আলোচনা- উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা by মো. ফারুক শাহ

র্তমান বিশ্বে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একটি দেশের সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক বিকাশ এবং আধুনিকায়নে উচ্চশিক্ষার বিকল্প নেই বললেই চলে। বলা হয়ে থাকে, যেকোন জাতির উন্নয়নের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হল উচ্চশিক্ষা। এই হাতিয়ার ব্যবহারের উপর নির্ভর করে যোগ্য নেতৃত্ব, দক্ষ প্রশাসন এবং শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা।
পাশ্চাত্য দেশসমূহের ন্যায় আমাদের দেশেও উচ্চশিক্ষার মূল কেন্দ্র হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। এসকল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আহরণ, চর্চা এবং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও বিস্তৃতিতে সর্বদা অবদান রেখে চলেছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির চর্চা এবং মতামত প্রকাশের সর্বোচ্চ জায়গা হিসাবে গৃহীত ও বিবেচিত হয়ে থাকে।
মুসলমানদের দাবি ও উচ্চশিক্ষার পথ সৃষ্টির জন্য এ অঞ্চলে ব্রিটিশরা ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। আমরা যখন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করি তখন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ছ'য়ে। তবে স্বাধীনতার পরের দশকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা বা চাহিদার তুলনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনের সংকট লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থনৈতিক মন্দা ও অন্যান্য সামাজিক সংকটের কারণে সরকারের পক্ষে এসকল প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। তাই অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে বাধ্য হয়ে পড়ে। এসকল শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে ব্যয় হতো, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ছিল ক্ষতিকর। পাশাপাশি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য সবক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা চরমভাবে উপলব্ধি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও অন্য দাতা সংস্থাগুলো সরকারকে আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিতে থাকে। এমতাবস্থায়, ব্যবসায়ীদের একটি দল ব্যক্তিগত মালিকানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করে। অন্যদিকে সরকারকে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা দিতে হবে না অথচ উচ্চশিক্ষার একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে_এই নীতিতে সরকার দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সম্মত হয়। ১৯৯২ সালে 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন' পাস হলে দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের একটি নতুন পথ সৃষ্টি হয়। এই আইন অনুযায়ী ৫ নভেম্বর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩-তে। এর মধ্যে আইনটির কিছু অংশ পরিবর্তন ও সংশোধনও হয়েছে। শুরুতে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমালোচনা করা হতো 'বাণিজ্যিকীকরণের' যুক্তি দিয়ে। ধারণা ছিল, এখানে শুধুমাত্র উচ্চবিত্তের সন্তানেরাই পড়াশুনা করার সুযোগ পাবে। বিষয়টি পাশ্চাত্যের দেশসমূহে স্বাভাবিক বিষয় হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখানে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ শুধুমাত্র ধনিক শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, পাশাপাশি সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও তা পাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণকে সহজলভ্য করার পাশাপাশি গুণগতমান উন্নয়নের ধারাও অব্যাহত রয়েছে।
শিক্ষার 'গুণগতমান' নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক শোনা যায়। গুণগতমান বিচারের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয় তা হল_ শিক্ষা ও শিক্ষণ পদ্ধতি, ক্যাম্পাসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুযোগ-সুবিধা, পড়াশোনার বিষয়বস্তু ও বাস্তবতা, সেশনজট, ছাত্র সংঘাত ইত্যাদি। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। পাঠদানকারী অনেক শিক্ষক দেশে-বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন। পাশাপাশি তারা বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্সের আয়োজনেও অংশগ্রহণ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালগুলোর সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিক হচ্ছে- ছাত্র রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকা। এসকল প্রতিষ্ঠানে যেকোন ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। বিধায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কলুষিত ছাত্র সংঘাত ও ছাত্র সন্ত্রাসের কবল থেকে এ প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্ত। তাই এখানে কোন সেশনজট নেই। নেই কোন সময় নষ্টের বা অপচয়ের সম্ভাবনা। শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে তাদের কোর্স সম্পন্ন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি এখানে যুগোপযোগী পড়াশোনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরনের বাস্তবধর্মী কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে একজন শিক্ষার্থী তার পড়াশুনা শেষ করার পর কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে যেমন কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে তেমনি নিয়োগদানকারী প্রতিষ্ঠানও কিছুটা দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৯৫ ভাগ ঢাকা শহরে অবস্থিত। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো অতীব জরুরী। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার তা বর্তমান ঢাকা শহরে যে নিশ্চিত করা সম্ভব নয় তার সঙ্গে সকলেই একমত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা। আশার কথা হচ্ছে, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে এই কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করে তাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশেও এসকল প্রতিষ্ঠান তাদের সুনাম অব্যাহত রেখেছে। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের বাইরে বিভাগীয় বা জেলা শহরগুলোতে স্থাপনের বাধ্যবাধকতা আরোপ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজ এলাকায় বা বাড়িতে বসেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যেমন সুযোগ পাবে তেমনি ঢাকা শহরও কিছুটা হলে জনসংখ্যার চাপ থেকে মুক্তি পাবে।
একবিংশ শতাব্দিতে জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান ও উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করছে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির উপরে। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রকে এগিয়ে নিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে উচ্চশিক্ষার এই মাধ্যমটি দেশে সবেমাত্র দুই দশকের শেষ প্রান্তে। রাতারাতি এসকল প্রতিষ্ঠান থেকে শতভাগ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়- এটাই স্বাভাবিক। তাই এসকল প্রতিষ্ঠানে যেসকল সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেগুলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাধান করতে হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
=============================
বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ মো. ফারুক শাহ
শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.