শিল্প-অর্থনীতি- শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

ডিসেম্বর ডিএসইতে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল। শেয়ার ব্যবসা শুরু হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ডিএসইর সাধারণ সূচক ৫৪৬ পয়েন্টে নেমে যায়। বলাবাহুল্য, প্রায় সব কম্পানির শেয়ারের দামই পড়তে থাকে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এরপর রাস্তা অবরোধ, মিছিল, গাড়ি ভাঙচুর_এসব ঘটনা ঘটে। এসইসি ভবনের সামনে গিয়েও বিক্ষোভ দেখানো হয়। বলাবাহুল্য, ডিএসইর সামনেও অনুরূপ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। এসইসির দুটি সার্কুলার জারিকে কেন্দ্র করে এই পতন হয় বলে জানা গেছে।
এরপর এসইসির নির্দেশ দুটি স্থগিত করা হলে শেয়ারবাজার আবার উঠতে থাকে। পরদিন অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর তো সূচক ১২৮ পয়েন্ট বেড়েছে। প্রথমেই দেখতে হবে, নির্দেশ দুটিতে কী ছিল। নেটিং-সুবিধার অপব্যবহার করে শেয়ারবাজারে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউসের গ্রাহকের হিসাব থেকে শেয়ার বিক্রির আগেই কেনার প্রবণতা বন্ধের জন্য গত সোমবার এ দুটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।
এসইসির এক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আদেশ দুটি নতুন নয়, আগেই প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে কার্যকর করার ব্যাপারে তখন জোর দেওয়া হয়নি। বোঝা যাচ্ছে, শেয়ারবাজারের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে এ নির্দেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কোনো চেক ক্যাশ না হওয়া পর্যন্ত এর বিপরীতে শেয়ার ডেলিভারিতে কী বিপদ হতে পারে, তার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে সুদূর ১৯৯২ সালের ঘটনায়। আইসিবির অনুকূলে দুজন শেয়ার ব্রোকার ক্লিয়ারিং হাউসে দুটি চেক জমা দিয়ে ঢাকা ভেজিটেবলসের শেয়ার নিয়ে যান। তখন ঢাকা ভেজিটেবলসের শেয়ার ছিল ব্লুচিপ; এবং বাইরেও শেয়ার বিক্রি করা যেত। তাঁরা বাইরে শেয়ার বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করে চলে যান। ইতিমধ্যে চেক দুটি বাউন্স করার পর আইসিবি ডিএসইর কাছে অভিযোগ করে। যা-ই হোক, সে সময় বিধি প্রণয়ন করা হলো, চেক অনার না হওয়া পর্যন্ত শেয়ার দেওয়া হবে না। ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে এই বিধি চালু করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। এখন বিধিনিষেধও অনেক হয়েছে। এর পরও কোনো চেক অনার না হওয়া পর্যন্ত এর বিপরীতে কোনো লেনদেন কার্যকর করা ঝুঁকিপূর্ণ। অতএব সেদিক থেকে এটা দোষের কিছু নয়। আর নেটিংকে তো মনে করা হয় ক্যাসিনো সিনড্রম।
মনে রাখতে হবে, বহু উন্নত প্রযুক্তি এবং বিধিবিধান সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাঝেমধ্যেই শেয়ার কেলেঙ্কারি হচ্ছে। কয়েক দিন আগে চীনের মতো দেশেও বিরাট শেয়ার জালিয়াতির খবর বেরিয়েছে। সাধারণত কোনো কম্পানিকে ঘিরে কোনো দুর্নীতি বা কলঙ্ক ঘটলে যেমন শেয়ারের দাম পড়ে যেতে পারে এবং এতে প্যানিক সৃষ্টি হয়, আবার অনেক সময় ব্যক্তিবিশেষের দুরভিসন্ধি কিংবা দুর্নীতির জন্যও শেয়ারবাজারে ধস নামতে পারে। যেমন_ভারতে হারসাদ মেহেতা এবং পরবর্তী সময়ে কেতান পরেখের জন্য যথাক্রমে শেয়ারবাজার এবং ইউটিআই মিউচুয়াল ফান্ডে ধস নেমেছিল। কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কোনো বিধিবিধান কার্যকর করতে গেলে দ্রুত এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে_এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এর পেছনে কোনো চক্র কাজ করছে। এর আগেই দেখা গেছে, মার্জিন মানি-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশ জারি হলে তা নিয়েও হৈচৈই করা হয় এবং শেয়ারবাজারে ধস নামানো হয়। ফলে কর্তৃপক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। কোনো রকম বিধিনিষেধ জারি হলে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা কিংবা পর্যবেক্ষণ করার সময়-সুযোগ থাকে। কিন্তু তা না করে একা বা প্রত্যক্ষভাবে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এতে কি মনে করার সুযোগ নেই যে এক শ্রেণীর শেয়ার ব্যবসায়ী তাঁদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য এসব কাজ করে থাকেন। এটাও মনে করার কারণ রয়েছে যে এক শ্রেণীর মার্চেন্ট ব্যাংকেরও এতে যোগাযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। যেকোনো বিক্ষোভের মুখে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যায়সংগত কোনো সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করা থেকে পিছিয়ে এলে, তা আত্মঘাতী হবে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই নিতে হবে। এতে সাময়িক কিছু জটিলতা এলেও শেষ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হবে। যেমন_চেক অনারের বিষয়টি আবারও আলাপ করা যাক। যদি মোটা অঙ্কের কোনো চেক ডিজঅনার হয়, তখন এর প্রতিকার করার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। আর তা গোটা বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, এভাবে চক্রান্তের নিম্নস্রোত প্রবাহিত হতে হতে যদি কখনো ওপরে উঠে মূল জায়গায় আঘাত করে, তাহলে আর কিছুই করার থাকবে না। আর আমাদের দেশের স্টক এঙ্চেঞ্জের কিছু সদস্য এমন একটি রাজনৈতিক চিত্র দিয়ে থাকেন, যার ফলে মনে হয়, স্টক এঙ্চেঞ্জে ভালো-মন্দ যা-ই ঘটুক না কেন, তার জন্য সরকার দায়ী। এর ফলে যদি কখনো বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে, তাহলে এর রাজনৈতিক মূল্য অর্থনৈতিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি হবে। তাই কঠোর হওয়ার এখনই সময়। এখানে আরো মনে হচ্ছে, প্রচুর মুনাফা অর্জনের জন্য এক শ্রেণীর শেয়ার ব্যবসায়ী নিরীহ কিছু বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করে তাঁদের পুতুলের মতো ব্যবহার করছেন। ডিএসই কর্তৃপক্ষের পক্ষে এ ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া সংগত কারণেই সম্ভব হচ্ছে না। তারা শুধু একটি কথাই বারবার বলছে, সরকারের ব্যবসা করার কী দরকার। সব শেয়ার ছেড়ে দেওয়া উচিত। প্রথমত, প্রশ্ন হলো, তারা কি অবহিত আছে যে গত বিশ্বমন্দার সময় দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন সরকারকে কত বিলিয়ন ডলারের শেয়ার কিনে কম্পানিকে বাঁচাতে হয়েছে। অতএব এখন এ কথা বেসুরো শোনায় যে সরকারের ব্যবসা করার প্রয়োজন নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্যকে নিয়ে ব্যবসায়ীরা যেভাবে খেলছেন, তাতে জনমনে এ ধারণা অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছে, সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে কিছু অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করার। দ্বিতীয়ত, এখন বোঝা যাচ্ছে যে শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বগতির কারণ শুধু শেয়ার সংকট নয়। এখানে নিম্নস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। এ রকম কোনো নিশ্চয়তা নেই, শেয়ার সরবরাহ বাড়লেই উন্মাদের মতো যে ঊর্ধ্বগতি চলছে, তা বন্ধ হবে। এখানে আরো একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, মিডিয়ায়ও কিছু বিভ্রান্তিকর খবর ছাপা হয়। যেমন_৮ ডিসেম্বরের শেয়ার সূচকের পতনের কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালের এক দিনের সূচকের সর্বোচ্চ যে পতন হয়েছে, সেদিন ছিল এর আড়াই গুণ। কিন্তু এ কথা বলা হয়নি, বর্তমান শেয়ারের সূচক সেদিনকার শেয়ার সূচকের চেয়ে কত গুণ বেশি। শেয়ারের দাম যতই বাড়ুক, তখন বলা হয়, দাম বেড়েছে। আর এই তপ্ত মার্কেটে একটু বেশি কমলে তখন বলা হয় পতন। আর এই পতন কথাটার সঙ্গে আতঙ্ক জড়িত। অতএব এসব ব্যাপারে একটু সতর্ক হওয়া ভালো।
ইতিমধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র থিওরি আবিষ্কার করা হচ্ছে। যথারীতি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। তবে ষড়যন্ত্র একটাই, আর তা হলো বর্তমানে শেয়ারবাজার অত্যন্ত সক্রিয় থাকায় একদল এখান থেকে ফায়দা লুটতে চাচ্ছে, যা বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকেই লক্ষ করা গেছে। কোনো সুযোগ এলেই কিছু সুযোগসন্ধানী এটাকে কাজে লাগিয়ে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আগে উল্লেখ করেছি এবং আবার বলছি, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তবে এর আগে যেটা প্রয়োজন, তা হলো, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে যে শেয়ারবাজারকে কতটা কাজে লাগানো যেতে পারে। শেয়ারবাজারের ভূমিকাই বা কী। মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন জিডিপিকে অতিক্রম করলেই বা কী আসে-যায়। মাঝেমধ্যে এ রকম হাস্যকর কথা শোনা যায়, শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুলে দেওয়া হবে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য। আর এসব অস্বচ্ছ ধারণার সুযোগ নিয়ে অনেকেই শেয়ারবাজারের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর ডিএসইর সদস্যরা কেন এত বেশি প্রচারমুখী হচ্ছেন_এর অন্যতম কারণ হলো, বর্তমানে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সদস্যপদের মূল্য নিউইয়র্ক স্টক এঙ্চেঞ্জের সদস্যপদের চেয়ে বেশি।
============================
মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
সাবেক ইপিসিএস, শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও কলামিস্ট


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.