিন্তু ভালো হয় না। যিনি এ কাজটি করেন, তিনি কিন্তু সন্দেহমুক্ত হওয়ার পথ পাবেন না।
কালের কণ্ঠ : পেশিশক্তি ব্যবহারের অভিযোগ থেকে আমাদের নির্বাচনগুলো এখনো মুক্ত হতে পারেনি কেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : একইভাবে বলতে হয়, স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো শক্তিশালী হতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনকে আমরা এখনো স্বাধীন করতে পারিনি। সবার আগে দেখতে হবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে। এটাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এসব বোঝা মাথায় রেখে পেশিশক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনার কথা চিন্তা করা যায়, কিন্তু সুফল আসার সম্ভাবনা নেই। প্রেসার দিয়ে সব কিছু হয় না। জনগণের প্রেসার প্রয়োজন।
কালের কণ্ঠ : দুর্বল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কথা আমরা বলি। দুর্বলতার কারণ কী? এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ : মেম্বার অব পার্লামেন্ট নির্বাচিত হন দেশের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করার জন্য। অথচ তাঁকে আমরা কী করতে দেখি? তিনি উন্নয়ন তহবিল পাচ্ছেন। তাঁকে ছাড়া এলাকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের আইন পরিবর্তন করতে হবে। যাঁরা উন্নয়ন কাজ করতে চান, তাঁরা স্থানীয় সরকারে থাকবেন। যিনি এমপি হবেন তিনি আইন প্রণয়ন করবেন। এটা কিন্তু আইন প্রণেতারা চান না। শুধু আইনের মাধ্যমেই বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব। স্থানীয় সরকারের উন্নয়নের জন্য মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রাক্কালে ও গাজীপুর নির্বাচনের আগেও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ : চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেনাবাহিনী নিয়োগ ছাড়াই। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাররা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। তাই সিটি নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি যৌক্তিক বলে আমি মনে করি না। সেটা নির্বাচনগুলো দেখেই প্রমাণ পাওয়া যায়।
কালের কণ্ঠ : গাজীপুরের সঙ্গে অন্য চার সিটি করপোরেশনের কোনো পার্থক্য কি দেখছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : আগের চারটি নির্বাচনে সরকারি দল তেমন একটা গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাদের ধারণা ছিল, নির্বাচনী ফল ৫০:৫০ হবে। কিন্তু সব কয়টি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর সরকারি দল মরিয়া হয়ে ওঠে। বুঝল এভাবে চলতে থাকলে দল সংকটে পড়বে। কারণ বিরোধী দল সমর্থক প্রত্যেকেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কথা। বিরোধী দল হেরে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি জনসমর্থন নেই, এটা প্রমাণ হবে। আর গাজীপুরের নির্বাচন বিরোধী দলের দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কালের কণ্ঠ : আপনি কি মনে করেন জাতীয় নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলো প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের খুব বেশি সময় বাকি নেই। অথচ নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও বিষয়টি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। এ নির্বাচন যদি আজ থেকে দুই-তিন বছর আগে হতো, তাহলে হয়তো এতটা প্রভাব ফেলত না। কিন্তু এ মুহূর্তে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। সুতরাং জনমতের এই ঢেউ সরকারি দল কতটা ঘুরিয়ে দিতে পারবে, তা বলা যাচ্ছে না।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ইমতিয়াজ আহমেদ : আপনাকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.