হামিমের বাসায় শোকের মাতম, চোখের পানি ফেলছেন সবাই- আজিমপুরে দাফন সম্পন্ন ।। ঘাতক ড্রাইভার রিমান্ডে

'আম্মু রিক্সায় ভাল করে বস। দেখ না বাসগুলো কিভাবে রাসত্মা দিয়ে এঁকেবেঁকে জোরে চলছে। ওরা ভাল না। পড়ে গেলে মরে যাবে।'এ কথা বলতে না বলতেই পেছনে দাঁড়ানো বাসটি হঠাৎ সজোরে চালিয়ে রিক্সাটিকে ধাক্কা দিল।
আমার সোনামানিক হামিম ও আমি রাসত্মায় ছিটকে পড়লাম। নিজের চোখের সামনে বাসটি আমার মানিক হামিমের মাথার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিল। এরপর আর কিছু মনে নেই। পুরনো ঢাকার বংশাল টুরিটোলা ১০৩ নং লুৎফর রহমান লেনের বাসায় হামিমের অসুস্থ মা সোনিয়া শেখ একথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বিছানায় শায়িত সোনিয়া শেখ শুধু বিড়বিড় করে বলছিল, এখন কে আমাকে আম্মু বলে ডাকবে। বার্গার খাব, টিভি ছাড়, কাটুর্ৃন দেখব। তোমরা ঘাতক বাস ও চালক অবুঝ ছেলে হামিমকে মেরে ফেললে। তোমাদের কি সনত্মান নেই।
বুধবার বিকেল ৪টায় লুৎফর রহমান লেনে নিহত শিশুছাত্র হামিমের ৬ তলার বাড়িটি শোকের মাতম ছিল। বাসের ধাক্কায় নিহতের মা সোনিয়া শেখের মাথার ডান পাশে গুরম্নতর জখম হয়েছে। ডান চোখ নষ্ট হবার পথে। মুখম-ল লালচে রক্তাক্ত জখমের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। তার চোখের কোল বেয়ে অশ্রম্ন ঝরছিল। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী তাকে ঘিরে সানত্ম্বনা দিয়েও রাখতে পারছে না। কেউ এলে হাত উঠিয়ে যন্ত্রনা ও কষ্ট বেদনায় যোনিয়া শেখ বলছিল আমার সোনামানিক হামিম কই? কে আমাকে জ্বালাতন করবে। রান্না করতে গেলেই সোনামানিক হামিম বলে, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। দাঁড়াও আমি তোমাকে আদর করে দিই। তার এই করম্নণ পরিণতি দেখে শিয়রে বসে থাকা আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।
৬ তলার দু'কৰের এই বাড়িটি ড্রইংরম্নমে নিহত শিশু স্কুল ছাত্র হামিমের পিতা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব শেখ ছেলের ছবি নিয়ে নিথর দেখে বসেছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ করে আচমকা চিৎকার করে বলে ওঠেন হামিম কইরে? কারে ভাত খাওয়াবো। কে আমার কোলে ঘুমাবে? আমার ভাল লাগে না। এই বলে আবার নিসত্মব্ধ হয়ে যান। পাশে নিহত শিশু হামিমের মামা রিয়াজউদ্দিন শিবলু খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করে বলছিলেন, হামিম মামাগো নাচবি না। বলবি না খেলনা কিনে দাও? বই-খাতা বের করে বার বার বলছিল, কি সুন্দর হাতের লেখা। ও কাঁধে চড়ে আর দোকানে যাবে না। এই বলে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। নিহতের মামা রিয়াজউদ্দিন শিবলু। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, শুক্রবার এলেই হামিম বলত মামা আমি জুমার নামাজ পড়তে যাব। এখন কাকে নিয়ে আমি জুমার নামাজ পড়তে যাব। এই সময় নিহতের পিতা ব্যবসায়ী মোতালেব শেখ বলছিলেন, আমার মানিকের জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করছিস কেন? ওই এলে বকাঝকা করবে। আমার ভাল লাগে না। এই বলে বুক চাপড়াচ্ছিলেন। দুঃখ-কষ্টে যন্ত্রণায় মোতালেবের চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। নির্বাক নিথর হয়ে সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। চোখ টকটকে লাল হয়েছিল।
পুরো বাড়িটিতে যেন শোকের মাতম চলছিল। নিহতের নানি আফসানা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পাশে নিজ বাড়ি ১০৮ নং লুৎফর রহমানের বাড়ির নির্মাণ কাজ চলছে। ৩/৪ মাস আগে মেয়ে সোনিয়া এই বাসা ভাড়া নিয়েছে। নাতি হামিম সারাদিন তার মামা শিবলুর সঙ্গে থাকতেন। খালি বলত চিংড়ি মাছ এনে দাও। কচু শাক দিয়ে চিংড়ি মাছ ভাজা খাব। এখন কে আবদার করবে চিংড়ি মাছ ও কচু শাকের কথা। নাতি আমার চিকেন বার্গার খেতে ভালবাসত। ওর বাবা কিছু খাবার এনে দিলেই বলতো মামা শিবলু এনে দিয়েছে। তার বাবা বললেও বিশ্বাস করত না। এ সময় ওই বাড়িতে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন একের পর এক ঢুকছিল। আর নিহত শিশু হামিমের মায়ের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল। কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিল না। কান্না আর বেদনায় বুক বেঁধে অনেকে ওই বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিলেন।
উলেস্নখ্য, বুধবার সকালে কাকরাইল উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুলের কেজি ছাত্র মোঃ ইয়াছিন হামিম শেখ (৭) ছুটি শেষে মা সোনিয়া শেখের সঙ্গে রিক্সাযোগে বাসায় ফিরছিলেন। কাকরাইল ক্রসিংয়ে মধুমতি পরিবহন (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-১৩৪৭) নামে একটি বাস তাদের রিক্সা চাপা দেয়। ঘটনাস্থলে স্কুলছাত্র হামিমের মর্মানত্মিক মৃতু্য ঘটে। ঘটনার পর স্কুলের শিৰাথর্ীরা সড়ক অবরোধ ও গাড়ি ভাংচুর করে। এ সময় বাসচালক শামছুদ্দিনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। রমনা থানা হাজতে চালক শামছুদ্দিন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে বলে, আমার মালিকের অনেক টাকা। আমাকে কিছুই করতে পারবি না। পরে পুলিশ কাছ থেকে নকল লাইসেন্স জব্দ করে।
এদিকে নিহত ছাত্র হামিমের লুৎফর রহমান লেনের বাসিন্দারা ৰোভ প্রকাশ করে জানান, বাস চালকদের বেপরোয়ায় আর কত শিশু অকালে ঝরে যাবে। এ ব্যাপারে সরকার সড়ক দুর্ঘটনায় আইন সংশোধন করে কঠোর আইনের ব্যবস্থা করম্নক। তাঁরা হামিমের হত্যাকা-ের বাস চালক ও মালিকের ফাঁসি দাবি করেন। নিহতের পরিবারের দাবি স্থানীয়দের নিয়ে আগামী শনিবার থেকে হামিমের উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুল থেকে মানববন্ধন করে টানা কর্মসূচী পালন করবে। এতে করে খুনী চালকের ফাঁসি ও সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক বাসত্মবায়ন হোক।
উইলসের ৰুদে শিৰাথর্ী শিশু হামিমকে বাস চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ী বাস চালক শামসুর রহমানের ড্রাইভিং লাইসেন্স ভুয়া। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বৃহস্পতিবার আদালত থেকে একদিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। মধুমতি পরিবহনের ঘাতক বাসটিকে শাহবাগ কন্ট্রোলরম্নম হেফাজতে রাখা হয়েছে। দায়ী বাসচালকের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মির দাবিতে ও নিহত হামিম স্মরণে কাকরাইল উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুল বন্ধ। স্কুলে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। মানববন্ধন পালিত হয়েছে। এই ঘটনায় দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি না দেয়া হলে পরবর্তীতে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে।
বাস চাপায় নিহত স্কুলছাত্র শিশু হামিমদের সুরিটোলার লুৎফর রহমান লেনের বাসায় শোকের মাতম। পুত্র হামিম নিহত হওয়ার সময়ে আহত মা সোনিয়া শেখকে হাসপাতাল ভার্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার তাকে হাসপাতাল থেকে প্রাইভেট কিনিকে ভর্তির জন্য বাসায় আনা হয়েছে। মুখম-লের ডান দিকে এমনভাবে থেঁতলে গেছে যে তিনি কোন কথা বলতে পারছে না। এক মাত্র পুত্রকে হারিয়ে পিতা আবদুল মোতালেব শেখ শোকে পাথর। এর মধ্যে টেলিফোনে তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে, দায়ী বাস চালকের বিরম্নদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে হবে। নতুবা শিশু হামিমের চেয়ে আরও বেশি কঠিন মূল্য দিতে হবে। শিশু হামিমের নিহত হওয়ার ঘটনায় কাকরাইলের উইলস্ লিটল ফাওয়ার ছুটি পালিত হয়েছে। দায়ী বাস চালকের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মির দাবিতে পালন করা হয়েছে মানববন্ধন। শিশু হামিমের ময়নাতদনত্ম সম্পন্ন হওয়ার পর বুধবার বাদ এশা লুৎফুর রহমান লেনে সুবেদার ঘাট জামে মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নামাজে জানাজা শেষে বুধবার রাতে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
এদিকে রক্তের দাগ না শুকাতেই মধুমতি পরিবহনের ঘাতক বাসটিকে আটক অবস্থা থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য মালিক পৰ দৌড়ঝাঁপ শুরম্ন করেছে। বাসের চালক শামসুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ৩ দিনের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানায়। আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার পর তাকে পুলিশে হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ ও তদনত্ম করে জানতে পেরেছে, চালক শামসুর রহমানের ড্রাইভিং লাইসেন্সটি ভুয়া। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সটি দালালের মাধ্যমে সে সংগ্রহ করেছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সটি পুলিশ জব্দ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.