বারেক মামার কাছে টিয়ার চিঠি ও একটি নির্বাচন by মাহফুজ রহমান

বনলতা ছাত্রী হোস্টেলটা উত্তরমুখী। ফলে খুব একটা বাতাস আসা-যাওয়া করে না। কিন্তু বেশ কয়েক দিন হয় বনলতায় তুমুল হাওয়া বইছে, নির্বাচনের হাওয়া। খুব শিগগিরই হোস্টেলের প্রধান নির্বাচন করা হবে।
নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তিনজন—টিনা, টিয়া আর সামিয়া। তো সেই নির্বাচনের হাওয়ায় টিনার চুল উড়ছে ফুরফুর করে। অন্যদিকে তারই আপন বোন টিয়ার চুলের অবস্থা কাকের বাসার মতো! মাথায় যে ভালো করে শ্যাম্পু করবে সেই উপায়ও নেই! ভ্যানিটি ব্যাগ যে গড়ের মাঠ।
বনলতার বাকিরা বলে, ‘টিনার তো এখন রমরমা অবস্থা! কদিন পরেই বারেক মামা ওকে চকচকে ডলার পাঠাচ্ছেন। সেই টাকা দিয়ে আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে ঠিকই ভোটে জিতে যাবে ও।’ আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব শুনে টিনা মুখ টিপে হাসে। আর টিয়া আফসোস করে, ‘কী পোড়া কপাল আমার! নির্বাচনের এই সময় হাতে টাকা থাকা কত দরকার! আর এখনই কিনা আমার ব্যাগ খালি। ধুত্তুরি ছাই!’
ঘটনাটা একটু খুলে বলা দরকার। টিনা আর টিয়ার বারেক মামা থাকেন আমেরিকায়। ছয় মাস পর পর এক হাজার করে ডলার পাঠান দুই ভাগ্নিকে। একবার পাঠান টিনাকে, একবার টিয়াকে। টিয়ার কপাল এমনই খারাপ, নির্বাচনের ঠিক আগে আগে এবার ডলার পাচ্ছে টিনা। অথচ নির্বাচনের এই সময়টাতেই ডলারের কত দরকার! টিয়া পারলে নিজের চুল ছেঁড়ে। চুল ছিঁড়তে গিয়েও থেমে যায় ও; পড়তে পড়তে চুলগুলো ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে যাচ্ছে প্রায়।

২.
এক সকালে হঠাৎ টিয়ার মাথার ওপরে এক শ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলে উঠল। এক লাফে বিছানা ছেড়ে খাতা-কলম নিয়ে বসল ও। খুব কাছের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সলাপরামর্শ করে লিখে ফেলল একটা চিঠি। চিঠির প্রাপক বারেক মামা।
প্রিয় বারেক মামা,
আশা করি ভালো আছো। আমি খুব বেশি ভালো নেই। তোমার পাঠানো এক হাজার ডলার দিয়ে বইপত্র কিনেছিলাম। সেই সব বই পড়তে পড়তে আমার মাথার চুল পর্যন্ত পড়ে যাচ্ছে! আমার কী হবে, মামা!
অথচ তোমার প্রিয় ভাগ্নি টিনা তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে! পড়াশোনার নাম নেই, খালি ফেসবুকিং আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। এত করে বলি, আয়, একসঙ্গে পড়াশোনা করি, বারেক মামার স্বপ্ন পূরণ করি। নাহ্, সে আমার কথা কানেই তোলে না! বলো মামা, তুমি কি এসব করতেই আমাদের ডলার পাঠাও? তাই তোমার কাছে অনুরোধ, এবার আর টিনাকে ডলার পাঠিয়ো না। আরও ডলার পেলে ওর পাখা গজাবে। পরীক্ষায় ফেল করে তোমার মুখে চুনকালি মাখাবে! প্লিজ মামা, একটু ভেবে দেখো। এভাবে চোখের সামনে নিজের বোনকে ভুল পথে যেতে দিতে পারি, বলো?
ইতি
তোমার অতি আদরের টিয়া

৩.
চার দিন পরেই একটা চিঠি এল বনলতায়। প্রেরক বারেক মামা, প্রাপক টিনা ও টিয়া। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে চিঠিটা খুলল টিনা। ভাবল, ডলার পাঠিয়েছে মামা। চিঠিটা পড়েই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল ও। অন্যদিকে টিয়ার খুশি কে দেখে! মুখে সারাক্ষণ একটা কোলন ডি মার্কা হাসি ঝুলিয়ে হোস্টেলময় ঘুরে বেড়াতে লাগল ও।
টিনা আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করল। মামা লিখেছেন—
প্রিয় টিনা ও টিয়া,
আশা করি কুশলেই আছো। পর সমাচার এই যে তোমাদের অধঃপতনের কথা শুনিয়া যারপরনাই মর্মাহত হইয়াছি। তোমরা নাকি পড়াশোনায় মন না দিয়া ফেসবুক নামক পুস্তক পাঠে ব্যস্ত! তোমাদের তো আগেই বলিয়াছি—আগে পাঠ্যবই, তারপর আউট বই। কিন্তু তোমরা যখন আমার কথায় কর্ণপাত করো নাই, তাই সিদ্ধান্ত লইয়াছি, তোমাদেরকে আর ডলার পাঠাইব না। তোমরা যদি আবার পড়াশোনায় মনোনিবেশ করো, তবে আবার ডলারের কথা ভাবিয়া দেখিব। আর তোমরা তো জানোই, কত কষ্ট করিয়া, তোমাদের মামির রক্তচক্ষু ফাঁকি দিয়া ডলার পাঠাইতাম! আশা করি, তোমরা সুপথে ফিরিবে।
ইতি
তোমাদের বারেক মামা

৪.
ক্ষোভে ফেটে পড়ল টিনা। বনলতার বাকি সবার সামনে ইচ্ছামতো ঝাড়ল টিয়াকে, ‘তুই একটা কুচক্রী! আমার নামে মিথ্যা কথা লাগিয়েছিস মামার কাছে! আর তুই যে এটা একা একা করিসনি, সেটা ভালো করেই জানি। সবার ভালোর কথা ভেবে ঠিক করেছিলাম, মামার পাঠানো টাকা দিয়ে হোস্টেলের চুলাটা ঠিক করব, দেয়ালে রং করব, আরও কত ইচ্ছা ছিল! তুই সেটা হতে দিলি না! আজ তোর একদিন কি আমার
চব্বিশ ঘণ্টা!’
বলেই টিনা-টিয়া প্রকাশ্যে চুলোচুলি শুরু করে দিল! টিয়ার যে চুল ছিল তা আর অবশিষ্ট রইল না। টিনারও একই দশা।

শেষ কথা
শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলো বনলতায়। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলো সামিয়া। টিনা-টিয়া জিতবে কী করে! সারা দিন ঝগড়া করলে কি আর নির্বাচনে জেতা যায়? তার ওপর ছিল না বারেক মামার ডলার। নির্বাচনের যখন এই ফলাফল তখন ঠিকই দুই বোনের মধ্যে মিল-মহব্বত হয়ে গেল। দুই বোন এখন দিন-রাত হাপুস নয়নে কাঁদে!

No comments

Powered by Blogger.