প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন কৌশল by ছিদ্দিকুর রহমান

প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হওয়া বয়সী শিশুদের অধিকাংশই দরিদ্র, নিরক্ষর পরিবারের সন্তান। তাদের পারিবারিক পরিবেশ শিশু বিকাশের অনুকূলে নয়। তাই শিশুরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার বয়স হলেও দৈহিক ও মানসিকভাবে ভর্তি হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায় না। ভাষা, চালচলন, সামাজিকতা, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি বিষয়ে শিশুর পারিবারিক ও বিদ্যালয়ের পরিবেশের মধ্যে বিরাট শূন্যতা বিরাজ করে। ফলে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর নতুন পরিবেশের সঙ্গে শিশু খাপ খাওয়াতে পারে না; অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকের কথা বোঝে না। মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্য থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। সরাসরি ৬+ বছর বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এতে অনেকের লেখাপড়ার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। বিদ্যালয়ে এলেও হয় পড়া বোঝে না, না হয় লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে পারে না। ফলে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ে এবং পরীক্ষায় ফেল করে। এ কারণে বহু শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে।
শিশুদের এসব সমস্যার কথা বিবেচনা করে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ ৫+ বয়সের শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেশব্যাপী চালু করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে দীর্ঘমেয়াদি শিশুযত্ন বিকাশ ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। বাংলাদেশে অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে এখনই সবার জন্য এ সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে সম্প্রসারণ করে তা করা সম্ভব। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তৈরি করবে। এখানে আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার চাপ থাকবে না। বর্তমানে চালু বেবি ক্লাস, কেজি ক্লাস বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসার মতো জোর করে মুখস্থ করানো, বোঝা বোঝা বাড়ির কাজ বা ব্যাগভর্তি বইয়ের চাপ সহ্য করতে হবে না। আনন্দঘন পরিবেশে শিশুকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আবেগিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী করে তোলাই হবে এ কার্যক্রমের মুখ্য উদ্দেশ্য। দেশব্যাপী এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যেসব নীতি ও কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন, তার রূপরেখা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
সারা দেশের ৫+ বয়সী সব শিশুর জন্য শিশু শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা। কেন্দ্রের অবস্থান শিশুদের বাড়ির কাছাকাছি হবে। প্রতি উপজেলায় গড়ে ২০০ করে প্রায় এক লাখ কেন্দ্রে এ কার্যক্রম চালু করতে হবে।
প্রতি কেন্দ্রে শিশুর সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই ২৫-এর বেশি হবে না।
প্রতি কেন্দ্রে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একজন করে শিশু শিক্ষা পরিচর্যাকারী (শিক্ষক) থাকবেন। পরিচর্যাকারী হবেন স্থানীয় নারী এবং তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে ন্যূনতম এসএসসি। পরিচর্যাকারীকে অবশ্যই শিশু শিক্ষা পরিচালনার ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে এ কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যাবে না।
শিশু শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে স্থানীয় সরকার, অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদের ওপর। ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক গঠিত ‘ইউনিয়ন শিক্ষা কমিটি’ ইউনিয়নভুক্ত কেন্দ্রগুলো পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করবে। শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য ঘর ও আসবাবের ব্যবস্থা করা, শিশুর ভর্তি ও নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা, শিক্ষা পরিচর্যাকারী (শিক্ষক) নিয়োগ এবং মাসিক বেতন প্রদান, কার্যক্রম তদারকি ও পরিবীক্ষণ ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বে থাকবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব হবে শিক্ষাক্রম নির্ধারণ, শিখনসামগ্রী (প্রচুর ছবিসংবলিত গল্প ও ছড়ার রঙিন বই এবং খেলাধুলা, গানবাজনা ও চারু-কারুকলার সামগ্রী) সরবরাহ করা এবং শিশু শিক্ষা পরিচর্যাকারীর প্রশিক্ষণ প্রদান। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার ইউনিয়ন শিক্ষা কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। কেন্দ্রীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বার্ষিক আর্থিক থোক বরাদ্দ দেবে। ইউনিয়ন পরিষদকে শিক্ষা কর আদায়ের আইনগত অধিকার দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা যায়।
শিশু শিক্ষাকেন্দ্র সকাল নয়টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বেলা তিনটা থেকে পাঁচটা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকবে। শিশুরা সুবিধামতো সময়ে আসবে এবং দুই থেকে তিন ঘণ্টা অবস্থান করবে।
শিক্ষাপদ্ধতি হবে সম্পূর্ণ শিশুকেন্দ্রিক। বাংলা, গণিত, স্বাস্থ্য, পরিবেশ পরিচিতি ইত্যাদি আলাদা কোনো বিষয় থাকবে না। সমন্বিত পদ্ধতি (integrated method) অবলম্বনে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সুনির্দিষ্ট কোনো পাঠ্যপুস্তক বা প্রাইমার থাকবে না। কেন্দ্রে বেশিসংখ্যক ছবি, ছড়া, গল্পের রঙিন বই থাকবে। আঁকা ও হাতের কাজের জন্য চারু ও কারুকলা-সামগ্রী থাকবে। আর থাকবে খেলাধুলার প্রচুর সামগ্রী। ছড়াগান, গল্প বলা, সমবেত গান, নাচ, ছবি আঁকা, রং করা, হাতের কাজ করা, খেলাধুলা ও আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তৈরি করা হবে। বাড়ির কাজ বলতে কিছুই থাকবে না।
শিশু শিক্ষাকেন্দ্র হবে শিশুর জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। এমন আনন্দঘন পরিবেশে কার্যক্রম পরিচালিত হবে, যেন প্রতিটি শিশু কেন্দ্রে আসার জন্য উদগ্রীব থাকে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেন শিশু সানন্দে প্রতি কাজে অংশ নেবে। শিশু শুনবে, নিজে বলবে, আঁকবে, খেলবে, নাচবে—এভাবে তার শিখন ও বিকাশ সম্পূর্ণ হবে।
গ্রামের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রের দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মাঝেমধ্যে কেন্দ্রে আসার জন্য আমন্ত্রণ করা যেতে পারে। যেমন—চারণকবি, বাউল বা পল্লি গায়ক এসে গান শোনাতে পারেন। বছরে দু-একবার বানরের নাচ, পুতুলনাচ বা অন্য কোনো খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা যায়।
শিক্ষাকেন্দ্রের ঘর বা কক্ষটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রচুর আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকবে। ঘরের মেঝে থাকবে শুকনো। ঘরের দেয়ালে শিশুদের আঁকা এবং সংগ্রহ করা সুন্দর সুন্দর ছবি ও চিত্র প্রদর্শন করা থাকবে। কিছুদিন পরপর এগুলো পরিবর্তন করতে হবে।
শিশু শিক্ষা পরিচর্যাকারী শিশুদের অভিভাবক, বিশেষ করে, মায়েদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখবেন। শিশুর যত্ন, খাদ্য, পুষ্টি, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে মাঝেমধ্যে ‘মা সমাবেশ’ করে আলোচনার ব্যবস্থা করবেন। কোনো অবস্থাতেই কোনো শিশু সম্পর্কে অভিভাবকের কাছে কোনো প্রকার অভিযোগ করা যাবে না। তবে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া যাবে।
শিশুর বিকাশ ও শিক্ষার সাফল্য শিক্ষা পরিচর্যাকারীর (শিক্ষক) আন্তরিকতা ও দক্ষতার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। এর জন্য প্রয়োজন ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা। আজকের কোমলমতি শিশুদের যত্ন, পরিচর্যা ও ভালোবাসা দিয়ে বিকশিত করা গেলে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে সুশিক্ষা লাভ করে নীতিবান, দক্ষ, জ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশি হিসেবে গড়ে উঠবে।
ড. ছিদ্দিকুর রহমান: অধ্যাপক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি-২০০৯।

No comments

Powered by Blogger.