হতাশার নাম সাকিব-তামিম

রেসিংরুম থেকেই বিদায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বকাপকে। হাসি-আনন্দ, হতাশা-গ্লানি সবকিছুকেই। পরশু ম্যাচ শেষে কোচ জেমি সিডন্স দীর্ঘ বক্তব্যে কঠিন কঠিন কথা যেমন বলেছেন, সব ভুলে সামনের দিকে তাকানোর পরামর্শও দিয়েছেন। রাতেই হোটেল ছেড়ে বিশ্বকাপ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন কোচ, সহ-অধিনায়কসহ অনেক ক্রিকেটার। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানসহ বাকিরা হোটেল ছেড়েছেন কাল সকালে।
বাংলাদেশে বিশ্বকাপের আরও দুটি ম্যাচ বাকি থাকলেও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ। কাল সারা দিন ক্রিকেটাঙ্গনে, সাধারণ্যে সেই উপসংহার নিয়েই ব্যথাতুর আলোচনা হলো। হারবে তো হারবে, ৭৮ রানে অলআউট হয়ে! আরেকটু ভালো কি করা যেত না? অতি বিশ্লেষণী কেউ কেউ সব দোষ চাপাচ্ছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপর। বাংলাদেশকে ৫৮ রানে অলআউট করে দেওয়া ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজই তো নষ্টের গোড়া। এরপর যদি তারা ইংল্যান্ডকে হারাতে পারত, তা-ও হতো। ড্যারেন সামির দল বাংলাদেশের জন্য সেটাও করল না!
৫৮ ও ৭৮ রানের হতাশায় একটা ব্যাপার চাপাই পড়ে যাচ্ছে—বাংলাদেশ তো বিশ্বকাপে তিনটি ম্যাচ জিতেছেও! এর মধ্যে আছে ইংল্যান্ডকে হারানোর গর্ব। বিশ্বকাপ শুরুর আগে আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ডের সঙ্গে আর অন্তত একটা বড় দলের বিপক্ষে জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল সাকিবের দল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই স্বপ্ন পূরণের পরও এত হতাশা! বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারেনি বলেই হয়তো।
কারণ আসলে সেটাও নয়। ৫৮ আর ৭৮-এর লজ্জাই বিশ্বকাপের সব প্রাপ্তিকে মুছে দিচ্ছে। এই দুটি ম্যাচে আরেকটু লড়াই করতে পারলেই এত কষ্ট পেতে হতো না। এত সমালোচনাও হতো না। তিন ম্যাচে জয়ের আনন্দ ছাপিয়ে দুই ম্যাচে এক শর নিচে অলআউট হওয়াটাই এখন ২০১১ বিশ্বকাপের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সঙ্গে সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের উপহার দেওয়া হতাশা তো আছেই। বিশ্বকাপের আগের এক বছরের পারফরম্যান্স এই দুই ক্রিকেটারকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য উচ্চতায়। ক্রিকেট-বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মুখ হয়ে উঠেছিলেন সাকিব-তামিম। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্নও আবর্তিত হচ্ছিল তাঁদের ঘিরেই। প্রত্যাশাকে একটু একটু করে বাড়িয়ে তাঁরাই উঠিয়ে দিয়েছিলেন আকাশে। সেখান থেকে পড়ে গেলে ধপাস শব্দ তো হবেই! সমালোচনাটা সেভাবেই নেওয়া উচিত অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়কের।
সাকিব বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার। ৬ ম্যাচে ১৪২ রান আর ৮ উইকেটে কি সেটির প্রতিফলন ঘটে? গত বিশ্বকাপের আবিষ্কার তামিম এই বিশ্বকাপের আগেও ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের প্রাণভোমরা। তামিম একটা ভালো শুরু এনে দেওয়া মানেই বাংলাদেশের ভালো কিছুর সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া। যেটি পূর্ণতা পাবে ব্যাটে-বলে সাকিবের ধারাবাহিকতায়! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, দেশের মাটির বিশ্বকাপে সে হিসাব মিলল না। তিন জয় পেয়েও যে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ব্যর্থতার প্রতিশব্দ হয়ে যাচ্ছে, সেটির কারণও সাকিব-তামিমের নিষ্প্রভ হয়ে থাকা।
বিশ্বকাপে ছয় ম্যাচে তামিম রান করেছেন মাত্র ১৫৭, ফিফটি একটাই। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে ৭০ রানের সেই ইনিংসটিও কি তামিমসুলভ ছিল? তামিমকে তাঁর মতো মনে হয়েছে কেবল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৮ রানের ইনিংসটিতেই। সেই ইনিংস আরও বড় না হওয়ায় বাঁহাতি এই ওপেনার নিজেই নিজের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘৪০ রানকে এখন ব্যর্থতা মনে হয়।’ তবে শেষ ম্যাচে সাকিবের ৩০ রানকেও অনেক মনে হলো। ৭৮ থেকে এই ৩০ বিয়োগ দিলে যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৮-এর চেয়েও ১০ রান কম হয়ে যায় বাংলাদেশের! বিশ্বকাপে সাকিবেরও একটিই ফিফটি এবং সেটিও ভারতের বিপক্ষে। এরপর ১৬, ৮, ৩২, ১ এবং ওই ৩০। সাকিব নিজেই নিজের জন্য যে উঁচু মানদণ্ড ঠিক করে রেখেছেন, তাতে এই পারফরম্যান্স তাঁকে যন্ত্রণায় পোড়ানোরই কথা।
পোড়াক। বিশ্বকাপ-হতাশার জ্বলুনি সবারই আছে, সাকিবের না হয় একটু বেশিই থাকল। অধিনায়ক সাফল্যের হাততালি যেমন নেবেন, ব্যর্থতার গ্লানিও তো তাঁকেই বেশি বইতে হবে! সমস্যা একটাই—‘মার ঘুরিয়ে’র বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের জন্য হয়ে থাকল ‘মার পুড়িয়ে’র বিশ্বকাপ।

No comments

Powered by Blogger.