অনিয়মে নিয়মিত by এ এম এম শওকত আলী

পত্রিকান্তরে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে এক হাজার ৮৩৭ জনকে বিধি লঙ্ঘন করে রাজস্ব খাতভুক্ত পদে নিয়মিত করা হয়েছে। এ দেশে বাজেট দুই ধরনের- এক. উন্নয়ন বাজেট, দুই. রাজস্ব বাজেট। উন্নয়ন বাজেটভুক্ত কর্মকর্তারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভ করেন। অর্থাৎ নিয়মিত বা স্থায়ী পদের সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পান না।


প্রকল্প শেষে তাঁরা চাকরি হারান। নিয়ম হলো- যদি প্রকল্প সমাপ্তির পর তাঁদের রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করতে হয়, তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ অর্থ বিভাগের সম্মতির প্রয়োজন হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রস্তাব প্রথমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং পরে অর্থ বিভাগে পাঠাবে। এ জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দিষ্ট ছক ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা আছে। এ ছকে প্রস্তাব পাওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে।
এ প্রক্রিয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে। উদ্যোগী মন্ত্রণালয় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তাব প্রেরণকারী বিভাগকে অনুরোধ করে। উত্তর দেওয়ার পর আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কিছু প্রশ্ন নতুন করে উত্থাপন করে। এ নিয়ে চিঠি চালাচালি চলে অন্তহীনভাবে। নিষ্পত্তিতে কত সময় ব্যয় করা হয় তা অজানা। যে বিষয়টি জানা তা হলো দুই থেকে পাঁচ বছর বা এরও বেশি সময় লাগে। ভুক্তভোগীরাই এ কথা বলে থাকেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনিয়মিতভাবে নিয়মিত যাঁরা হলেন তাঁরা ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পভুক্ত ছিলেন। ধারণা করা সম্ভব যে কোনো প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বা একই প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা চাকরিরত ছিলেন। এ ধারণার ভিত্তি হলো নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পে কোনো কর্মকর্তা ২০ থেকে ২৫ বছর চাকরিতে থাকার কথা নয়। তবে প্রকাশিত সংবাদে অন্য রকমের তথ্য পাওয়া যায়। প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ না করেই এসব কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে। যে বিষয়টির কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি তা হলো, এত বছর ধরে এ তথ্য কেন জনপ্রশাসন বা অর্থ মন্ত্রণালয় জানতে পারেনি।
অর্থ বিভাগের ক্ষমতা যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংসদে বাজেট প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পেশ করার মধ্যেই সীমিত। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদের প্রাথমিক অনুমোদন। ১০ বছর ধরে অধিদপ্তর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি অনুমোদনের জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত এ বছরের জুলাই মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ভূতাপেক্ষ সম্মতি দেয়।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছে- এক. মানবিক কারণ, দুই. দক্ষ জনবলের অভাব। মানবিক কারণের ভিত্তি হলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত কোনো বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রশ্ন হলো, বেতন-ভাতা না পাওয়া সত্ত্বেও কিভাবে তাঁরা কাজ করলেন। আয়হীন পদে কি কেউ কাজ করে? বেতন-ভাতা না পাওয়ার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে, তাঁদের বেতন-ভাতার সংস্থান এত বছর ধরে অনুমোদিত রাজস্ব বাজেটে ছিল না। অর্থাৎ এত দিন পর্যন্ত অর্থ বিভাগ বিষয়টি মেনে নেয়নি। অনিয়মে নিয়মিত করার সিদ্ধান্তের অন্য যৌক্তিকতা ছিল দক্ষ জনবলের পর্যায়ক্রমে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তিকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
প্রচলিত সরকারি নিয়ম সময়মতো কঠোরভাবে অনুসৃত না হলেই সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়। এ ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। বলা হয়েছে, এ সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে কোনো উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এ যুক্তিও খোঁড়া যুক্তি। মৌলিক বিষয় হলো বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক হওয়া কাম্য নয়। হওয়ারও কোনো যুক্তি নেই। সরকার কি সার্বিকভাবে জানে অন্যান্য অধিদপ্তরে কতজন ১০ বছরেরও অধিককাল ধরে প্রকল্পে কাজ করছেন। সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কী হবে? অন্যদিকে এ কথাও সত্য, অনেক সরকারি নিয়ম বাস্তবসম্মত নয়। সরকারি সব নিয়মই বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা দ্বিখণ্ডিত বাজেট। প্রকল্প অনুমোদনের পর্যায়েই যদি সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রকল্পের মেয়াদান্তে নূ্যনতমসংখ্যক কর্মকর্তা রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরিত হবেন তাহলে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু কিছু কারণে তা হয়ে ওঠে না। মূল কারণ সময়ের অভাব। প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। কাজেই কালক্ষেপণ না করে প্রকল্প অনুমোদন ত্বরান্বিত করতে হবে। প্রকল্প সমাপ্তির পর কর্মরত ব্যক্তিদের রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর পৃথকভাবে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
বাস্তবে এ নিয়ম কিছু ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় না। অনুসরণ করার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হলো নতুনভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা। এর আওতায় গণবিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। পরে লিখিত পরীক্ষা। এরপর যোগ্য প্রার্থীদের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মৌখিক পরীক্ষা। ফল প্রকাশ। সুপারিশকৃত প্রার্থীদের নিয়োগ অনুমোদন। জানা যায়, আজকাল তদবিরের ভয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর মধ্যে সম্পৃক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করেন। এ কথা কারো অজানা নেই। সময়ে সময়ে মিডিয়া এ ধরনের বহু সংবাদ প্রকাশ করেছে। ২০০১-০৬ সময়কালে কোনো এক জেলার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অনিয়মের জন্য নিয়োগ দেওয়া বন্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন দপ্তরের নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে পারলে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজতর হতো।
প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একাধিক স্তরে প্রস্তাব পরীক্ষা করা হয়। নির্ধারিত ছকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। এরপর আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় জনপ্রশাসন, অর্থ ও পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। এ পর্যায়ে কিছু কাটছাঁট হয়। অন্তত দুটি ক্ষেত্রে- এক. জনবল, দুই. অর্থ বরাদ্দ। এর সঙ্গে আছে যানবাহনের সংখ্যা। প্রকল্প-পরবর্তী পর্যায়ে গৃহীত কার্যক্রমের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু জনবল অত্যাবশ্যক। এ বিষয়টি আমলেই নেওয়া হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ধাপ পার হওয়ার পর প্রকল্প অনুমোদন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রস্তাব পরীক্ষা করে। প্রয়োজনবোধে কিছু প্রশ্নও উত্থাপন করে। অধিদপ্তরের মতামত নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রশ্নের উত্তর পাঠায়। উত্তর সন্তোষজনক হলে প্রস্তাবটি প্রাক-একনেক সভায় একনেকে অনুমোদনের জন্য বিবেচিত হয়। এত সব ধাপ থাকা সত্ত্বেও কোনো ধাপেই প্রকল্প সমাপ্তির পর রাজস্ব খাতে কত জনবলের প্রয়োজন হবে সে বিষয়টি কখনো আমলে নেওয়া হয় না। এর ফলে প্রকল্প সমাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য শুরু হয় উদ্যোগ। এ পর্যায়েও মানবিক কারণের যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। বলা বাহুল্য, রাজস্ব খাতে প্রকল্পের জনবলের আধিক্য হলে সরকারের ব্যয়ভার বৃদ্ধি পাবে। এ দিকটিও বিবেচনায় আনতে হবে। এ কথা সত্যি যে প্রস্তাবিত সব জনবলই রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয় না। একই সঙ্গে এটাও সত্য, প্রায় সবক্ষেত্রে সঠিক মানদণ্ডের আলোকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য বিবেচনা করা সম্ভব হয় না। মূলত বিবেচনার প্রধান নিয়ামক হয় এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিপ্রায়।
কয়েক বছর ধরে জাতীয় বাজেট সংস্কার নিয়ে কিছু কথা শোনা গিয়েছিল। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থেকে বলা হয়েছিল রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট একীভূত করা হবে। পরীক্ষামূলকভাবে বৃহৎ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ওই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে। এর ফলে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটে এসব মন্ত্রণালয়ের জন্য আর পৃথক বরাদ্দ থাকবে না। এ কাজটির অগ্রগতি কী তা সম্পূর্ণ অজানা। তবে এটা যে করা এখনো সম্ভব হয়নি তা অবশ্যই দৃশ্যমান। এখনো যেসব বৃহৎ মন্ত্রণালয়ে দুই বাজেট একীভূত করা হবে, সেসব মন্ত্রণালয়ের জন্য পৃথক উন্নয়ন বাজেট প্রথা চালু আছে। যদি আদৌ এটা করা সম্ভব হয় তাহলে প্রকল্প জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে। অনিয়মিতকে নিয়মিত করার প্রয়োজন হবে না। তবে এ লক্ষ্য অর্জন করা দুরূহ। অনেকেই বলবেন যে এর ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে এ কথাও বলা যায়, কিছু ক্ষেত্রে রাজস্ব বাজেট থেকে অর্থ বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন করে থাকে। তবে প্রকল্প ক্ষুদ্র আকারের হতে হবে। কোনো নতুন জনবল নিয়োগ করা যাবে না। অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রে বহিরাগতদের চুক্তির ভিত্তিতে বেতন দেওয়া যাবে।
সার্বিকভাবে বিষয়টি জনপ্রশাসন সংস্কারের সঙ্গে জড়িত। অতীতে এ ক্ষেত্রে অনেক সরকারি বা দাতা সাহায্যপুষ্ট সমীক্ষা হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো আগ্রহ নীতিনির্ধারকরা দেখাননি। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে প্রধানমন্ত্রীর দিন বদলানোর স্বপ্ন কোনো দিনই বাস্তবায়িত হবে না। এ ক্ষেত্রেও আশু নজর দেওয়া প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.