পাবনা থেকে পঞ্চগড়: সোনার ছেলেদের নবশাসন by সোহরাব হাসান

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী দুই সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মহা গুণধর কর্মীরা কেন অফিস সহকারী ও কেরানির চাকরির জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছেন, আমাদের বোধগম্য নয়। এ দুই সংগঠনের কর্মীরা পড়াশোনা করেন না বলে ‘সুনাম’ আছে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় নিবেদিত সরকারের সোনার ছেলেদের ডিজিটাল জ্ঞানবিরোধী এই কর্মযজ্ঞ দেশবাসীকে ভয়ানক শঙ্কায় ফেলেছে বললেও কম বলা হবে। বলিউড ছবির ভিলেনরা যেমনটি করে থাকে, ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেরা তার চেয়ে মোটেই কম যান না।
আমরা জানি, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের দৃষ্টি বরাবর ওপরে থাকে। কিন্তু ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সামান্য চাকরির জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠলেন কেন? এর বেশি যোগ্যতা কি তাঁদের নেই? তাঁরা যখন রাজনীতি করতে এসেছেন, তখন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, নিদেনপক্ষে প্রতিমন্ত্রীর খোয়াব তো দেখবেন। না হলে অন্তত বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রেস কাউন্সিলরের পদের জন্য আবদার করতে পারতেন। সেসব না করে একেবারে কেরানি-পিয়নের চাকরির জন্য এত ভাঙচুর, এত মারধর, এত হাঙ্গামা!
কাকতালীয় হলেও মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে পাবনা ও পঞ্চগড়ে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ‘পাবনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা গতকাল (শুক্রবার) জেলা প্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষাকেন্দ্রে ব্যাপক হামলা চালিয়েছেন। নিজেদের পছন্দের প্রার্থী নিয়োগের দাবিতে তাঁরা এ হামলা চালান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁরা দুটি কেন্দ্রে ভাঙচুর, লুটতরাজ, মারধর করেন এবং প্রশ্ন ও উত্তরপত্র পুড়িয়ে ফেলেন।’ (প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। এ হামলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিজয় ভূষণ পালসহ ১৬ জন আহত হন। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা বিভাগীয় কমিশনার অফিসের একটি গাড়িসহ জেলা প্রশাসনের চারটি গাড়ি এবং পাবনা স্কুল ও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীদের কাজ জনগণকে সুশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা নয়।
এই সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে পুলিশ শনিবার রায়হান নামে যুবলীগের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়েছে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আহমেদ শরীফ ডব্লিউ, সাবেক সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান সুইটসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৬৪ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। আর যায় কোথায়? পাবনার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ জিহাদে নেমে পড়ল স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে পঞ্চগড়ে পরীক্ষায় পছন্দের প্রার্থীরা পাস করতে না পারায় গত রোববার গভীর রাতে সিভিল সার্জনের অফিস ভাঙচুর করেন একদল সন্ত্রাসী। এ সময় তাঁরা সার্জনের সম্মেলনকক্ষে ঢুকে পরীক্ষার উত্তরপত্র ও ফলাফল শিট নিয়ে যান। এমনকি তাঁরা সিভিল সার্জন ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (সার্বিক) গাড়িও ভাঙচুর করেন। চতুর্থ শ্রেণীর পাঁচটি পদে ১৫ জনকে নিয়োগের লক্ষ্যে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। রাত একটা ২০ মিনিটে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হলে ২০-২৫ জন বিক্ষুব্ধ যুবক সন্ত্রাসী কায়দায় ভাঙচুর শুরু করেন। তাঁরা সিভিল সার্জনের অফিসের দরজা-জানালার কাচ, বেসিন, আসবাব ভাঙচুর করেন এবং নিয়োগ কমিটির সদস্যদের ওপর চড়াও হন।
এই হামলাকারীরাও স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বলে জানা গেছে। তাহলে বলতে হবে, তাঁদের নেটওয়ার্কটি বেশ শক্তিশালী।
সিভিল সার্জন মো. ইমান উদ্দিন বলেছেন, পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করায় একটি প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে ওই হামলা চালানো হয়। এই প্রভাবশালী মহল যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, তাতে সন্দেহ নেই। দীর্ঘদিন ধরেই পঞ্চগড়ে আওয়ামী নেতৃত্বে কোন্দল চলছে। সেখানকার যেকোনো নাগরিককে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতে পারবেন, এটি কাদের কাজ। আওয়ামী জমানায় অন্য দলের কার বাপের এমন বুকের পাটা আছে যে তারা মধ্যরাতে এই সশস্ত্র অভিযান চালাবে?
দুটি ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র ভিন্ন হলেও কয়েকটি বিষয়ে আশ্চর্য মিল রয়েছে। দুটি স্থানেই যুবলীগ ও ছাত্রলীগের গুণধর কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন পরীক্ষাকেন্দ্রে। অর্থাৎ পরীক্ষা বিষয়টিকে তাঁরা ভীষণ ভয় পান। পরীক্ষা মানে যোগ্যতা যাচাই, পরীক্ষা মানে গুণের বিচার, পরীক্ষা মানে ভালো ও মন্দের পার্থক্য করা। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সোনার ছেলেরা সেটি মেনে নেবেন কেন? তাঁরা দলের পরিক্ষীত সৈনিক, দেশপ্রেমিক নাগরিক। তাঁদের আবার পরীক্ষা দিতে হবে কেন? যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ক্ষমতায় এসেছেন, সেহেতু সব পদে তাঁদেরই নিয়োগ দিতে হবে।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের পরীক্ষায় নাকি এভাবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা নিয়োগ আদায় করে নিয়েছিলেন। বিগত বিএনপি আমলে দলীয় প্রার্থীদের পাস করাতে বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস করানো হয়েছিল। বিএনপি শাসন নেই, তবে তার সংস্কৃতি পুরো যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা আয়ত্তে নিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতার পর তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ডুবিয়েছেন এবং এখন শেখ হাসিনাকেও ডোবাতে বসেছেন। আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগই। মন্ত্রীরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রায়ই দেশবাসীকে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ করেন, কিন্তু তাঁরা যদি দলের ভেতরের সোনার ছেলেদের প্রতি একটু নজর দিতেন, তাহলে দেশ তো বটেই, আওয়ামী লীগও রক্ষা পেত।
পঞ্চগড়ের ঘটনাটি ঘটেছে রোববার গভীর রাতে। এ কারণে গতকাল পর্যন্ত সেখানে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু পাবনায় পরীক্ষা ভণ্ডুল নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে চলেছে। ঘটনার পরপরই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের দাবি, জেলা প্রশাসক একজন মহা দুর্নীতিবাজ। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এত দিন তাঁরা নিশ্চুপ ছিল কেন? পরীক্ষার হলে হামলার দায়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পরই তিনি দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলেন? শুক্রবারের আগে কেন তারা এ দাবি করল না?
অগ্রজ সাংবাদিক আতাউস সামাদ পত্রিকান্তরে লিখেছেন, ‘অপরাধ করে অপরাধীই অভিযোগকারীকে আসামি করার পুরোনো কৌশলটি দেশজুড়ে আওয়ামী লীগপন্থীরা ইদানীং ব্যবহার করছে। এ ধরনের আচরণে দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নেমে আসছে।’ (দৈনিক দেশ, ২০ সেপ্টেম্বর,২০১০)। সারা দেশে হচ্ছে কি না বলতে পারব না। তবে পাবনায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মিলে সেই কৌশলই ব্যবহার করছেন। এখন তাঁরা জেলা প্রশাসক ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। এতে কাজ না হলে সেই মোক্ষম দাওয়াই ব্যবহার করবেন। বলবেন, জেলা প্রশাসক ও তাঁর সহযোগীরা বিএনপি-জামায়াতের চর।
এত দিন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের টার্গেট ছিল বিরোধী দলের নেতা-কর্মী। এবার খোদ প্রশাসনের গায়ে হাত দিয়েছেন। এটি কিসের লক্ষণ? এর পরিণতির কথা কি একবারও তাঁরা ভেবে দেখেছেন? সোমবারের পত্রিকার খবর, ‘জেলা প্রশাসকসহ পাবনার প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা একযোগে বদলির আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁরা একটি প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর কথাও বলেছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আজ কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
আমরা কোথায় আছি? আক্রমণকারীরাই বিচারের দাবিতে শহর গরম করেছে। নিরীহ সরকারি কর্মকর্তারা কী করবেন? হয় বদলি হবেন, না হয় মুখ বুজে সব সহ্য করে ক্ষমতার পরিবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। পাবনার ঘটনাটি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তানির মধ্যে সীমিত থাকলে হয়তো সরকার মুখ রক্ষা করতে পারত। কিন্তু পাবনার আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সবাই প্রশাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে আস্ফাালন করছেন, তাতে প্রশ্ন জাগে, সেখানে আইনের শাসন বলতে কিছু আছে কি না? দলীয় নেতা-কর্মীদের ভয়ে সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি জেলা প্রশাসক অফিসে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এই ভয় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?
পাবনার সব সরকারি কর্মকর্তারা তো স্বেচ্ছায় গণবদলির আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অতএব, বদলির দাবিতে আন্দোলন করার দরকার নেই। বরং ছাত্রলীগ ও যুবলীগ দাবি তুলতে পারত, পাবনার সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়ে শূন্য পদগুলোতে তাদের নেতা-কর্মীদের নিয়োগ দিতে হবে। সরকার দুই বছর মেয়াদি একটি কর্মসৃজন কর্মসূচি নিয়েছে। এরই মধ্যে কুড়িগ্রাম ও বরগুনায় কয়েক হাজার বেকার যুবককে চাকরিও দেওয়া হয়েছে। সরকার এখন পাবনায় এ কর্মসূচি নিতে পারে এবং সেই চাকরির মেয়াদ হবে আমৃত্যু বা বংশপরম্পরায়। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা মারা গেলে পদাধিকারবলে তাঁর ছেলে বা মেয়ে সে পদে অধিষ্ঠিত হবেন। সংসদের আগামী অধিবেশনে এ-সংক্রান্ত একটি বিলও আনা যেতে পারে। এতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রশাসনের বিরোধ হবে না। সরকারের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরও তটস্থ থাকতে হবে না, প্রশাসনে কখন কোন ফাঁকফোকর দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের চর ঢুকে পড়বে।
পঞ্চগড় ও পাবনার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা কী দেখতে পাই? ছাত্রলীগ ও যুবলীগ যেভাবে চাইবে, সেভাবেই পরীক্ষা নিতে হবে। পরীক্ষায় কে কত নম্বর পেল, তা বিবেচনায় না এনে তাদের পছন্দসই প্রার্থীদের চাকরি দিতে হবে। প্রশাসন চলবে তাদের কথায়, তাদের মর্জিতে। না হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ কেন?
প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সবাই এত দিন বলে আসছিলেন, সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু গত ২০ মাসেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলটি হলো, সন্ত্রাসীরাই পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। পাবনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ যা শুরু করেছে, সেটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে কী ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। মানুষ তো ছাত্রলীগ ও যুবলীগের শাসন চায় না। আইনের শাসন চায়।
পাদটিকা: প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে ১০২ জন সফরসঙ্গী নিয়ে গেছেন। এ তালিকায় পাবনার আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের রাখলে নিশ্চয়ই তাঁরা অবদান রাখতে পারতেন। আগামী বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী পাবনার দলীয় নেতা-কর্মীদের বিষয়টি মনে রাখবেন আশা করি। কেননা, দেশের এই কীর্তিমানদের সেবা থেকে বিশ্ববাসীকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.