একেই কি বলে আমলাতন্ত্র by শান্তনু কায়সার

সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, ৯ ডিসেম্বর বরগুনার একটি উপজেলায় একাদশ শ্রেণীর চূড়ান্ত পরীক্ষা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা রোকেয়া দিবসের শোভাযাত্রায় অংশ নিতে বাধ্য হয়। এর আগে হরতালের জন্য এই পরীক্ষা ৯ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরীক্ষার জন্য উত্তরপত্র বিতরণের পর কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘ইউএনও স্যারের’ নির্দেশ, পরীক্ষা রেখে রোকেয়া দিবসের শোভাযাত্রায় যেতে হবে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেছেন, পরীক্ষার বিষয়টি তিনি ইউএনওকে জানিয়েছিলেন আর ইউএনও বলেছেন, তাঁরা পরীক্ষা বন্ধ রেখে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন বলে তাঁর জানা নেই। তিনি অবশ্য এড়িয়ে গেছেন, পরীক্ষার কথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান তাঁকে জানিয়েছিলেন কি না। জানানোটাই স্বাভাবিক, তবে মনে হয়, যৌক্তিকতার চেয়ে সরকারি কর্মসূচি ‘সফল’ করাটাই ছিল তাঁর কাছে মুখ্য বিবেচ্য। যে রোকেয়া নারীশিক্ষা তথা শিক্ষার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁর দোহাই দিয়ে শিক্ষালাভের একটি পর্যায়ে যদি নির্ধারিত পরীক্ষা দিতে দেওয়া না হয়, তাহলে রোকেয়ার নামে তাঁর বা তাঁর স্মৃতিকেই অসম্মান করা হয়।
কিন্তু আমলাতন্ত্র কি সে কথা শোনে, না বুঝতে চায়? রাজনীতি পরীক্ষা হতে দেয়নি এক দিন, আরেক দিন আমলাতন্ত্র পূর্বাপর কোনো কিছুই বুঝতে চায়নি। উভয়ই আমলাতন্ত্র এবং উভয়ের কাজ ক্ষমতা প্রদর্শন। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে যে পরীক্ষা হচ্ছিল, তা অন্যত্র নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। তাহলে এই কেন্দ্রে যারা পরীক্ষা দিতে পারেনি, তাদের কী হবে? সে কথা বোঝার দায় তো রাজনীতি বা আমলাতন্ত্রের নয়। তারা তো আহ্বান করে অথবা নির্দেশ দিয়েই খালাস।
যে দৈনিকে এ খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, সেই দৈনিকেরই অন্য একটি খবর পড়ে বিব্রত বোধ করেছি। বেগম রোকেয়ার নামাঙ্কিত একটি পদক পেয়েছেন একজন নারী। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অবদান থাকলে তিনি তা পেতেই পারেন। কিন্তু দৈনিকটির খবর থেকেই যে জানতে পারছি, তিনি একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই কেনার জন্য অনুদান দিয়েছেন এবং ঢাকার একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনৈক ছাত্রীর শিক্ষার খরচ বহন করছেন—এর জন্যই কি তাঁর এই পদক পাওয়া? অস্বস্তি ছাড়া আর কী হতে পারে? অস্বস্তি বেড়ে যায় আরও এই কারণে যে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিশিষ্ট একজন কবি এবং সেখানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন আরেকজন কবি। আমাদের একজন প্রধান কবি যে বলেছেন, পরাজিত হতে জানেন না কবিরা—তা অন্তত এ ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
সৃজনশীলতাকে বর্জন করে কাজ পণ্ড করাকে আমলাতন্ত্র বলে কি না জানি না, তবে এ ধরনের উদাহরণ দেখে কখনো কখনো মনে এ বিষয়ে সংশয় জাগে। বেশ কয়েক বছর আগে জাতীয় পর্যায়ে ঢাকার বাইরে নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপনের শুরুতে কবির স্মৃতিচিহ্নিত একটি শহরে তখনকার প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করেছিলেন। কিন্তু তার দু-এক দিন পরের সেমিনারে ঘটে মজার কাণ্ড। ক্রেতা-দর্শক নেই, অথচ সেমিনারের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এর মূল দায়িত্বে যিনি ছিলেন, দেশের একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক, প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন স্থানীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে সামনের আসনগুলো পূর্ণ করার ব্যবস্থা করে। কিন্তু শিশু-কিশোরেরা কি আর তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সেমিনার বুঝতে অথবা হজম করতে পারে? ফলে শিক্ষকদের ইশারা-ইঙ্গিতে বা ধমকে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও নিজেদের স্বভাবমতোই বেশিক্ষণ নীরব থাকতে পারে না। আসলে সবকিছু যে নির্দেশ বা রুটিন ওয়ার্কের অভ্যাস দিয়ে করা যায় না, সেটা হয়তো সবার পক্ষে সব সময় বোঝা সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি নরসিংদীতে যে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানেও দেখছি মূল আসামি ক্ষমতার প্রতাপ। লাইনম্যান যে ফাঁকি দিয়ে যথাযথভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন না করে নিজের দোকান চালাতেন, সেটাকে তিনি অবহেলার সঙ্গে দেখতেন এ কারণে যে, স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার এমন সম্পর্ক রয়েছে বলে দৈনিকের খবরে প্রকাশ যে, তিনি কাউকে তোয়াক্কা করতেন না এবং ভাবতেন, তাঁর যেকোনো সমস্যায় তিনি তাঁদের সমর্থন পাবেন। এ প্রবণতা অবশ্য শুধু এই ব্যক্তিরই নয়, আমাদের সংস্কৃতিতেই তা রয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটলে তা প্রকাশিত হয় বটে, অন্য সময় ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় আমরা তাকে সহ্য করি। এমনকি প্রশ্রয় দিই।
যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে, তার পরের দিন বিবিসির প্রভাতি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের যে সাক্ষাৎকার শুনি, তাতে তিনি মূল গুরুত্ব দেন এই বিষয়ের ওপর যে, দুর্ঘটনাকবলিত স্টেশনসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাঁদের যে স্বয়ংক্রিয় সিগনালিং ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়, তবে তাঁরা তদন্ত করে দেখবেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ঘটনা ঘটেছে সেটাই যে মূল গুরুত্ব পাওয়া উচিত, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার নাম আমলাতন্ত্র।
এসব ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মৃত্তিকার ওপর দাঁড়িয়ে সমস্যাকে বুদ্ধি ও হূদয় দিয়ে বোঝা এবং তার সমাধানে আন্তরিক ও সৎ প্রয়াসের নাম সৃজনশীলতা আর তার ধারেকাছে না গিয়ে পদ-পদবির ক্ষমতা প্রদর্শন এবং উচ্ছিষ্টভোগীদের লোভের জন্য প্ররোচিত করার নাম আমলাতন্ত্র। এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে আমলারাও দেশের কর্মে যুক্ত হতে পারেন। সেটাই দেশের এবং তাঁদেরও মুক্তির একমাত্র পথ।
শান্তনু কায়সার: লেখক ও অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.