রেমিটেন্সের সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা কোথায় গেল? by ড. আর এম. দেবনাথ

বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের দেশে পাঠানো টাকা বা 'রেমিটেন্সের' প্রবাহ একের পর রেকর্ড সৃষ্টি করছে এবং তা করছে বেশ কয়েক বছর যাবত। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ রেকর্ডের কথা প্রতি মাসে প্রকাশ করে সমানে কৃতিত্ব নিচ্ছে।
এ ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। অতীতে 'বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারও একই কাজ করেছে। তারাও প্রতিবছর 'রেমিটেন্সের' অঙ্ক প্রকাশ করে কৃতিত্ব দাবি করেছে। আমরা বাইরে থেকে কৃতিত্বের কথা শুনে আশ্বসত্ম হয়েছি। আশ্বসত্ম হয়েছি 'রেমিটেন্সের' পরিমাণের কথা শুনে। খুশি হয়েছি ক্রমবর্ধমান 'রেমিটেন্সের' পরিমাণে। কারণ দেখা যাচ্ছে রেমিটেন্সের পরিমাণ গত ১৫-১৬ বছরের মধ্যে একদিনের জন্যও হ্রাস পায়নি। এক বছর থেকে পরবতর্ী বছরের রেমিটেন্স বরাবরই ছিল বেশি। শুধু রেমিটেন্সের পরিমাণই বেশি নয়, প্রতিবছরই মোটামুটিভাবে বিদেশে গিয়েছে অধিকতর সংখ্যক বাংলাদেশী। বিগত ১৫-১৬ বছরের মধ্যে খুব কম বছরই আছে যে বছরে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি বা 'ম্যানপাওয়ার' রফতানি কম হয়েছে। তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক 'ম্যানপাওয়ার' বা জনশক্তি রফতানি হয়েছে। সে বছর নয় লাখ ৮১ হাজার ১০২ জন বাংলাদেশী কাজ নিয়ে বিদেশে যায়। এর পরের অর্থবছর হচ্ছে ২০০৮-০৯। সে বছর বিদেশে জনশক্তি রফতানির সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু রেমিটেন্সের পরিমাণ? রেমিটেন্সের পরিমাণ কি হ্রাস পেয়েছে? মোটেই নয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিটেন্সের পরিমাণ বরং উলেস্নখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। বর্তমান অর্থবছরের অবস্থা কী? ম্যানপাওয়ার এক্সপোর্ট কি এ বছরে বাড়বে? বাড়ুক বা কমুক, রেমিটেন্সের পরিমাণ কী দাঁড়াবে? শুধু এসব প্রশ্নই নয়, রেমিটেন্সের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেকটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়। আর সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। তার অবস্থা কী দাঁড়াবে? আরও প্রশ্ন আছে। রেমিটেন্স বাড়ার প্রকৃত কারণগুলো কী? সর্বশেষ প্রশ্ন রেমিটেন্সের টাকা কীভাবে বিনিয়োজিত হচ্ছে? এ টাকার সঙ্গে কি কোন না কোনভাবে জঙ্গী তৎপরতার সম্পর্ক আছে?
সরকারী তথ্যে মজার কতগুলো দিক আছে। দেখা যাচ্ছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে তিন বছর অর্থাৎ ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যনত্ম 'ম্যানপাওয়ার' রফতানির সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ তিন বছরে ম্যানপাওয়ার রফতানির সংখ্যা দুই লাখ ছিয়াশি হাজার ৩৮১ থেকে নয় লাখ একাশি হাজার ১০১-এ উন্নীত হয়। অর্থাৎ এ সময়ে 'ম্যানপাওয়ার' রফতানি সাড়ে তিনগুণ বেড়েছে। কিন্তু রফতানি বা বিদেশে গমনের সংখ্যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিপুলভাবে হ্রাস পায়। এ বছর মাত্র ছয় লাখ পঞ্চাশ হাজার ৫৯ জন বাংলাদেশী কাজ নিয়ে বিদেশ যায়। চলতি অর্থবছরের প্রবণতা খারাপের দিকে। জুলাই-অক্টোবর এই চার মাসে বিদেশ গিয়েছে মাত্র এক লাখ পঞ্চাশ হাজার ৫৮৩ জন। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে সাড়ে চার লাখের মতো লোক বিদেশে যাবে কাজ নিয়ে। আর তা হলে 'ম্যানপাওয়ার' রফতানির সংখ্যা গেল অর্থবছরের তুলনায় দুই লাখ কমবে। এদিকে রেমিটেন্সের দিকে তাকালে দেখা যায় ম্যানপাওয়ার রফতানি কমলেও রেমিটেন্সের পরিমাণ কোনভাবেই হ্রাস পাচ্ছে না। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে 'রেমিটেন্স' বৃদ্ধি পায় ১২,৩৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশীদের বিদেশ গমনের হার হ্রাস পেলেও গত চার মাসে 'রেমিটেন্স' এসেছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে পুরো বছরে 'রেমিটেন্সের' পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা যা হবে আবার সর্বকালের রেকর্ড।
প্রশ্ন, 'ম্যানপাওয়ার' রফতানি সংখ্যায় হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু বিপরীতে রেমিটেন্সের পরিমাণ হ্রাস না পেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কীভাবে? এর প্রকৃত কারণ কী? প্রকৃত কারণ একমাত্র বলতে পারবে সরকার। সরকার বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক তো মনে করে তাদের নানা ধরনের পদৰেপ গ্রহণের ফলে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে 'মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন' ছিল না। এখন এই আইন কার্যকর। এতে হুন্ডি করে দেশে টাকা আনা কঠিন। এ কারণে অধিক সংখ্যক লোক সরকারীভাবে এখন দেশে টাকা আনে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করে তারা বহু 'মানি এক্সচেঞ্জ' এজেন্সিকে অনুমতি দিয়েছে 'রেমিটেন্স' দেশে আনতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পদৰেপ হয়ত রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে কিছুটা সাহায্য করেছে। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। 'রেমিটেন্স' বৃদ্ধির কারণ হিসাবে আরও কিছু উপাদান কাজ করছে বলে মনে হয়। বহু বাংলাদেশী ব্যবসায়ী/সরকারী কর্মকর্তা/শিল্পপতির বিদেশে টাকা আছে। তারা এ টাকা সম্ভবত দেশে আনছে দুটো কারণে। বিদেশে টাকা রাখা আগের মতো নিরাপদ নয়। বহু বড় বড় ব্যাংক লালবাতি জ্বালিয়েছে। সুদের হারও এখন অনেক কম। বিদেশে বিনিয়োগও এখন ততটা লাভজনক নয় মন্দার কারণে। এসব কারণে যে দেশে 'রেমিটেন্সের' পরিমাণ বাড়ছে না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। দেশের খবরের কাগজের প্রতিবেদককে যদি বিশ্বাস করতে হয় তাহলে বলা যায় নানা ধরনের 'এনজিও' বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক 'এনজিও'দের একটা বড় অংশ বিদেশ থেকে প্রচুর ফান্ড পায়। এ খাতে 'রেমিটেন্স' বেড়েছে বলে মনে করার কারণ আছে। এ টাকার একটা অংশ দেশে ধমর্ীয় উত্তেজনা বাড়ানো ও জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। এবম্বিধ কারণেও 'রেমিটেন্স' বেড়েছে বলে মনে হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আসল চিত্রটি কী তা তলিয়ে দেখার দায়িত্ব সরকারের। 'রেমিটেন্স' বৃদ্ধি পেয়েছে, দৃশ্যত এটা আনন্দের খবর। অতএব এর উৎস খোঁজার প্রয়োজন নেই_ এ ধরনের ধারণা পরিণামে আত্মঘাতী হতে পারে। আমি মনে করি 'রেমিটেন্স' এরিয়াতে আমরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি। এটা ঠিক নয়। ঠিক নয় অর্থনৈতিক কারণেও।
সবাই আমরা 'রেমিটেন্স' নিয়ে গর্বিত। 'রেমিটেন্স' বাড়লে অর্থমন্ত্রীর 'পারফরম্যান্স' বাড়ে। কিন্তু 'রেমিটেন্স' কি অবিমিশ্র একটি আশীর্বাদ? মোটেই নয়। 'রেটিটেন্স' বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লে আবার সরকারের গলা চড়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তো বটেই। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়া দৃশ্যত যেমন সুসংবাদ তেমনি পরিণামে ৰতিরও কারণ হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য (লিকু্যইডিটি) বৃদ্ধি পাওয়া। অর্থাৎ আমানত বাড়া। 'রেমিটেন্সের' টাকা দেশে কেউ না কেউ পায়। তারা তা ব্যাংকে রাখে। এতে ব্যাংকের আমানত বাড়ে। আমানত ব্যাংক বসিয়ে রাখে না। আমানতের টাকা ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগ করতে হয়। না করতে পারলেই বিপদ। এতে ব্যাংকিং খাতে 'লিকু্যইডিটি' বাড়ে। 'লিকু্যইডিটি' বাড়ে মানে মূল্য স্ফীতির ঝুঁকি। এই ঝুঁকির মধ্যেই এখন আমরা বসবাস করছি। ইতোমধ্যে 'পয়েন্ট টু পয়েন্ট' ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এখন এর পরিমাণ প্রায় সাত শতাংশ। আরও বাড়লে তা ৰতিকর হবে সবার জন্য। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য। মূল্যস্ফীতি বাড়ার অর্থ হচ্ছে লোকের ক্রয়ৰমতা হ্রাস। এতে ৰতিগ্রসত্ম হয় স্বল্প আয়ের লোক এবং নির্দিষ্ট আয়ের লোক। গরিব মানুষ তো অবশ্যই এতে ৰতিগ্রসত্ম হয়। যাদের কিছু সঞ্চয় আছে তারাও ৰতিগ্রসত্ম হয়। কারণ সঞ্চয়ের ক্রয়ৰমতা হ্রাস পায়। দরিদ্র দরিদ্রতর হয়। দরিদ্রতর লোক দরিদ্রতম হয়। মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্তে পরিণত হয়। এসব ঝুঁকি মূল্যস্ফীতিতে সৃষ্টি হয় যা আবার উচ্চতহর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ফল। উচ্চতর রিজার্ভ আবার ঘটছে বেশি বেশি 'রেমিটেন্সের' ফলে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বেশি বেশি বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অথবা বেশি বেশি 'রেমিটেন্স' দৃশ্যত ভাল খবর হলেও পরিণামে তা ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনতে পারে। তাহলে করণীয়?
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অথবা উচ্চতর 'রেমিটেন্স' তখনই ভাল খবর যখন আমরা তা ব্যবহার করতে পারব। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ব্যবহারের বড় উদাহরণ হচ্ছে আমদানি। বিগত দুই বছর যাবত আমদানি ব্যবসায় কিছুটা টান পড়েছে। এর আগে আনত্মর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের মূল্য আকাশছোঁয়া হয়। তেলের দাম রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এসব কারণে আমাদের আমদানি ব্যয়ের পরিমাণও বেড়েছিল। কিন্তু দু'বছর যাবত বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আনত্মর্জাতিক বাজারে আমাদের আমদানিযোগ্য মালপত্রের দাম উলেস্নখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তেলের দাম ভীষণভাবে পড়েছে আনত্মর্জাতিক বাজারে। এদিকে চাল, গম আমদানির পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। এ দুটো খাতে আমাদের বহু বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। এছাড়া সয়াবিন, পিঁয়াজ, রসুন থেকে শুরম্ন করে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যা আমরা আমদানি করে খাই তার দাম আনত্মর্জাতিক বাজারে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের টাকা খরচ আমাদের কম হয়েছে। এটাও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ। সে যাই হোক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক বার বলেছে যে, তারা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের টাকা ব্যবহারের বিকল্প ব্যবস্থা করছে। এ পর্যনত্মই। কী বিকল্প ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেছে সে খবর আমরা আর পাচ্ছি না। অবশ্য দৃশ্যত মনে হচ্ছে উচ্চতর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ব্যাপারটি আর বেশি দিন কার্যকর নাও থাকতে পারে। আনত্মর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম আবার বাড়তে শুরম্ন করেছে। বিশ্ব মন্দা ধীরে ধীরে কাটছে। আমাদের ব্যবসায়ীরাও নড়েচড়ে বসছেন। সর্বশেষ তথ্যে মনে হচ্ছে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে পুনঃ মূল্য বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে আমদানি এলসি খোলা বৃদ্ধি_ এ দুটো এক সঙ্গে কাজ করলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বর্তমান স্ফীতি বেশি দিন নাও টিকতে পারে। যদি 'রেমিটেন্স' বৃদ্ধির হার আরও বাড়ে আগামী দিনে তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এ অবস্থায় চিত্রটি ভিন্নরূপ নিতে পারে। কিন্তু এৰেত্রেও প্রশ্ন আছে।
'রেমিটেন্স' বৃদ্ধি পাওয়া মানে হচ্ছে দেশে টাকা আসছে বেশি পরিমাণে। এই টাকা বাংলাদেশী 'ওয়েজ আর্নারদের' আত্মীয়-স্বজনরা পায়। এটা স্বাভাবিক যে 'রেমিটেন্সের' একটা অংশ দেনা পরিশোধে যায়। বহু 'ওয়েজ আর্নার' ধার-দেনা করে বিদেশে যায়। তাদের প্রথম কাজ হয় সেসব দেনা শোধ করা। অনুমান করা যায় 'রেমিটেন্সের' একটা অংশ এভাবে খরচ হয়। কিন্তু এর পরিমাণ কত? এ সম্বন্ধে ধারণা করা খুব কঠিন। তবে এর পরিমাণ রেমিটেন্সের 'সিংহভাগ' হবে না। যদি তাই হয় তাহলে বাকি টাকা কীভাবে খরচ হয়? এ প্রশ্নেরও কোন উত্তর নেই। দেশে কত লোক কত কাজ করে, কত লোক 'এনজিও' করে, কত লোক হিলিস্ন-দিলস্নী করে, কেউ এ টাকা কীভাবে খরচ হয় তার ওপর খোঁজ খবর করে না। করে না সরকারও। সরকার আনন্দে গদগদ 'রেমিটেন্সের' পরিমাণ দেখে। তা হওয়ারই কথা। সত্যি সত্যি দেশে যেভাবে টাকা আসছে তার পরিমাণ বিশাল। ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে শুরম্ন করলে দেখা যায় 'রেমিটেন্সের' পরিমাণ ১৫ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ঐ সালে বাংলাদেশে 'রেমিটেন্স' এসেছিল মাত্র ৪,৩৫৪ কোটি টাকা। সেই স্থলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে 'রেমিটেন্স' এসেছে ৬৬,৬৭৫ কোটি টাকা। আর ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যনত্ম এই মোট ১৬ বছরে বাংলাদেশীরা বিদেশ থেকে দেশে পাঠিয়েছে সর্বমোট ৩,২৫,৭০৮ কোটি টাকা। এর সঙ্গে চলতি অর্থবছরের ৪ মাসের 'রেমিটেন্স' যোগ করলে মোট 'রেমিটেন্সের' পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। ভাবা যায় এ দেশের গরিব কৃষকের ছেলেরা বিদেশে কাজ করে গত ১৬ বছরে দেশে পাঠিয়েছে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। বাজেটের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় বর্তমান আকারের সাড়ে তিনটা বাজেটের টাকা তারা পাঠিয়েছে। ভিন্নভাবে বললে বলা যায় বর্তমান আকারের বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ টাকা তারা দেশে পাঠায়। এই খবর পর্যনত্ম সবটাই আনন্দের। কিন্তু প্রশ্ন এখানে নয়। প্রশ্ন এ টাকা কোথায় বিনিয়োজিত হচ্ছে? আমরা দেখার মতো কোন বিনিয়োগ পাচ্ছি না। দৃশ্যত যা বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয় এই টাকার সিংহভাগ যাচ্ছে জমি ক্রয়ে। একটা অংশ যাচ্ছে বাড়ি-ঘর বানানোতে। কিছু যাচ্ছে গ্রামীণ ছোটখাটো ব্যবসায়। একটা অংশ যাচ্ছে ভোগে বা উন্নত জীবনযাপনের সামগ্রীতে। আর ইদানীং যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হয় 'রেমিটেন্সের' একটা অংশ যাচ্ছে শেয়ারবাজারে। সার্বিকভাবে বোঝা যায় 'রেমিটেন্সের' টাকার সিংহভাগই খরচ হচ্ছে 'আন-প্রোডাকটিভ' কাজে। অর্থাৎ এ টাকা উৎপাদনমূলক কোন কাজে লাগছে না। গ্রামে এর ফলাফলও অনুভূত হচ্ছে। যেসব অঞ্চল থেকে বেশি বেশি বাংলাদেশী বিদেশে গিয়েছে সেখানে জমির দাম সোনার দামে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকেও 'হাই কস্ট' অর্থনীতিতে রূপানত্মরিত করা হয়েছে। এদিকে যে শেয়ারবাজারে 'রেমিটাররা' ছুটছে সে শেয়ারবাজারও 'ম্যানুফেকচারিং' খাতের শেয়ারবাজার নয়। এ বাজারের সিংহভাগ দখল করে আছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানেই 'রেমিটাররা'ও যাচ্ছে, দেশের বেকার ছেলেরাও যাচ্ছে। অথচ সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ টাকা গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যাবলীতে বিনিয়োজিত করা যেত। এতে 'রেমিটারদের' পরিবার দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা ভোগ করতে পারত। দুঃখের কথা এ কাজটি হচ্ছে না। এ কাজে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। তারা তা করবে দূরের কথা দেখা গেল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গ্রামীণ শাখা বন্ধ করে দিতে শুরম্ন করল। অতীব ৰোভের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ছুটছে উন্নয়নের পেছনে। যে অঞ্চল উন্নত তারা সেখানে যাচ্ছে। তাদের করা উচিত ছিল ঠিক উল্টোটি। যে অঞ্চল অনুন্নত, যে অঞ্চলে সম্ভাবনা আছে সেখানে ব্যাংক তার শাখা খুলে তাকে উন্নত করা ছিল ব্যাংকের দায়িত্ব। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা করে না। তারা উন্নত অঞ্চলে যায়, অনুন্নত অঞ্চলে যেতে চায় না। যদি যেত এবং 'রেমিটেন্সের' টাকা ব্যবহারে তারা উদ্যোগ নিত তাহলে সাড়া জাগানো ফল পাওয়া যেত। জানি না কেন তারা 'রেমিটেন্সের' টাকা ব্যবহারে উদ্যোগী হচ্ছে না। অবশ্য ব্যাংকগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সরকারী নীতি যদি পরিষ্কার না হয়, সরকারী নীতির যদি স্থিতিশীলতা না থাকে তাহলে উন্নয়নের চিনত্মা কীভাবে আসবে। আমার মনে হয় 'রেমিটেন্সের' টাকা ব্যবহারে সরকারের উচিত আরও গভীরভাবে চিনত্মা-ভাবনা করা। এত বিপুল পরিমাণ টাকা ভোগে ব্যয়িত হয়ে যাবে তা কাম্য নয়। এত বিপুল পরিমাণ টাকা জমি-ফ্যাট-সোনা-দানায় ব্যয়িত হবে তাও কাম্য নয়। রেমিটেন্সের টাকা যাতে 'প্রোডাকটিভ' খাতে বিনিয়োজিত হয় তার ব্যবস্থা দরকার।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.