অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ করতে উন্মুক্ত হচ্ছে লাইসেন্স পদ্ধতি- ৩ হাজারের বেশি লাইসেন্স দেয়া হতে পারে by ফিরোজ মান্না

অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই খাতে সারা দেশে ৩ হাজারের বেশি লাইসেন্স দেয়া হতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্য করে বহু প্রভাবশালী ‘আলাদীনের চেরাগ’ হাতে পেয়েছিল।


এই চেরাগ হাতে পেয়ে ক্ষমতাবান প্রভাবশালীরা রাতারাতি সোনার হরিণের মালিক হয়েছেন। তাঁদের হাতে প্রতিদিন হাওয়ায় এসেছে কোটি কোটি টাকা। হাওয়ার টাকায় পাহাড় গড়ে তুলছেন তাঁরা। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির পাল্লায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে ভিওআইপিকে উন্মুক্ত করা হচ্ছে। মন্ত্রণালযের নির্দেশে বিটিআরসি ভিওআইপি লাইসেন্সের একটি গাইডলাইন তৈরি করে এ বছরের গোড়ার দিকে জমা দিয়েছে। মন্ত্রণালয় এই গাইডলাইনের ভিত্তিতে ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের জন্য একটি শক্তিশালী ‘অবৈধ ভিওআইপি অনুসন্ধান’ নামে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয় বিটিআরসি। এই কমিটি দীর্ঘ তিন মাস বিটিসিএল ও টেলিটকের তদন্ত শেষে ১৩টি কারণ খুঁজে পেয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়, অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের জন্য লাইসেন্স দিয়ে এটাকে বৈধ করাই ভাল। লাইসেন্সের ক্ষেত্রে কঠিন শর্ত জুড়ে দিলে আর কেউ অবৈধ ভিওআইপি করার সাহস পাবে না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এখন ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
কমিটি পরবর্তীতে এই কারণগুলোই সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, পূর্ণাঙ্গ ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্চ (আইসিএক্স), অত্যাধুনিক সফটওয়্যার, রেডিও লিঙ্ক ব্যবহার, কললিস্ট মুছে ফেলাসহ মোট ১৩টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অবৈধ ভিওআইপি হচ্ছে। এগুলো বন্ধ হলে অবৈধ ভিওআইপি বহুগুণে কমে যাবে। গত বছরের এই সময়েও প্রতিদিন বৈধপথে সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল দেশে আসত। বর্তমানে তা ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি মিনিটে দাঁড়িয়েছে। বাকি প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে যাচ্ছে। এই কল থেকে সরকার কোন রাজস্ব পাচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট চক্র অনেকদিন ধরেই ওই ব্যবসা করে আসছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল আর টেলিটক এখন ভিওআইপি ব্যবসার নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) বন্ধের জন্য সরকার ৩ হাজারের বেশি ভিওআইপি লাইসেন্স দিতে পারে। বিটিআরসি ভিওআইপি লাইসেন্সের গাইডলাইন তৈরি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় বিটিআরসির পাঠানো গাইডলাইন পর্যালোচনা করে এ মাসেই লাইসেন্স দেয়ার অনুমতি দিতে পারে। ভিওআইপি লাইসেন্স উন্মুক্ত হলে অবৈধ কল কমে যাবে। অবৈধ ভিওআইপির কারণে প্রতিবছর সরাকার প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। ভিওআইপি বৈধ করলে এই টাকা সরকারের ঘরে আসবে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) জিয়া আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অবৈধ ভিওআইপি কল বন্ধ করতে টেলিযোগাযোগের বিভিন্ন খাতে ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়া হবে। লাইসেন্স সংখ্যা বাড়ালে প্রতিযোগিতামূলকভাবে লাইসেন্সধারীরা কল বাড়াবে। এক সময় বিদেশী কল আদানপ্রদান হতো প্রতিদিন সাড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি মিনিটি। এর মধ্যে দুই থেকে আড়াই কোটি মিনিট কল অবৈধপথে চলে যায়। সরকার মনে করছে লাইসেন্স বাড়ালে বেশি পরিমাণ রাজস্বও বাড়বে। ভিওআইপি লাইসেন্সের গাইডলাইন তৈরি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেলেই লাইসেন্স দেয়ার কাজ শুরু হবে।কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতে কোন লাভ হবে না। অবৈধ ভিওআইপি চলতেই থাকবে। ভিওআইপি একটি প্রযুক্তি এবং সেটিকে মোকাবেলা করতে হবে প্রযুক্তি দিয়ে। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরও ভিওআইপি করছে। আবার কেউ কেউ ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ কিনে রেডিও লিঙ্কের মাধ্যমেও ভিওআইপি চালিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যবসা প্রভাবশালী মহলের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রভাবশালীদের হাত থেকে ভিওআইপি সরাতে হলে বিটিআরসি ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক বলে মনে করছে। তখন আর এককভাবে প্রভাবশালীরা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আইজিডব্লিউয়ের (ইন্টারনেট গেটওয়ে) মাধ্যমে কল নিতে হবে। অন্য পথে কল নেয়ার কোন সুযোগ থাকবে না।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সংশোধিত নীতিমালায় আন্তর্জাতিক গেটওয়েসহ বেশ কয়েকটি টেলিযোগাযোগ মাধ্যমের ৮৪ লাইসেন্স দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লং ডিস্টান্স সার্ভিসেস (আইএলডিটিএস) নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে টেলিযোগাযোগ খাতকে কুক্ষিগত না রেখে একাধিক ক্যাটাগরিতে লাইসেন্স দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইএলডিটিএস নীতিমালা ঘোষণা করে আগেই ভিওআইপি উন্মুক্ত করেছে। বর্তমান সরকার কেবল নীতিমালা সংশোধন করে ভিওআইপিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির লাইসেন্স দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
দুই বছর আগেও দেশে প্রতিদিন ইনকামিং কলের পরিমাণ সাড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি মিনিট। এর বাইরে আড়াই থেকে তিন কোটি মিনিট কল আসে অবৈধপথে। বর্তমানে অবৈধ কল অনেক বেশি হওয়ায় সরকারের দিনে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বছর শেষে এ ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটিতে দাঁড়াচ্ছে। অবৈধ কল যাচাইয়ের জন্য ডিপ প্যাকেট ইন্সপেকশন (ডিপিআই) নামে একটি যন্ত্র থাকলেও ইচ্ছাকৃতভাবে এর ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক কল আদান প্রদানের জন্য আইজিডব্লিউ হচ্ছে মূল মাধ্যম। আইজিডব্লিউর মাধ্যমে কত কল আদানপ্রদান হচ্ছে তা দেখার জন্য বিটিআরসি একটি বৈঠক ডেকেছে। এজন্য সব গেটওয়ে অপারেটর ও বিশেষজ্ঞ ও বিটিআরসি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ভিওআইপির সুইচ রুম পরিদর্শন থেকে শুরু করে ভিওআইপি বন্ধের জন্য কাজ করবে। কমিটি বিটিসিএলের মোট কলের হিসাব দেখবে। আগামী সপ্তাহ থেকে অনুসন্ধান কাজ শুরু করবে কমিটি। বৈধপথে কল আদানপ্রদান অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার কারণে বিটিআরসি এই ব্যবস্থা নিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.