‘লোকসানী ব্যাংকশাখা সব বন্ধ করে দেয়া হোক!’ by ড. আর এম দেবনাথ

গত সপ্তাহে সরকারী ব্যাংকের ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছর সব সরকারী ব্যাংকের সঙ্গে একটা ‘মোমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ সই করে। এর আগে তাদের সঙ্গে প্রথামাফিক বৈঠক হয়।
চারটি ব্যাংকের সঙ্গে অর্থাৎ সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে তার ওপর খবরের কাগজে স্টোরি ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয়ত খবর বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব ব্যাংকের নতুন পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এতে বলা হবে, তারা কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না। সর্বশেষটি দিয়েই শুরু করি। পরিচালাকরা নতুনই হোন আর পুরনোই হোন তাঁরা কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না, বস্তুত বোর্ডের চেয়ারম্যান, ম্যনিজিং ডাইরেক্টর কী করতে পারবেন, কী করতে পারবে না। বোর্ডের ক্ষমতা কী ও কতটুকু। ‘অডিট কমিটি’র দায়িত্ব কী ইত্যাদি ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার রযেছে, যা কার্যকর অনেক দিন থেকে। এই সার্কুলারগুলো মোটামুটি সকল বিষয় সম্বন্ধে আলোকপাত করেছে, যা ব্যাংকের সুশাসন ও জবাবদিহিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায় সচিব মহোদয় পরিচালকদের ডেকে বলবেন তাদের কী দায়িত্ব এই খবরে আমি কিছুটা বিচলিত। প্রশ্ন তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ কী? কেন্দীয় ব্যাংকের দায়িত্ব কী তারা স্বেচ্ছায় মন্ত্রণালয়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, না কী ব্যাংক প্রশাসনে স্বৈত শাসনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। যদি বলা হতো, অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বসবেন তাহলে তার একটা অর্থ বুঝতে পারতাম। শত হোক তিনি রাজনৈতিক মন্ত্রী। তিনি তাঁর দ্বারা নিযুক্ত পরিচালকদের ডাকতেই পারেন। বস্তুত তিনি যেকোন ব্যাংকের পরিচালক, চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে ডাকতে পারেন। তবে অবশ্য তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতাকে খর্ব করে নয়। আমি দুঃখিত এই বিষয়টি বলার জন্য। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আশা করি অপরাধ নেবেন না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করতে চাই তা সরকারী ব্যাংকের সঙ্গে ‘মউ’ সম্বনীয়। এতদিন জানতাম মৌ মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যাডিং হয় ‘প্রবলেম ব্যাংকের’ সঙ্গে। বাজারে অন্তত এটাই চালু বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যদি সত্য হয় তাহলে প্রশ্ন সরকারী চারটি বড় ব্যাংকই কী প্রবলেম ব্যাংক।’ পুঁজির পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত, শাখা খোলা, প্রভিশনিং ও ক্লাসিফিকেশন, ঋণ ব্যবস্থাপনা, রিকভারি, বড় লোন হ্যান্ডলিং, ফান্ড ব্যবস্থাপনাসহ বড় বড় ইস্যুর নিরিখে কী চারটি বড় সরকারী ব্যাংক ‘প্রবলেম ব্যাংক।’ এই বিষয়টি আমার বোধের মধ্যে আসে না। দ্বিতীয়ত আজকে আমি উপরে উত্থাপিত সকল বিষয়ে মন্তব্য করব না। কারণ এতে স্থানাভাব হবে। যদি তা না হতো তাহলে সকল বিষয়ে আমি মন্তব্য করতাম। এবং এটা করা জরুরী। কারণ ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্থানাভাবে আমি শুধু একটি বিষয়ের ওপর মন্তব্য করব। আর সেটি হচ্ছে ‘ব্রাঞ্চ ওপেনিং’ ও ব্রাঞ্চের লাভ লোকসান অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক সকল সরকারী ব্যাংকের সঙ্গেই লোকসানী শাখা সম্পর্কে একটা ‘কমন’ কথা বলেছে। তাদের অভিযোগ, লোকসানী শাখা সরকারী ব্যাংকের বাড়ছে। এই অভিযোগকে আমলে নিলে দুটো পথ খোলা থাকে। হয় লোকসানী শাখা সব বন্ধ করা নয়ত এগুলোকে লাভে নেয়া। বন্ধ করতে গেলে স্বয়ং গবর্নর সাহেবের নিজ জেলা জামালপুরের প্রায় সব শাখা বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ এগুলো লোকসানী অনেকদিন যাবত এবং তা অনেক ব্যাংকের। উনার সংশ্লিষ্ট ডিপুটি গবর্নর সাহেব কী বলেন? ব্যাংকগুলো কী এ ধরনের বিভিন্ন জেলার লোকসানী শাখা যেগুলো যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রামঞ্চলে অবস্থিত সেগুলো বন্ধ করে দেবে? শুধু গ্রামাঞ্চালের শাখা নয়, অনেক শহরের শাখাও লোকসানী। এসবের ভিন্ন ভিন্ন কারণ। আমি কারণে যাওয়ার আগে একটা ব্যবসায়িক কথা বলি। বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ীদের দশ রকমের ব্যবসা আছে, বিশটা কোম্পানি আছে। এরমধ্যে সব ব্যবসাই কী লাভজনক, অথবা সকল ব্যবসাই কী সব বছর লাভজনক। নিশ্চিতভাবে এ প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক। তাদের এক ব্যবসায় লাভ হয় এক ব্যবসায় লোকসান। মুনাফার হিসাব গড়ের হিসাব। বছর শেষে তারা দেখে কোনটা লাভজনক কোনটা লোকসানী এবং গড়ে গিয়ে কত লাভ হলো। এটাই ব্যবসায়িক রীতি। অবশ্য বেশি দিনের লোকসানী হলে তারা ব্যবসা বন্ধ করে। করার আগে ব্যাংক আসে, ঋণ পুনর্তফসিল করে, ঋণের টাকা পরিশোধে ‘ব্লকড’ এ্যাকাউন্ট করায়, সুদ মওফুক করায়, সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা নেয়। উদাহরণ চামড়া শিল্প, উদাহরণ বিদায়ী বছরের তুলার ব্যবসা। আগের দিনের কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসা, গৃহনির্মাণ শিল্প ইত্যাদিও উদাহরণ। এভাবেই চলে। এটাই যদি রীতি হয় তাহলে সরকারী ব্যাংকের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য হবে না কেন?
আগে গ্রামে শাখা খোলার কথা। কে যায় গ্রামে শাখা খুলতে। বেসরকারী ব্যাংক যায় কী যায় না তার কথা বাংলাদেশ ব্যাংক জানে। এটা সাধারণ ‘নলেজ’ যে গ্রামের শাখা লাভজনক করা কঠিন ও সময় সাক্ষেপ। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা হচ্ছে, গ্রামে শাখা খুলতে হবে। সবার প্রিয় গবর্নর ড. আতিউর রহমান সব সময়ই বলেন, ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথের’ কথা। তিনি বলেন, একসেস টু ব্যাংকের কথা। এর জন্য প্রয়োজন গ্রামে গ্রামে শাখা খোলা, উপজেলার নিচে গিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে শাখা খোলা, এসব শাখাকে লাভজনক করা দুরূহ কাজ। কারণ তাদের সস্তায় ঋণ দিতে হয়, কৃষি ঋণ। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক জাতীয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ২৫-৩০ শতাংশ সুদ নিতে পারে কিন্তু সরকারী ব্যাংককে কৃষিঋণ করতে হয় সস্তায় যাতে তাদের খরচ পোষায় না। সরকারের যত সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের টাকা তা চেনেলাইজ হয় সরকারী ব্যাংকের মাধ্যমে। দশ টাকার এ্যাকাউন্ট খুলতে হয় সরকারী ব্যাংককেই। লেনদেন না থাকলেও ব্যয়বহুল এই সমস্ত এ্যাকাউন্ট ব্যাংকগুলো চালু রাখতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মানতে গিয়ে গ্রামে গ্রামে শাখা খোলা হয়। তাদের নিয়মে সস্তায় ঋণ দিতে হয়, তাদের নিয়মে ক্লাসিফিকেশন ও প্রভিশনিং করতে হয়। তাদের নির্দেশেই সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্পের টাকা লাখ লাখ গরিব মানুষকে দিতে হয়। তাদের নির্দেশেই ১০ টাকার এ্যাকাউন্ট। তাদের নির্দেশেই ভর্তুকির টাকা ঐসব এ্যাকাউন্টের মারফত দিতে হয়। সর্বোপরি গ্রামে গ্রামে ‘নেতাদের’ অনেক হুকুম তামিল করতে হয়। এমতাবস্থায় শাখা লোকসান দিলে এত কথা বলা কী বাংলাদেশে ব্যাংকের শোভা পায়? এটা কী বিচারিতা নয়, এটা কী গবর্নরের মৌখিক বক্তৃতা অনুসরণ করার শাস্তি নয়? এ সব কেন হচ্ছে? সরকারী ব্যাংক গ্রামীণ লোকসানী শাখা এক বছরে লাভজনক করতে পারবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ‘হুকুমের লেন্ডিং’ বন্ধ করতে হবে। সেটা কী হবে? সবচেয়ে বড় কথাÑ ফিনান্সিয়াল প্রফিট থেকে উত্তম একটা কথা আছে। একে বলা হয় ‘সোসাল প্রফিটেবিলিটি।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা যাঁদের অনেকেই কৃষকের ছেলে অথবা নিম্নবিত্তের ছেলে তারা কী একথা জানেন না?
শহরেও অনেক শাখা লোকসানী আছে! এগুলোর বিরাট সংখ্যক শাখা লোকসানী ‘ক্লাসিফাইড’ লোনের জন্য। ক্লাসিফাইড এ্যাডভান্সের পরিমাণ কমাতে পারলে এগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব। শীর্ষ ঋণগ্রহীতা ও ঋণখেলাপীদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা আদায় করতে পারলে এসব শাখা লাভজনক হয়। কিন্তু অনেক শাখা এসব লোকসান পুষতে হয়, ঋণ পুনর্তফসিল করতে হয়। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকও ১৩ বার পুনর্তফসিলের অনুমোদন দেয়, যে কারণে তারা তাদের অনেক হুকুম পরিবর্তন করে সেই একই ধরনের কারণের জন্য সরকারী ব্যাংকও অনেক কিছু করে যার ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সরকারী ব্যাংক এক হয়ে এগোতে পারলে শহরের অনেক শাখাকে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ থেকে মুক্ত করে এগুলোকে লাভজনক করতে পারে। তবে একটা কথা বলা দরকার বর্তমান অর্থঋণ আদালত আইন বহাল রেখে ‘ব্যাডওলস’ চিহ্নিত ঋণ জীবনেও আদায় করা সম্ভব নয়। আমি বরাবর বলে আসছি ঋণ খেলাপকে ‘ক্রিমিন্যাল অফেন্স’ হিসেবে গণ্য করুন। টাকা ফেরত না দিলে কৃষককে যেমন কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে নেয়া হয় তেমনি একই আইন করা হোক যাতে তাদের কোমরেও দড়ি পড়ে। সেটা হবে না। কারণ বড় ঋণখেলাপীরা তামাশা করার মতো লোক নয়। এখন প্রশ্ন গত চার বছরে অর্থঋণ আদালত আইনটি সংশোধন করার উদ্যোগ কী নেয়া হয়েছে? নেয়া হয়ে থাকলে তার ফল কী? এই আইনের অধীনে করা মামলার বিরুদ্ধে যেসব রিট হাইকোর্টে পোন্ডিং আছে তার যাতে শুনানি হয় তার জন্য কী পর্যাপ্ত ‘বোর্ড’ গঠন করা হয়েছে বা আছে? এসব না করে শুধু লোকসানী শাখা বাড়ছে এই অভিযোগ তোলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত। নতুন শাখা লাভজনক করতে স্বাভাবিকভাবে ২-৩ বছর সময় লাগে। যতক্ষণে পুরনো অনেক শাখা লাভে আসে ততক্ষণে নতুন অনেক শাখা লোকসানী তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়্। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এসব বিষয় বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মন্তব্য করা উচিত নয় কী? আমার আরেকটি প্রস্তাব আছে বড় বড় বকেয়া ও খেলাপী ঋণের ক্ষেত্রে। প্রত্যেক ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক ও মন্ত্রণালয় থেকে দু’জন অফিসার দেয়া হোক। ব্যাংকগুলো তো এসব ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না। তারা চেষ্টা করে টাকা আদায় করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে লজ্জা দিক এটা দেশবাসী দেখতে চায়। এটা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফিসাররা যে অধিকতর দক্ষ আর বাণিজ্যিক ব্যাংকের অফিসাররা কম দক্ষ তাও প্রমাণিত হয়। বিষয়টা ভেবে দেখবে কী কেন্দ্রীয় ব্যাংক?

লেখক : সাবেক অধ্যাপক বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.