অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ যাচ্ছে কোথায়? by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

বাংলাদেশকে নিয়ে দুশ্চিন্তার পাহাড়টা ক্রমেই হিমালয়ের মতো উঁচু হচ্ছে। হচ্ছেটা কী, যাচ্ছি কোথায়- সর্বত্রই এ আলোচনা। ‘আমেরিকা জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স’ (জিএসপি) সুবিধা বাতিলের পর এ আলোচনার পারদ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকাকে তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো অনুসরণ করলে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে অবধারিত ধস নামবে। বন্ধ হবে কলকারখানা, কর্ম হারিয়ে বেকার হবে হাজার হাজার শ্রমিক; দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসবে বিপর্যয়, ঘটবে আইন-শৃংখলার মারাÍক অবনতি। সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তা হবে হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ- এ কথাটি সবাই বলে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কর্মক্ষম ও ফিজিক্যালি ফিট। বাংলাদেশের কৃষি, গার্মেন্ট শিল্প, পর্যটন শিল্প ও ওষুধ শিল্প বিশ্ব পরিমণ্ডলে প্রশংসার দাবিদার। বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা সফরে এলে বাংলাদেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে প্রায় ১২৫ কোটি মানুষ। কিন্তু তাদের দেশে একজন ড. ইউনূস নেই, একজন ফজলে হাসান আবেদ নেই; আমরা কথায় কথায় তাদের অসম্মান করি, কিন্তু সারা বিশ্ব তাদের সম্মান করে- এ যেন বাতির নিচে অন্ধকার। ড. ইউনূসকে অযথা বিতর্কের মধ্যে টেনে এনে বাংলাদেশ মারাত্মক ইমেজ সংকটে পড়েছে। যারা তার সমালোচনা করছেন, তাদের চেনে কয়জনে? তারা কি সে মানের ব্যক্তি? দীলিপ বড়–য়া, মাহাবুবউল আলম হানিফ যখন ড, ইউনূসের সমালোচনা করেন; তখন মানুষ বিস্মিত ও হতবাক হয়। আসলে এসব বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে নসাৎ করার পরিকল্পিত ছক ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশের বেসরকারি হাতকে নিরুৎসাহিত করতে ড. ইউনূসকে বিতর্কে জড়ানো হয়েছে। কেননা বাংলাদেশের বেসরকারি হাত অত্যন্ত শক্তিশালী, যা বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। ড. ইউনূসের ঘটনায় বাংলাদেশ উপরে উঠছে এটি কেউ স্বীকার করেন না। সর্বত্রই বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনা। এভাবে চলতে থাকলে কোনো দেশ কি সামনে এগোতে পারে? যারা বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের এ চিন্তাটা থাকা উচিত কি নয়? শুধু নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- এ কথাটা সবার মুখ মুখে শোনা যায়। আসলে বাংলাদেশ যাদের অনেক কিছু দিয়েছে, তারা বাংলাদেশকে কিছুই দেননি; যারা বাংলাদেশকে সবকিছু দিচ্ছেন, তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে কিছুই পাননি। এভাবেই চলছে বাংলাদেশ।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে হরহামেশাই তার সমালোচনা করত ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকা। একদিন তার এক ভক্ত এসে বললেন, ‘স্যার আজকে আনন্দ বাজার পত্রিকা আপনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে।’ শেরে বাংলা বললেন- তাই নাকি? তাহলে তো ভাবতে হবে আমি সঠিক পথে নেই; আমি মনে হয় ভুল করছি।
পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে বিশ্বজুড়ে, যা পত্রপত্রিকায় আমরা দেখতে পাই। এ নেতিবাচক প্রচারণার বিপরীতে ইতিবাচক কোনো প্রচারণা চোখে পড়ছে না। নেতিবাচক প্রচারণার কারণে কোটি কোটি ডলারের রফতানি অর্ডার চলে যাচ্ছে পার্শ^বর্তী একটি দেশে। যেন হাতে ধরে সুযোগ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষকে।
বিভক্তি ও বিভাজন নিয়ে কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ বিভক্তি ছড়িয়ে পরেছে। এ বিভক্তি থেকে জাতিকে বের করে আনার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় মানুষ চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। কোথাও কোনো আশার বাণী তারা শুনতে পাচ্ছেন না, কেউ তাদের আশ্বস্ত করছে না; দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। ব্যাংকের লেনদেন দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেয়ার বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সূচক দ্রুত নিচের দিকে নামছে। নিত্যপণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। সরকার ও বিরোধী দল নির্বিকার। মানুষ যাবে কোথায় কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল একটা দেশ। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে টাকা না এলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাবে; তখন এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ কী করে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকবে- এ চিন্তাটা কোনো রাজনীতিবিদ করেন বলে মনে হয় না।
দেশের আবাসন ব্যবসা আজ ধ্বংসের পথে, ধ্বংসের পথে জনশক্তি রফতানি খাত; তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থাও ভালো নয়, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্ডার আসা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। পর্যটন খাত মুখ থুবড়ে পড়ছে। এভাবে একের পর এক বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে, কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে; মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার হবে, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। দেশের আইন-শৃংখলার অবনতি ঘটবে। এসব কি আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবেন? ভাবলে রাজনীতিতে এত বিভেদ-বিভক্তি ও বিভাজন কি তৈরি হতো?
এটা স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশকে নিয়ে চলছে বিপজ্জনক খেলা; এই বিপজ্জনক খেলার শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না। কোথাও কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। অনিবার্য ধ্বংস ছাড়া এই বিপজ্জনক খেলার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা এই খেলা যারা খেলছেন, নিশ্চয় তাদের একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে; উদার গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদেশী শক্তির কর্তৃত্ব কায়েম করাই এই খেলার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। সুতরাং রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমসহ সব মহলের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা ছাড়া বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো কঠিন।
দেশের মিডিয়া এখন অনেক শক্তিশালী। বলা যায় মিডিয়া এখন নেতৃত্বের ভূমিকায়; যার জন্য মিডিয়ার দায়িত্বশীলতাও অনেক বেশি। দেশকে যে কোনো বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে মিডিয়াকে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। এর জন্য সংকীর্ণ দলীয় চিন্তা পরিত্যাগ করতে হবে। যেনতেন ও রুচিহীন কোনো অনুষ্ঠান লাইভ টেলিকাস্ট থেকে বিরত থাকতে হবে এবং লাইভ প্রচারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও সিনিয়রদের কাজে লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমের দায়িত্বহীনতার কারণে দেশে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে; এমনকি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পর্যন্ত হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। সুতরাং মিডিয়ার দায়িত্বশীল আচরণই বাংলাদেশকে সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে; ব্যর্থ করে দিতে পারে দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশে বিদেশী সুযোগ সন্ধানী অপশক্তির তৎপরতা থাকার যথেষ্ট কারণ আছে। এই সুযোগ সন্ধানী অপশক্তিরা এখন তৎপর। রাজনীতিবিদদের ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করে তারা বাংলাদেশকে সবদিক থেকে অস্থির করে তুলছে। কেননা বিশ্বে বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব এখন ব্যাপক। চীন, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে এখন একটা তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। উপমহাদেশে চীনের কর্তৃত্ব কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক সুবিধাগুলো নিয়ামক। তাছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ২৫০ কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। তাই বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো চায় এখানে একটা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে, যাতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম হয়। যার কারণে শক্তিধর দেশের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বাংলাদেশে খুব জোরালোভাবে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশের তিন দিক জুড়ে রয়েছে ভারত। তারপর দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। এর পাশে রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া। তাছাড়া রয়েছে ভুটান, নেপাল ও সিকিম। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এই প্রতিটি দেশ খুবই সন্নিকটবর্তী। এই দেশগুলোতে বর্তমানে অর্থনৈতিক উত্থান ঘটছে। অর্থনৈতিক উত্থানের সঙ্গে রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিরও পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন থেকে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পটপরিবর্তন ঘটে চলেছে, তা এ অঞ্চলের রাজনীতির মেরুকরণকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা সমাধানের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিকতার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই অযাচিতভাবে শক্তি প্রয়োগ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনগণকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানো হচ্ছে; যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত ও কাম্য নয়।
আইভরিকোস্ট আফ্রিকার একটি উদার গণতান্ত্রিক ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ছিল, তাদের কোনো কিছুরই অভাব ছিল না; কিন্তু রাজনৈতিক হানাহানি ও বিভেদ-বিভক্তি দেশটির সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। তারা এখন অন্যের সাহায্য নিয়েও রাজনৈতিক হানাহানি ও বিভক্তি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। বাংলাদেশও আইভরিকোস্টের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে কি না- এই প্রশ্ন আজ মানুষের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুতরাং আইভরিকোস্টের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ অন্তত শিক্ষা নিতে পারে। বেরিয়ে আসতে পারে প্রতিহিংসা, হানাহানি ও বিভেদ-বিভক্তির রাজনীতি থেকে। তাহলেই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.