যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হোক- মহান বিজয় দিবস

আজ মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার জন্য শুরু হয়েছিল যে প্রাণপণ যুদ্ধ, তার অবসান ঘটে ১৬ ডিসেম্বর: আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ বিজয় এসেছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। তাই বিজয়ের আনন্দের বিপরীতে আছে স্বজন হারানোর বিষাদ। বিজয় দিবসের প্রভাতে শহীদদের উদ্দেশে আমরা বলি: আমরা তোমাদের ভুলব না। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা জুগিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, তাঁদের সবাইকে জানাই বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। সেই সময়ের বিশ্বপরিস্থিতিতে নতুন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব খুব সহজ ছিল না। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিচল প্রত্যয়, অশেষ ত্যাগ স্বীকার, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সুযোগ্য ভূমিকা এবং ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সার্বিক সহযোগিতায় সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা গিয়েছিল। বাংলাদেশের নিপীতিড় মুক্তিকামী জনগণের লড়াই সে সময় বিশ্বব্যাপী বিপুল আবেগ সঞ্চার করেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনীর গণহত্যা বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার স্বাধিকার দাবি থেকে একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রের গর্জন স্বাধীনতার দাবিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। সোনার বাংলার স্বপ্নে বাংলার ছাত্রসমাজ ও শ্রমিক, কৃষক, নারী, মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীসমাজ এমনই উদ্দীপ্ত হয়েছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে নস্যাৎ করা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এবং সেই স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।
প্রত্যেক বিজয় দিবসে আমাদের সুযোগ আসে সেই গৌরবময় ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করার, দেশের মঙ্গলের জন্য নিবেদিতপ্রাণে কাজ করার অঙ্গীকার নবায়নের।
স্বাধীনতা অর্জনের পর রাজনৈতিক নেতৃত্বের নানা ভুলের কারণে বারবার সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের কারণে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে। আবার জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা, উৎপাদনমুখিতা ও দৃঢ় প্রত্যয়ের ঘাটতি ঘটেনি। দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিস্তার ঘটেছে, উৎপাদন-ভিত্তি কিছুটা জোরালো হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। অবশ্য রাজনীতি ও প্রশাসনের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুর্নীতি কমেছে, তাও বলা যায় না।
একাত্তরের গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য দেশব্যাপী প্রবল জনমত গড়ে উঠেছে, কিন্তু সরকার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করলেও তা প্রত্যাশিত গতি লাভ করেনি। এটা খুব দুঃখের বিষয় যে ৩৯ বছরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যায়নি। শতাব্দীর ভয়াবহতম গণহত্যা যারা চালিয়েছে, তাদের বিচার অবশ্যই করতে হবে। এবং সে কাজে আর বিলম্ব করার কোনো সুযোগ নেই। এমনিতেই অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.