উইকিলিকস ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের জবাবদিহি by মিজানুর রহমান খান

উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন দূতাবাসের সর্বশেষ দলিলটি অন্তত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের ভূমিকা ও জবাবদিহির প্রশ্ন সামনে এনেছে। ড. গওহর রিজভী যদিও দাবি করেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির সঙ্গে ওই তারিখে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তাহলে ধরে নিতে হবে, মরিয়ার্টি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে একটি বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন। ড. রিজভীর দাবি সত্য হলে সেটি হয়তো হবে মার্কিন কূটনৈতিক ইতিহাসের এক অদ্ভুত বিপর্যয়। অবশ্য মরিয়ার্টি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বিষয়টি ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আলোকে যাচাইযোগ্য। ওই বার্তাটি বানোয়াট প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। তত দিন এ নিয়ে আলাপ করতে পারি। আমরা হয়তো এ পর্যন্ত একটি মুখ রক্ষার বিবৃতি পেয়েছি। ড. রিজভীর ব্যাখ্যায় মনে হয়েছে, তিনি ‘ব্যক্তিগতভাবে’ বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সত্যিই দেখা করেননি!
সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেন। সে দেশে বিশেষ উপদেষ্টা রয়েছে। সহজেই বোঝা যায়, কে মন্ত্রী আর কে উপদেষ্টা। কোন কাজ মন্ত্রী করেন, কোন কাজ উপদেষ্টা করেন। কিন্তু আমাদের দেশে তা ঠাহর করা যায় না। দেশে উপদেষ্টার আকস্মিক প্রাদুর্ভাব ঘটল। ৪৪ জন মন্ত্রীর দেশে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত উপদেষ্টা সাত। কোনো আইন হলো না।
এক-এগারোতে ভাগ্যবিড়ম্বিত আব্দুল জলিল ২০০৯ সালে সংসদে কথাটা তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘উপদেষ্টারা মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসতে পারেন না। কারণ সেখানে অনেক গোপনীয় বিষয় আলোচিত হয়। মন্ত্রীরা গোপনীয়তার শপথ নেন। উপদেষ্টাদের নিতে হয় না।’ প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদ ক্ষুব্ধ হন। বলেন, ‘তিনি মন্ত্রিসভায় বসতে পারেননি। তাঁর ক্ষোভ তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারেন। সংসদে বলাটা দৃষ্টিকটু।’ ড. আলাউদ্দিন স্পষ্টতই ভ্রান্ত। আমরা ভুলিনি, চরম দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির ধাক্কা সামাল দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। গত বছর তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বিষয়ে একটি নন্দিত তালিকা করেন। সচেতন মহলে তা প্রশংসিত হয়। কিন্তু অবাঞ্ছিত দলীয় ও কোটারি চাপ আসে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটান। তিনি উপদেষ্টা আলাউদ্দিনকে সেই তালিকা সংশোধন করতে বলেন। তবে এ ধরনের কাজে উপদেষ্টাদের সম্পৃক্ত করা প্রমাণ দেয়, সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় উপদেষ্টা কী কাজে লাগে, সে ব্যাপারে শাসকদের ধারণা নেই। চাকরি দিতে হবে। কারও ঠাটবাট, ওজন আরও বাড়াতে হবে। তাই পদ সৃষ্টি করা। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর উপদেষ্টার কথা শুনেছিলাম। ইদানীং জানছি, ‘প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা’ এই নামেও অঘোষিত পদ আছে। কোনো বিষয় নির্দিষ্ট ছাড়া ‘প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা’ পদ অন্য কোথাও আছে কি না, সন্দেহ।
সরকারের কাজ আর সরকারি দলের কাজ সব সময় এক হতে পারে না। ব্রিটেনের চেয়ে এ সমস্যা আমাদের বেশি। ব্রিটেনের আচরণবিধি মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের কাজের ফারাক স্পষ্ট করেছে। তাদের বিধি বলেছে, সরকার ও সরকারি দলের কাজে কখনো ‘ওভারল্যাপ’ বা দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। তখন স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তারা তাতে জড়াবে না। তখন মন্ত্রীদের সহায়তা দেবেন বিশেষ উপদেষ্টারা। প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনকে নির্দলীয় রাখাও বিশেষ উপদেষ্টা নিয়োগের অন্যতম দায়িত্ব। আর আমরা দেখি উল্টো। নির্দলীয় বিষয়ে দলীয় বিষ ঢালেন উপদেষ্টা।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাত উপদেষ্টা। মন্ত্রীদের কারও নেই। ব্রিটিশ মন্ত্রীরা কিন্তু অনধিক দুজন বিশেষ উপদেষ্টা নিতে পারেন। তবে তাঁদের নিয়োগপত্রে বিষয় ও কী ধরনের কাগজপত্র দেখবেন, তা নির্দিষ্ট থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই উপদেষ্টারা মন্ত্রিসভা বৈঠকেও অংশ নিতে পারেন।
এ বিষয়ে দু-একটি উদাহরণ দিই। লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচার। প্রধানমন্ত্রিত্বের শুরুতে উপদেষ্টা নিয়োগে নিরাসক্ত ছিলেন। রাজনীতি বিষয়ে মন্ত্রী, নীতিনির্ধারণী বিষয়ে মন্ত্রণালয়। এ-ই ছিল তাঁর মন্ত্র। পরে মত পাল্টান। অ্যান্থনি স্টিফেন কিং লিখেছেন, ১৯৮০ সালে থ্যাচার ভাবলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ঠিকভাবে চলছে কি না, তার নজরদারি দরকার। মুদ্রানিয়ন্ত্রণবাদী মার্কিন অর্থনীতিবিদ অ্যালান ওয়াল্টারকে নিয়োগ দেন। তাঁর জ্যেষ্ঠতা ও স্বাধীন মর্যাদা বজায় রাখতে হবে। তাই তাঁর পদমর্যাদা ছিল অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তিরাশির জানুয়ারিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। তবে খণ্ডকালীন উপদেষ্টা হন। মাসে একটা সপ্তাহ লন্ডনে কাটাতেন।
মার্কিন অধ্যাপক ওয়াল্টারকে দিয়ে থ্যাচার কী কাজ করিয়েছেন, তা দুনিয়াসুদ্ধ মানুষ জানে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তা অকপটে বলতে পারবেন। কিন্তু স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. রিজভী কী করছেন, তা কি আমরা জানতে পারছি, নাকি পারব? আমাদের পেশাদার কূটনীতিকদের কাছে কি স্পষ্ট যে দেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কী কাজ করেন? ড. রিজভী রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান। আমাদের ছাত্রদের কি পড়ানো হবে যে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কাজ কী। আমাদের মন্ত্রীদের অনেকেই উপদেষ্টাদের প্রতি বিরক্ত। কারণ অহেতুক তাঁরা তাঁদের মাথার ওপর ছায়া ফেলেছেন। তাঁদের পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদা অপরিহার্য কেন? মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজনকে অবৈতনিক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা করেছেন। মন্ত্রীর মর্যাদা দরকার হয়নি। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁরও তখন মন্ত্রীর পদমর্যাদা দরকার পড়েনি। আমাদের উপদেষ্টারা পদমর্যাদায় পূর্ণ মন্ত্রী।
বিধিবিধানের বাঁধন সত্ত্বেও উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ব্রিটেনেও আছে। জেমস কালাহান সরকারের বিশেষ উপদেষ্টা লর্ড ম্যাক নেলি সম্প্রতি বলেন, ‘বিশেষ উপদেষ্টা ও সিভিল সার্ভেন্টদের মধ্যে ভারসাম্য আরও নিকৃষ্ট রূপ নিচ্ছে। কোনো ব্যক্তি এখন সহজেই রাজনৈতিক নিয়োগ থেকে সিভিল সার্ভেন্ট কিংবা সিভিল সার্ভেন্ট থেকে রাজনৈতিক নিয়োগ পেতে পারেন।’
আমরা উদ্বিগ্ন হতে পারি এই ভেবে যে আমাদের আমলাতন্ত্র এবং আগ্রহীরা ক্রমশ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পদে ‘বিশেষ বিনিয়োগে’ আগ্রহী হতে পারে। আব্দুল জলিলকে খণ্ডাতে গিয়ে ড. আলাউদ্দিনের ঔদ্ধত্য মন্তব্য বড়ই উদ্বেগজনক। তাঁর কথায়, ‘কতজন উপদেষ্টা থাকবেন সেটা প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপার। তিনি চাইলে ১০০ জনও থাকতে পারেন।’ তবে তিনি বলেছিলেন, তাঁদের ‘কার্যপরিধি’ আছে। থাকলে সেটা প্রকাশ করা হোক। আমরা জানতে চাই।
১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড সংকটের পর থ্যাচার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন স্যার অ্যান্থনি পার্সনসেক। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় তিনি জাতিসংঘে ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিরাশির ডিসেম্বরে তাঁর দরকার ফুরায়। স্যার পার্সি ক্রাডকক আসেন। কারণ কী। তিনি চীনে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিরাশিতে হংকং প্রশ্নে ব্রিটেনের ভূমিকা কী হবে, সেটা নির্ধারণ জরুরি ছিল। তাই তাঁকে বেছে নেওয়া হয়। এসব আমরা অনলাইনেই জানতে পারি। কিন্তু আমাদের উপদেষ্টাদের কাকে কী কারণে বেছে নেওয়া হলো, সেটা আমরা জানি না। অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ড. রিজভীকে বিশ্ব চেনে। বাংলাদেশ চেনে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক ইস্যুগুলোতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কখন কেমন ছিল, তা আমাদের জানা নেই।
মরিয়ার্টি লিখেছেন, ‘রিজভী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরসংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে অত্যন্ত গোপন ও ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল। শুধু গত সপ্তাহে এতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে।’ এই বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কার্যত বাদ দিয়েই ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ‘ছোট তরী’ এতই ছোট যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তাতে ঠাঁই নেই। যার বিয়ে তার খবর নেই। নীতিনির্ধারণী পেশাদার কূটনীতিকদের অন্ধকারে রাখা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা আমাদের ইতিহাসে বিরল নয়। সামরিক শাসনামলে এর যথেচ্ছাচার ঘটেছে। ড. আলাউদ্দিনও বলেছেন, উপদেষ্টা নিয়োগ নতুন নয়। জিয়ার আমল থেকে চলছে। বাহ্। কী চমৎকার যুক্তি! সাধে কি বলি, সামরিক শাসন যায়, সামরিক সংস্কৃতি যায় না।
আমরা বহুকাল জেনেছি, ভারতের আমলাতন্ত্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে অন্যতম বড় বাধা। এই সে দিনও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্রীনিবাসনদ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লেখা নিবন্ধে এ বিষয়ে আক্ষেপ করেছেন। মুচকুন্দ দুবের কাছ থেকেও তেমনটাই শুনেছি। ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার থাকাকালে বাংলাদেশকে শূন্য শুল্ক-সুবিধা দিতে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। এর বহু পরে ঢাকায় তিনি আমাকে বলেন, ভারতের আমলাতন্ত্রই বাধা। আর এবারে মরিয়ার্টিকে ড. রিজভী ধারণা দিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দর ও ট্রানজিটের মতো সুবিধা ভারতকে প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রই বাধা। মরিয়ার্টি লিখেছেন, ‘চূড়ান্ত ধাপে এসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও মসিউর রহমানকে; আমলাতন্ত্রের মধ্যে আটকে পড়া চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সম্পর্কে রিজভী বলেন, ‘তাঁদের সৃজনশীলতা ও দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে।’
তবে ড. রিজভী তাঁর বক্তব্য অস্বীকার করলেও মরিয়ার্টি করেননি। তাঁর কাছ থেকে আমাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম পাঠ নিতে পারে। কারণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তল্পিবাহকেরা অনেক সময় সেসব বিষয়ে বড় বড় শিরোনাম ছাপেন, যেগুলো ভারতের জাতীয় স্বার্থের বা অগ্রাধিকারের অনুকূল হয়। মরিয়ার্টি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নতুন ও তুলনামূলকভাবে গৌণ চুক্তিগুলোর (প্রত্যর্পণ, বন্দিবিনিময়, বিদ্যুৎ বিনিময় ইত্যাদি) ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এবং এই সফরকালে সেগুলো স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ সত্যিই আমরা সম্মিলিতভাবে মুজিব-ইন্দিরার ঐতিহাসিক চুক্তির অনুসমর্থন, পানি ভাগাভাগি ও সমুদ্রসীমা ইত্যাদি প্রশ্নে আওয়াজ তুলতে পারিনি। মরিয়ার্টিকে ধন্যবাদ। তিনি যথার্থই বাংলাদেশের প্রেসের দৈন্য চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
মরিয়ার্টি রিজভীর বরাতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিতর্কটি একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক সালিস কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে তখন ভারতীয়রা হতাশ হয়।’ রিজভী সম্ভবত এখানেও অসতর্ক ছিলেন। তিনি যদি মরিয়ার্টিকে এই ধারণা দিয়ে থাকেন যে সমুদ্রসীমা বিতর্কটি বাংলাদেশ একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে গেছে, তাহলে তাতে সত্যের অপলাপ ঘটে। কারণ, ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকারই এ বিষয়ে সংলাপের সূচনা ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছিল, ভারতীয় আমলাতন্ত্র কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে আলোচনার টেবিলে এই বিতর্কের মীমাংসা নেই। অথচ সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পিঠ অনেক আগেই দেয়ালে ঠেকে। তখন উপায়ান্তর না দেখে ভারতের প্রতি বন্ধুপরায়ণ আওয়ামী লীগ কিংবা সমগ্র জাতি ইন্দিরা গান্ধীর দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও আমাদের সরকারকে সালিসিতে যেতে বাধ্য হয়েছে। এতে ভারতের হতাশা নয়, তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। আমরা যখন ভারতকে করিডোর দিই, তখন আমাদের রিজভী সাহেবকে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ‘সামান্য আশাবাদী’ মনে হয়। তার মানে অবশিষ্ট নদ-নদীর ন্যায্য হিস্যার বিষয়ে এখনো আশাবাদী হওয়ার প্রশ্ন আসে না।
ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা উইকিলিকসের এই খবরটি পরিবেশন করতে গিয়ে তার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে শেখ হাসিনার কলকাতা সফর ভণ্ডুল করে দেওয়ার বিষয়টি। তুলনা চলে না, তবে এক অর্থে দিল্লির চেয়ে বরাবর কলকাতা আমাদের বান্ধব। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাসংগ্রামে আমরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলাম। জ্যোতি বসু চলে গেছেন। গঙ্গার মতো সহজে তিস্তা হবে কি না, সন্দেহ। প্রণব মুখার্জির যুগের অবসান ঘটলে আমরা দিল্লির সঙ্গে কাদের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলব, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা দিল্লির সঙ্গে বড় গলায় কথা বলেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কোনো সাড়াশব্দ কিংবা কোনো প্রাণের স্পন্দন পাই না। ড. রিজভী প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্টতই অপরিণামদর্শী পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ দিল্লির সঙ্গে দর-কষাকষিতে কিংবা ছাড় পাওয়া না-পাওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালি রাজনীতিকেরাই কার্যকর ভূমিকা রাখেন এবং রাখবেন। পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজ কিংবা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ মানুষগুলোকে কাছে না টেনে দিল্লি থেকে ঢাকায় উড়ে আসার পরামর্শ সঠিক ছিল না। কারণ, বাংলাদেশের বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির মতো দলকে ভারত প্রশ্নে অহেতুক ভয় করার কোনো কারণ নেই। কারণ তার রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বৈধতা পেয়েছে ভারত-বিরোধিতার বাতাবরণে। তাকে সামলাতে কলকাতাকে চটানো কোনো যুক্তির কথা নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের বিরোধী দলের অপপ্রচার কিংবা পাবলিক খেপানো দিল্লির নীতিনির্ধারকদের অবাক করবে না।
সুতরাং ড. গওহর রিজভী বা অন্য কারও পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীর কলকাতাকে পাশ কাটানো ভুল হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ‘রূপান্তরে’ কলকাতাকে লাগবেই। তবে উপদেষ্টাদের জবাবদিহির বিষয়টিই আমরা বড় করে দেখি। তাঁদের কার কী কাজ থাকবে, মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক কী হবে, তা নির্দিষ্ট করে একটি আইন করতে হবে। ব্রিটিশরা উইকস কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বলেছে, ‘সরকার বিশ্বাস করে না যে বিশেষ উপদেষ্টার বিষয় সংখ্যা দিয়ে বিবেচ্য হতে পারে। ইস্যু হচ্ছে জবাবদিহি, ভূমিকা, দায়িত্বশীলতা ও তাদের সংখ্যার বিষয়ে স্বচ্ছতা।’ আমরাও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কাজের স্বচ্ছতা আশা করি। মন্ত্রীদের সম্পদের বিবরণী চাওয়া হয়েছে। উপদেষ্টারাও দেবেন। তবে বড় দরকার মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের জন্য পৃথক আচরণবিধি।
ড. রিজভীর একটি মনোভঙ্গি উল্লেখ না করলেই নয়। মরিয়ার্টির সঙ্গে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত ও সামাজিক’ সম্পর্ক আছে বলেই তিনি আমাদের অবহিত করেছেন। সেটা তিনি যথারীতি বজায় রাখবেন। কিন্তু মরিয়ার্টির কথিত বার্তার সত্যতা যাচাই করবেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা। সত্যিই তাঁর এই পরিহাস স্বচ্ছ।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.